"নিজের শব্দে কাজ করো" এই বই-এর শুরুতেই এক আহত রাতের কথা বলা আছে, সেই রাতে ছাতিমের সাদা ফুল ফোটে, রাত শজারুর শরীরের মতো রূপক হয়ে কাঁটা দেয় রাতের চাদরে।
যা আমরা একবারও খেয়াল করব না সেইসমস্ত কথায় এখানে যত্নে খেয়াল করে লেখা। যেমন, সেই রাতে অর্থাৎ "আহত রাত"-এ "ট্যাক্সি ঘুরছে" এবং "জিপিএস শোঁকে কুকুর"।
আবার কোনো দিন দ্বিতীয় "আহত রাত"-এর কথা বলতে গিয়ে কবি বললেন রাতের পোকাগুলোর এক রাতের বেঁচে থাকা থাকার কথা তথা পতঙ্গের লাইফ স্প্যান, প্যাঁচারা রাত্রেবেলা দেখতে পায় তাই হয়তো কবি বলেছেন "প্যাঁচাগুলো মোমবাতি হয়ে গেছে"।
এমন এক "দুঃস্বপ্ন"-এ "পায়ের অজস্র শব্দ তেড়ে আসে হনহন করে" যা দেখে বাড়ি যেতে চাইলেও ফিরে যাওয়া কঠিন কারণ রাত কিছুতেই ফুরোছে না। রাতেরও যে কানির্শ হয় এবং তাতে জমে থাকে আঙুলের আহ্বান, প্রেমিকাকে ছুঁতে চাওয়া তা বইটি না পড়লে জানা অসম্ভব।
দেহের রঙ বদলে যায় বাতাসের আর্দ্রতার সঙ্গে এমনই বললেন কবি, শুধু তাই নয় তিনি প্রশ্ন করেছেন "আমাকে বাঁধতে পারে এমন কোনো পারফিউম তুমি কেনো মাখোনি"?
তিনি বাস্তব কথা তুলে ধরেছেন গোটা বই জুড়ে তাই বলেছেন "যা কিছু আনন্দের তাই তো নিষিদ্ধ"।
বইটিতে রূপকের ব্যবহার এতোই চমৎকার যা পড়তে গিয়ে আপনার মনের জানলা ফুটো করে আচমকা অন্ধকার ভেজা কিছু বৃষ্টির পেরেক ঢুকে পড়বে যা আপনাকে আপনার চোখের সামনে বইতে বর্ণিত সমস্ত ঘটনা ছবির মতো ফুটিয়ে তুলবে এবং আপনি স্পষ্ট দেখতে পাবেন "দীর্ঘ বছর রাত জাগলে শরীর, মন আইনসম্মত ভাবে বাড়ে না"।
কবির প্রশ্ন এমনই মাধুর্যময়, তাই তিনি বলেছেন "রাতের রেললাইনে এতো আলো এলো কথা থেকে?"
সব চাকা গোনা যায়, দেখা যায় কেনো?"
সত্যিই'তো রাত মানে আমরা অন্ধকারকে বুঝি তাহলে রাতের রেললাইনে কেনো চাকা গোনা যাবে?
ধীরে ধীরে সব কিছু ফাঁকা হয়ে আসে, একজন ব্যর্থ মানুষ যার সমস্তটাই ফাঁকা, যার "এনার্জি মৃত ভাবনার পাহাড়ে পরিণত হয়" "তার দিনের বেলা বড্ড খিদে পায়" "আবার রাতের কথা কিচ্ছু থাকে না মনে"। এইরকমই এক চরম বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন কবি তাঁর এই বইতে।
তারপর আমরা দেখব "একটা শুকনো টেবিল থেকে রাত গড়িয়ে পড়ছে" আর "সমস্ত লোডশেডিং-এর অস্হির রাজ্যে অলৌকিক আনন্দে ছড়ায় টেনশন" অথচ টের পেলো না "খাকিদেহ পুলিশের মতো যারা বীর, শুধু সাধু ভাষাতেই যারা লড়ি চালকের কানে কানে চলে যায়, " "টের পেলো না সমস্ত বুড়োমানুষের বেডসোর"। বেডসোর-এর টের পাওয়ার কথা আমরা কখনও ভেবেছি? অথচ কবি ভেবেছেন, যা থেকে বোঝায় যায় অনুপম রায় একজন দক্ষ কবিও বটে।
তিনি বলেছেন আয়নায় আমাদের চেহারার যে দৃশ্য হয় তা কামনাহীন এমনকি কামনাহীন চেয়ে থাকাকে আমরা আসল চিত্র ভেবে ভুল করি।
অনুপম রায়ের লেখা মানেই স্বপ্নের মতো আবার বাস্তব। সেটাকে স্পর্শ করা যাবে আবার বোঝা যাবে না কিন্তু আমরা মনে মনে স্বাদ পেতে থাকব যা তাঁর গানেও ভেসে ওঠে বারবার তাই বইটির লেখার গুলির মধ্যেও এই ব্যাপাটির বিলম্ব হয়নি যেমন, "শীতের রাতে হাওয়া দেয় গির্জা দোলে"।
প্রশ্ন হলো গীর্জা কি করে দুলবে অথচ আমরা বুঝতে পারছি গীর্জার গায়ে হাওয়া লাগছে এখানে সেই কথাই বলতে চেয়েছেন কবি। ওই যে বললাম অনুপম রায়ের সৃষ্টি মানে সেটাকে স্পর্শ করা যাবে আবার বোঝা যাবে না কিন্তু আমরা মনে মনে স্বাদ পেতে থাকব।
প্রতিটি মানুষের দুঃখ রয়েছে অথচ আমরা সেই খবর নাম রেখেই এটা ভেবে বসে থাকি যে তার কোনো দুঃখ নেই এমনই এক চরম সত্যতার কথা কবি লিখেছেন " আমার কোনো দুঃখ নেই" এই কবিতায়। অনুপম রায় বললেন কবির ভাবনায় কবিতা লেখা হয় না বরং উল্টো হয়, তথা কবিতা কবিকে লেখে।
"নিজের শব্দে কাজ করো" বইতে কবি বলেছেন তিনি নাকি কেতাবের প্রথম পাতা ফাঁকা রাখতে পছন্দ করে না কারণ এই বই-এর কোনো না কোনো পাতায় লেখা শব্দ গুলো এমনকি ঘটনা গুলোও কারোর সাথে (পাঠকের) মিলে যাবে আর তখন সেই সব মানুষ(পাঠক) তার সাথে মিলে যাওয়া ঘটনার পাতা গুলো ছিঁড়ে নেবে প্রথম পাতাটা না দেখেই। তাই কবি একটা পাতাও ফাঁকা রাখতে চান না।
সবশেষে আমি বলতে পারি "নিজের শব্দে কাজ করো" অনুপম রায়ের লেখা এই বই-এর সমস্ত কথায় সত্য, সাধারণ, সহজ এবং মাধুর্যময় যা একজন সত্যিকারের পাঠককে আনন্দ দেবে এবং স্বপ্ন দেখাবে।
🖋সুদীপ্ত সেন (ডট.পেন)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন