ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

লিঙ্কে ক্লিক করে দেখুন "বিখ্যাত নয় অত। তাই চিঠিতে নাম নেই...."



এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন ফেসবুক জুড়ে ভীষণ তোলপাড় হতে থাকে, যখন একইরকম ভাবধারায় কোনো মানুষ দিনের পর দিন নিজেকে সেলিব্রিটি মনে করতে থাকে বা রাতারাতি লাইক, কমেন্ট, শেয়ার কত হলো এটা দেখার জন্য ভোর অবধি অপেক্ষা করে ঠিক তখনই কবি অভীক রায়  "আয়নার ওপার থেকে" কিছু বলে ওঠেন।
চলুন দেখি তিনি কি বললেন....?  তিনি কি বললেন NRC বিরোধের কথা?, তিনি কি বললেন হিন্দু মেয়েটা মুসলিম ছেলেটাকে বিয়ে করুক? , তিনি কি বললেন পরকীয়া একটি ভালো কিংবা খারাপ প্রথা?কিংবা তিনি কি এটা বললেন, যে মেয়েটাকে  প্রেম করছ তাকে বিয়ের আগে ছোঁবে না? 
না তিনি এগুলো বললেন না বরং সমসাময়িক সময়ে শেয়ার,কমেন্ট এবং লাইকের লোভ কাটিয়ে তিনি যা বললেন সেগুলো একটু অন্যরকমের গল্প। সেগুলোই বলব এখন।
আমরা প্রথমেই দেখতে পাবো যে,
পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া মধ্যবয়সী তরুণ হঠাৎ দেখতে পাওয়া এক অপরিচিত কান্নারত তরুণীকে স্বইচ্ছায় জানতে চায়লেন 'তখন থেকে দেখছি আপনি জল ফেলছেন দু-চোখ দিয়ে" এবং তা শুনে রিতীমত অপরিচিত তরুনী রেগে গিয়ে ছেলেটিকে বললেন "আপনার কী?! আমার দু-চোখ! যা খুশি তাই ফেলতে পারি!" আর বলতে গিয়েই জড়িয়ে পরলেন সম্পর্কে এরপর প্রথম মা ডাক শোনা অবধি সম্পর্ক গড়িয়ে যওয়ার পর সাফল্যের তুঙ্গে উঠে মহিলা গেলেন বিদেশে এবং সেখানে বহুবছর কেটে যাওয়ার পর জীবন যেটা পারেনি মৃত্যু সেটাই পেরেছে অর্থাৎ মহিলা ফের দেশে ফিরে আসে তবে ফেরার ঘটনা না পড়লে বুঝতে পারবেন না আর ততক্ষণে "ধূপের গন্ধ চতুর্দিকে"ছড়িয়ে যাবে আর জানিয়েও দেওয়া হবে যে,  সেদিন যে আলাপকে কেন্দ্র করেই তাদের হঠাৎ দেখা  হওয়া সেই একই আলাপে আবার পরের জন্মে দার্জিলিং-এ আলাপ হবেই তাদের। 

এরপর  আমরা অনেক সময়  যাদের দু-গালে জলের দাগ লেগে থাকে তাদের চোখেমুখে হাসির ঢেউ দেখতে পায় অথচ তাদের  ভাগ হয়ে যাওয়ার খবর রাখি না। 
কোনো জলসায় জুটে যাওয়া মানুষজনের সংখ্যা অনেকবেশি হয় কিন্তু তারা বিপদ বুঝেই হাঁটা দেয়, আবার খুব শোকে সান্ত্বনা দেয় সবাই শুধু অবস্থা বোঝার সময় কজন বোঝে?
কবি প্রশ্ন করেছেন  " তোমার সকল সোনা ফুরিয়ে গেছে। ভরসা রুপো।"
আর দেওয়ার মতো কিচ্ছুটি নেই। তাই কী শরীর.."
এমনকি কবি এটাও বলছেন, আত্মীয়তা নষ্ট হয় বৃথা ফলের আশায় অর্থাৎ আত্মীয়রা যাভাবে তা না পেলে সরে দাঁড়ায়। 
"তোমার বোনের স্যার ওর ঠোঁট ভালোবাসত। কতদিন বিকেলে দেখেছি"।
কবি আর রসিকতা করবে না তাই কি হয় বলুন দেখি কিন্তু রসিকতাও যে মেপে করা যায় তা বোধহয় কমজনই জানে, যা স্পষ্ট হবে 'সহ্যক্ষমতা' পড়ার পর।
"বিরহে চশমা নিখোঁজ। বিপদে শত্রু হাজার।
মানুষের কাজই হলো অসময়ে বন্ধু সাজা"।
হুম এটাই তো সুযোগ বন্ধু সাজার যেটা কবি অবলীলায় বলেছেন অথচ "ভালোবেসে যে ক্ষয়ক্ষতি, সে হিসেব রাখাও বারণ"।
তীব্র ভালোবাসার প্রতীক না হলে সে এইভাবে বলতে পারবে না যে..., "তোমার হাতে মরলে,সেটা আমার পরাজয় না।"
একটা 'ফোন' যা দীর্ঘদিন বেজে ওঠে,  "কী কারণে"? "কাকে দরকার"?
জানা নেই কিন্তু কথা হয় এবং পরে বুঝতে পারে ফোনের ওপারে থাকা সে তার পরিচিত কিন্তু একসময় যখন তার প্রয়োজন ছিল সে তার হাত ছেড়েছিল আর এখন দীর্ঘদিন কথাবার্তা নেই।
জোনাকিও যে কবির ভাষায় অপয়া হয়ে যেতে পারে তা অভাবনীয় ছিল  তবু কোনো অভিযোগ নেই। এরপর নানা 'স্বীকারোক্তি' পেরিয়ে প্রার্থনা না করার দরুন অবসাদ বেড়ে যায়। একটি স্বপ্ন দেখা ছেলে যার "নুন আনতে পান্তা থাকে। শুধু সাথে লেবু জোটে না" এরকম পরিস্থিতিতেও সে স্বপ্ন দেখছে রাস্তায় বৃষ্টির জল জমে গেলে একসাথে নৌকো ছাড়বে, চারটে বিড়াল আছে যাকে সে খেতে দেবে। তার ঘরে "ঝড় উঠলে আলো যায়। আবার ভালোবাসলে আলো চলে আসে।" এবং আরশোলা দেখে ভয় পেলে বাকিটুকু হিন্দি সিনেমার মতো রান করাবে সে। অর্থাৎ সেই দরিদ্র যুবকটি তার  প্রেমিকাকে নিয়ে ঘর বাঁধার কথা লিখছে কিন্তু আদৌ জানেনা, সেই চিঠি ঠিক জায়গায় পৌঁছবে কি না।
"তবুও লেখার কাছে সবটুকু রেখে যেতে হবে" বলে লেখা এবং তার একটা আশা যে
"একলা মানুষ যদি এতদূর হেঁটে আসতে পারে, " অর্থাৎ যে  সবুজ কাঠের একটা ঘুণে খাওয়া আলমারি নিয়েও এতোটা স্বপ্ন দেখে এগিয়ে আসার কথা ভাবতে পারে সেখানে "দুখানা শরীর মিলে, তুমি বলো--মিছিল হবে না?!
তাহলে তো আমার একজন পাঠক হিসেবে মনে হয় অবশ্যই দুখানা শরীর মিলে গুটিগুটি পায়ে মিছিল নেমে আসতেই পারে। 
এবার "কোমল রাগ" পেরিয়ে এসে আমরা দেখতে পাবো একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। সেটা হলো বিচ্ছেদী এক জোড়া যাদের মধ্যে একজন যে আজ নেই অথচ সেই স্বপ্ন দেখছে তাকে তার ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকার কথা শুনিয়ে যায় বন্ধুবান্ধব, প্রেমিকার বান্ধবী এমনকি প্রেমিকার যোগার টিচার পর্যন্ত বলে যায় মেয়েটি নাকি এখন ভাত খয় না। রাত্রিবেলা হালকা স্যালাড খায়।
এমনকি সে স্বপ্ন দেখে মেয়েটি ছোটো করে চুল কেটেছে বলে পাড়ার লোকে মেয়েটিকে  "নতুন মেম এসেছে" বলে নিন্দে রটায়..
আশ্চর্য ব্যাপার হলো লেখাটি পড়লে বোঝা যাবে ছেলেটি কফিনের মধ্যে থেকে এসব কিছু স্বপ্নে দেখছে এমনকি সে দেখছে "তোমার মুঠোর থেকে একটা ভীষণ ঠান্ডা আবেশ,
এখন হঠাৎ হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে আমার হাতে।"
পরেই ছেলেটি স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছে তার প্রেমিকার ঘুম ভাঙার পর সে ঠিক বুঝতে পারবে এই ঠান্ডা আবেশ আসলে তার প্রেমিক তথা ছেলেটির কফিন যেখানে সে নিজে (মেয়েটি) পেরেক ঠুকছে। এই অদ্ভূত ভাবনা বোধহয় অভীক রায়ই লেখতে পারেন।
কবির ভাষায় প্রত্যেকদিন মিথ্যে হওয়া প্রতিশ্রুতির দরুনই সবুরে আর মেওয়া ফলে না।
কবি এ কলকাতার ফুটপাথ জুড়ে আতর ছড়াতে চায়৷ বইটি পড়ে কবির অন্ত্যমিলের কাছে  আমাদের ভালোবাসা জন্মাবে এবং ভালো বাসতে বাসতে "রঙিন হাসির নীচে ডুবে যাবে আঘাতের তরী"। কবি 'গোঁসাই-কে' ভালোবেসে বলেন " আপনাকে যাবতীয় শুশ্রূষা মেনে নিয়ে,
হাঁটু মুড়ে বসে পড়ি আমি।
যতবার চোখ থেকে জল পড়ে ভালোবেসে,
ফুটে ওঠে জয় গোস্বামী।"
এমন এক রোমাঞ্চিত কবির যে ছায়াও 'বেহায়া' হবে তা বোঝায় যায়, তাই তো তিনি বলেছেন
"তুমি যে আমার নয় তা কবেই বুঝে গেছে ছায়া।"
"তবু রোজ পিছু নেবে।ভেবে দ্যাখো, কেমন বেহায়া!"
লোকে বলে মৃত কিন্তু কবি বিশ্বাস করতে চাননা কারণ "সমস্তটা আজও অবিকৃত। স্মৃতির পাতায় ধৃত"। 
আয়নার ওপার থেকে কবি জানালেন জ্যােৎস্নার চাদর মোড়া একটা পূর্ণিমার রাত। যেখানে উলুধ্বনির সুর শোনা যাচ্ছে আর সেই সুরেই একটি মেয়ে নিঁখোজ হচ্ছে "শহর থেকে দূরে"। সে হয়তো বাকি "জীবন আস্ত কুমিরডাঙার শেষে শিখল জলের ভাষা"।
কিন্তু "কে আর এমন নির্জনতায় শব্দ এনে দেবে"
তাই "বাসন্তী রঙের স্বপ্ন আমাদেরই দেখে যেতে হবে"। 
এবার বসন্ত তার বন্ধুর দাদার চোখে মুগ্ধ হলে কিছু করার থাকে না কারণ " সব বৃক্ষেরই প্রত্যাশা থাকে জেনো,
কাঠুরের কাছে একটা ধন্যবাদের"।



যাইহোক 'রোজনামচা'-র ঘটনা পেরিয়ে ডাক্তার ঘুমানোর পরামর্শ দেন কিন্তু দিলে কি হবে কবি কি ঘুমবেন? কখনওই নয় তাই আবার কবি দিনের শেষে সরলরেখা হয়ে যান। এই রইলো 'পূর্বাভাস'।
বাকি 'সেলস টার্গেট' যা কিছু আছে তাতে "মেঘের স্বভাব দোষে" "বয়সের দায়ভারে ইদানীং ক্লান্ত দুজনে"। ব্যস্ এরপর 'সুইচড অফ' আর 'হৃদয় হাতে-গোনা'। এবার 'পাগলের অভিধান' "মৃত্যুর প্রয়োজনে ছড়িয়েছে আজীবন জুড়ে"। পরে 'আজগুবি' 'ক্ষোভ' পেরিয়ে 'ফ্যামিলি অ্যালবম'টা খুলুন।  তারপর "একাকী শালগাছ" পেরিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন "একবেলা ফোনে চার্জ ছাড়া" কীভাবে একলা লোক আরও একা হয়ে যায় যেখানে "ফোটে না ফুল" যেখানে "হাসে না কেউ"।
জ্বরের গায়ে বাড়ি ফিরে এলে মনে মনে রান্নাঘরে কেউ একটা আছে ভেবে "তার উদ্দেশ্যে বলে উঠি- 'এককাপ চা....'। শুধু চা নয় 'জ্যোৎস্নার বিনিময়' ঘটিয়ে " চোখের সামনে থেকে পরিচিত চোখগুলো হারিয়ে যাচ্ছে আর ক্রমশ নিচে নামছে জলস্তর"।  "যদিও এসব কিছুই আমার লিখে রাখার কথ নয় তবু নেহাত 'তোমার বাড়ির রাস্তাগুলো' "হৃদয়ে জমাট বেঁধে গড়ে ওঠে আঘাতের টিলা।" 
সবশেষে "দয়াহীন কথা লেগে ভেঙে যায় অতীতের ঢিবি"।
এরকমই এক আশ্চর্যময়, সত্যিকারের বই এর মতো বই পড়তে হলে পড়া দরকার "আয়নার ওপার থেকে"। একজন পুষ্ট পাঠক তৃপ্তি পাবে এটুকু বলতে পারি।  'বইচই' পাবলিশার্সের পক্ষ থেকে প্রকাশিত কবি অভীক রায়ের  দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ "আয়নার ওপার থেকে"। প্রচ্ছদটিও প্রশংসার দাবী রাখে, প্রচ্ছদ এঁকেছেন পল্লবী নন্দন। ভূমিকায় রাজ ভট্টাচার্য এক অপূর্ব কথা বলেছেন  "হাঁটো কবি, হাঁটো"। আর আমারও এমনই বক্তব্য থাকলো কবির প্রতি আর থাকলো এই দুঃসাহসিকতা আর কবির প্রতি অসম্ভব কুর্নিশ, এতো ভালো লেখা যা কিছু মনের কথা বলে, যা কিছু তীব্র সত্যি ফুটিয়ে তোলে, আর এতো সুন্দর রোমাঞ্চকর কাব্য দেখায় আর সবচেয়ে বড়ো কথা সমসাময়িকতা এবং শেয়ার পাওয়ার জন্যই লেখা এই ধারণা বদলে একটা নতুন এবং ভালো কিছু  পড়ার সুযোগ করে দেবার জন্যে। যা নিজে থেকেই সম্মান কুড়িয়ে নেয়।




রিভিউ কলমঃ- সুদীপ্ত সেন(ডট.পেন)
[FOUNDER & EX-CHIEF EDITOR OF JOLFHORING  WEB MAGAZINE ]







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন