বারাণসী ও এলাহাবাদ দর্শন
অফিসের একঘেয়েমির চাপ ও ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে হটাৎ করে ঠিক হলো বারাণসী ও এলাহাবাদ ভ্রমণ করা হবে। সেই মতো প্ল্যান বানিয়ে কলকাতা স্টেশন থেকে শব্দভেদী এক্সপ্রেসে চড়লাম এক শুক্রবার রাত 10 টা 35 মিনিটে। বারাণসী পৌছালাম পরেরদিন সকাল 10 টায়। অটো নিয়ে গেলাম 3 কিমি দূরে হোটেল জানকী ইন্টারন্যাশনাল । আগে থেকে রুম বুক করা ছিল। ফ্রেশ হয়ে অল্প খাওয়া দাওয়া করে একটা গাড়ি নিয়ে প্রথমে গেলাম কোতোয়ালিতে কালভৈরব মন্দিরে। সেখান থেকে 13 কিলোমিটার দূরে সারনাথ গেলাম। বোধগয়ায় 'বোধি' লাভের পর বুদ্ধদেব সারনাথে এসে এখানকার মৃগ উদ্যানে ধর্মীয় উপদেশ দান করেন 5 জন শিষ্যের কাছে । বৌদ্ধদের কাছে এই ঘটনা 'ধর্মচক্র প্রবর্তন' নামে খ্যাত। সারনাথ নামটা এসেছে সারঙ্গনাথ (সারঙ্গ শব্দের অর্থ মৃগ) থেকে। সারনাথের প্রবেশের পথেই বাদিকে চৌখন্ডি স্তূপকে ছোটখাটো টিলা বললেও অত্যুক্তি হায় না। সম্রাট অশোক ২৩৪ খ্রি: পূর্বাব্দে এখানে এসেছিলেন। উনি এই সুবিশাল স্তূপটি নির্মাণ করান। সারনাথের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য চোঙ্গাকৃতি সাড়ে তেতাল্লিশ মিটার উচু ধামেক স্তূপ। ভূমির কাছে এই স্তূপের ব্যাস ২৮ মিটার এবং নিচের অংশে দেখবেন গুপ্তযুগের স্থাপত্য নিদর্শন। সারনাথের অপর আকর্ষণ মহাবোধি সোসাইটি নির্মিত বুদ্ধমন্দির। এই মন্দিরে মূর্তিটি তৈরি করেন রাজা ধর্মপাল। সারনাথের সংগ্রহশালায় অসংখ্য বুদ্ধ মূর্তির সংগ্রহ বিস্ময় উদ্রেক করে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো বৌদ্ধ শিল্প ও ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো এবং অশোকস্তম্ভের শীর্ষদেশের চারটে পরস্পর সংলগ্ন সিংহমূর্তি। শুক্রবার মিউজিয়াম বন্ধ থাকে। অন্য দিন খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে ৫টা। এরপর আমরা গেলাম অন্নপূর্ণা মন্দির। পেশোয়া বাজিরাও ১৭২৫ সালে এই মন্দিরটি নির্মান করেন। এরপর লাল রঙের দূর্গা মন্দির ও কুন্ড দর্শন করলাম। মন্দিরটি অষ্টাদশ শতকের। গর্ভাগৃহে দেবীর বিগ্রহ খুব জাগ্রত। দূর্গা মন্দির থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে বাঁ হাতে পড়ে সাদা রঙের সুবিশাল তুলসী মানস মন্দির। মন্দিরে শ্রীরামের বিগ্রহ ছাড়াও আকর্ষনীয় এখানকার দেওয়াল, যেখানে খোদাই করা আছে রামচরিতমানসের বিভিন্ন পদ। এরপর গেলাম বেনারস হিন্দু বিশ্ব বিদ্যালয়। পণ্ডিত মদনমোহন মঙ্গল কাব্যের সক্রিয় উদ্যোগে গড়া বেনারস ইউনিভার্সিটি কমপ্লেক্সের মধ্যেই রয়েছে ভারত কলা ভবন নামক মিউজিয়াম এবং বিড়লাদের তেরি সুউচ্চ নব বিশ্বনাথ মন্দির। সেখান থেকে সংকোটমোচন মন্দির দর্শন করে চলে এলাম দশাশ্বমেধ ঘাট অঞ্চলে। অসাধারণ গঙ্গা আরতি দর্শন করে রাস্তায় বারাণসী স্পেশাল ডিনার করে টোটো ধরে ক্লান্ত শরীরে হোটেল ফিরলাম ।
পরেরদিন সকালে উঠে গেলাম কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিতে। প্রাচীন মন্দির ধবংস হয়ে যাবার পর বর্তমান মন্দিরটি নির্মান করেন ইন্দোরের মহারানি অহল্যাবাঈ হোলকার (১৭৭৭) সাল। পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিং প্রায় সাড়ে আটশো কেজি ওজনের সোনার পাতে মন্দিরের উপরের অংশ মুড়ে দেন। মন্দিরের মধ্যেই রয়েছে আওরঙ্গজেবের তৈরি জ্ঞানবাপী মসজিদ। 3 ঘন্টা লাইন দিয়ে দ্বাদশ জ্যোতিলিঙ্গের অন্যতম বিশ্বনাথ দর্শন হলো। এরপর কিছু খাওয়া দাওয়া করে গেলাম চুনার দুর্গ। বারাণসী থেকে ৩৫ কিমি দুরে চুনারের প্রধান আকর্ষণ গঙ্গার ধারে সুবিশাল দুর্গ। পুরানমতে বামন অবতারে ভগবান বিষ্ণু তার প্রথম চরণ স্থাপন করেন এখানকার পবিত্র ভূমিখন্ডে তাই এর নাম হয় চরনাদ্রি। উজ্জয়িনীর শাসক মহারাজা বিক্রমাদিত্যের ভাই ভতৃহরি এখানে কঠিন তপস্যা করার পর জীবন্ত সমাধি নিয়েছিলেন। চুনার দুর্গের ইতিহাসও সুপ্রাচীন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে রাজা সহদেব ১০২৯ সালে বর্তমান দুর্গটি নির্মান করেন। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর ১৫২৫ সালে এই দুর্গের অধিকার নেন। মাঝে শেরশাহের হাতে চলে যাবার পর আকবর পুনরায় দুর্গ জয় করেন ১৫৭৪ সালে। এরপর টানা প্রায় দুশো বছর মোঘলদের অধীনে থাকার পর ১৭৭২-এ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল করে ঐতিহাসিক চুনার ফোর্ট। জনশ্রুতি আছে এই দুর্গ থেকে একটি ঐতিহাসিক গোপন সুরঙ্গ পথ গঙ্গায় নেমে গেছে। বর্তমানে ভারত সরকার এখানে গড়ে তুলেছে প্যাকের (প্রভিনশিয়াল আমর্ড কোর) ট্রেনিং সেন্টার। তাই কেবলমাত্র সোনহা মন্ডপ ও ভতৃহরির সমাধি ছাড়া দুর্গের অভ্যন্তরে সাধারন পর্যটকদের প্রবেশ অধিকার নেই। দুর্গ ছাড়াও চুনারে দেখবেন হজরত সুলেমানের সমাধি ও প্রায় ২ কিমি দূরে দূর্গামন্দির ও কালীমন্দির। দুর্গের কুঁয়া টি বিশাল । এরপর গেলাম পূর্বের বারাণসীর রাজাদের দুর্গ রামনগর ফোর্ট। এখানে দেখবেন - রাজাদের ব্যবহত বিভিন্ন আমলের ঘোড়ার গাড়ি, পালকি , কারুকার্যমন্ডিত হাওদা , পোশাক পরিচ্ছদ ,অভিনব ঘড়ি , প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র।
দুর্গের একটা অংশে দেখবেন রামনগরের বিখ্যাত রামলীলার কিছু দৃশ্যের ফটোগ্রাফ। দুর্গের প্রবেশমূল্য 25 টাকা। এরপর গেলাম বারাণসী থেকে ৭০ কিমি দুরে ৫১ সতীপীঠের অন্যতম বিন্ধ্যাচলের প্রধান দ্রষ্টব্য বিন্ধ্যাবাসিনী মন্দির। এই স্থানে সতীর বাম পায়ের আঙুল পড়েছিল। পুরানমতে এই সেই স্থান যেখানে দেবী স্বহস্তে শুম্ভ নিশুম্ভকে বধ করেন। বিন্ধ্যবাসিনী মন্দির থেকে ৩ কিমি দুরে বিন্ধ্যপবর্তের ওপর দেবী অষ্টভুজা মন্দির। সংকীর্ণ গুহাপথে ভেতরে গিয়ে মূর্তি দর্শন করতে হয়। এরপর ফিরে এসে অসি ঘাট থেকে নৌকো নিয়ে দর্শন করলাম দশাশ্বমেধ ঘাট,
মনিকর্নিকা ঘাট, হরিশ্চন্দ্র ঘাট, তুলসী ঘাট,
মানমন্দির ঘাট, কেদার ঘাট প্রভৃতি। এরপর একটু কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরে ডিনার করে শুয়ে পড়লাম।।
পরেরদিন সকালে 9.40 ঘটিকায় বিভূতি এক্সপ্রেসে চেপে বারাণসী স্টেশন থেকে রওয়ানা দিয়ে 12.30 এ পৌছালাম এলাহাবাদ স্টেশনে। রিকশ করে গেলাম আমাদের গন্তব্য হোটেল কাশীতে। এরপর লাঞ্চ করে একটা গাড়ি নিয়ে চললাম শহর দর্শনে। প্রথমে গেলাম আনন্দ ভবন। নেহরুর পৈতৃক বাসভবন বর্তমানে জাতীয় সংগ্রহশালা। পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের ব্যক্তিগত ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখানে খুব সুন্দর করে সাজানো আছে। এখানে আরও দেখবেন , স্বরাজভবন ও জহর প্ল্যানেটোরিয়াম। এরপর দেখলাম এলাহাবাদ মিউজিয়াম ও চন্দ্রশেখর আজাদ গার্ডেন যেখানে উনি পিস্তলের গুলিতে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে অব্যাহতি পেতে। এরপর গেলাম ত্রিবেণী সঙ্গমে যা প্রয়াগ নামে পরিচিত। এখানে উত্তর ভারতের প্রাণদায়ী দুটি প্রধান নদী গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থলে সরস্বতী মিশেছে। ত্রিবেণীকে ঘিরে প্রতি বছর মাঘমাসে বসে মকরসংক্রান্তি মেলা। ছয় বছর অন্তর অর্ধকুম্ভ আর বারো বছর অন্তর বসে পূর্ণকুম্ভ মেলা। পিতামহ ব্রহ্মা 'প্রকৃস্ট যজ্ঞ' করে এই স্থানের নাম রাখেন 'তীর্থরাজ'। নৌকা করে সঙ্গম দর্শন ও পুজো দেওয়ার ব্যাবস্থা আছে। সঙ্গমের কাছে আকবরের তৈরি সুবিশাল এলাহাবাদ কেল্লা যার অধিক অংশ মিলিটারিদের দখলে। সামনের অংশে পাতালপুরী মন্দির ও অক্ষয়বট দেখতে পারেন। পাশেই রয়েছে হনুমান মন্দির। অভিনব মন্দিরে দেখবেন পবনপুত্র হনুমানের বেশ বড় আকারে শায়িত মূর্তি। বলা হয় বছরে একবার হলেও সঙ্গমের জল ফুলে উঠে পবনপুত্রের চরণ ধুইয়ে দেয়। এর পর গেলাম শঙ্কর বিমান মণ্ডপম। সঙ্গমের কাছে হাল আমলে তৈরি ১৩০ ফুট উঁচু চারতলা মন্দিরের বিভিন্ন তলায় দেখবেন তিরুপতি বালাজি, কমক্ষাদেবী, শিবলিঙ্গ সহ জগৎ গুরু শঙ্করা চার্যের বিগ্রহ। এরপর এলাহাবাদ হাই কোর্ট ও চার্চ দেখে চলে গেলাম খুসরুবাগ। সুসজ্জিত উদ্যানের মাঝে জাহাঙ্গিরের বড়ছেলে খুসরুর এই সমাধি সৌধ মোগল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। বেলে পাথরের এই সৌধের পাশে যুবরাজের মা শাহ বেগমকে সমাহিত করা হয়েছে। এরপর হোটেলে ফিরে ডিনার করে রাত 11.40 এ রাজধানী এক্সপ্রেসে চড়ে পরেরদিন সকাল 10 টায় হাওড়া পৌছালাম। স্বল্প সময়ের এই ট্রিপে দর্শন করলাম ইতিহাসের কিছু মনোমুগ্ধকর দলিল।।
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য:
1) জানকী হোটেলের ফোন নম্বর 8067616761. রুম ভাড়া 2000 টাকা সর্বনিম্ন।
2) হোটেল কাশীর ফোন নম্বর 5322400812. সর্বনিম্ন রুম ভাড়া 1900.এখানে লাঞ্চ ও ডিনারে 200 টাকায় নিরামিষ আনলিমিটেড থালির সুব্যবস্থা আছে।।
3) সারনাথের পবিত্র ভূমিতে একরাত কাটাতে চাইলে পাবেন পর্যটন বিভাগের-রাহী ট্যুরিস্ট বাংলো। ফোন নম্বর 5822595965 ।
4) বারাণসীতে স্বল্প দামের অনেক ধর্মশালা আছে যেখানে থাকা ও খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে।
5) ট্রেন ছাড়াও বারাণসী থেকে এলাহাবাদ যাওয়ার বাস ছাড়ে টার্মিনাস থেকে।।
6) নৌকাবিহারের জন্যে অনেক টাকা বেশি চায়। দরাদরি করা অবশ্যকর্তব্য। শেয়ারে 100 টাকা করে নৌকা ভ্রমণে নেয়। তবে ভালো করে ঘুরতে চাইলে আলাদা নৌকা ভাড়া করা ভালো।।
অফিসের একঘেয়েমির চাপ ও ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে হটাৎ করে ঠিক হলো বারাণসী ও এলাহাবাদ ভ্রমণ করা হবে। সেই মতো প্ল্যান বানিয়ে কলকাতা স্টেশন থেকে শব্দভেদী এক্সপ্রেসে চড়লাম এক শুক্রবার রাত 10 টা 35 মিনিটে। বারাণসী পৌছালাম পরেরদিন সকাল 10 টায়। অটো নিয়ে গেলাম 3 কিমি দূরে হোটেল জানকী ইন্টারন্যাশনাল । আগে থেকে রুম বুক করা ছিল। ফ্রেশ হয়ে অল্প খাওয়া দাওয়া করে একটা গাড়ি নিয়ে প্রথমে গেলাম কোতোয়ালিতে কালভৈরব মন্দিরে। সেখান থেকে 13 কিলোমিটার দূরে সারনাথ গেলাম। বোধগয়ায় 'বোধি' লাভের পর বুদ্ধদেব সারনাথে এসে এখানকার মৃগ উদ্যানে ধর্মীয় উপদেশ দান করেন 5 জন শিষ্যের কাছে । বৌদ্ধদের কাছে এই ঘটনা 'ধর্মচক্র প্রবর্তন' নামে খ্যাত। সারনাথ নামটা এসেছে সারঙ্গনাথ (সারঙ্গ শব্দের অর্থ মৃগ) থেকে। সারনাথের প্রবেশের পথেই বাদিকে চৌখন্ডি স্তূপকে ছোটখাটো টিলা বললেও অত্যুক্তি হায় না। সম্রাট অশোক ২৩৪ খ্রি: পূর্বাব্দে এখানে এসেছিলেন। উনি এই সুবিশাল স্তূপটি নির্মাণ করান। সারনাথের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য চোঙ্গাকৃতি সাড়ে তেতাল্লিশ মিটার উচু ধামেক স্তূপ। ভূমির কাছে এই স্তূপের ব্যাস ২৮ মিটার এবং নিচের অংশে দেখবেন গুপ্তযুগের স্থাপত্য নিদর্শন। সারনাথের অপর আকর্ষণ মহাবোধি সোসাইটি নির্মিত বুদ্ধমন্দির। এই মন্দিরে মূর্তিটি তৈরি করেন রাজা ধর্মপাল। সারনাথের সংগ্রহশালায় অসংখ্য বুদ্ধ মূর্তির সংগ্রহ বিস্ময় উদ্রেক করে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো বৌদ্ধ শিল্প ও ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো এবং অশোকস্তম্ভের শীর্ষদেশের চারটে পরস্পর সংলগ্ন সিংহমূর্তি। শুক্রবার মিউজিয়াম বন্ধ থাকে। অন্য দিন খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে ৫টা। এরপর আমরা গেলাম অন্নপূর্ণা মন্দির। পেশোয়া বাজিরাও ১৭২৫ সালে এই মন্দিরটি নির্মান করেন। এরপর লাল রঙের দূর্গা মন্দির ও কুন্ড দর্শন করলাম। মন্দিরটি অষ্টাদশ শতকের। গর্ভাগৃহে দেবীর বিগ্রহ খুব জাগ্রত। দূর্গা মন্দির থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে বাঁ হাতে পড়ে সাদা রঙের সুবিশাল তুলসী মানস মন্দির। মন্দিরে শ্রীরামের বিগ্রহ ছাড়াও আকর্ষনীয় এখানকার দেওয়াল, যেখানে খোদাই করা আছে রামচরিতমানসের বিভিন্ন পদ। এরপর গেলাম বেনারস হিন্দু বিশ্ব বিদ্যালয়। পণ্ডিত মদনমোহন মঙ্গল কাব্যের সক্রিয় উদ্যোগে গড়া বেনারস ইউনিভার্সিটি কমপ্লেক্সের মধ্যেই রয়েছে ভারত কলা ভবন নামক মিউজিয়াম এবং বিড়লাদের তেরি সুউচ্চ নব বিশ্বনাথ মন্দির। সেখান থেকে সংকোটমোচন মন্দির দর্শন করে চলে এলাম দশাশ্বমেধ ঘাট অঞ্চলে। অসাধারণ গঙ্গা আরতি দর্শন করে রাস্তায় বারাণসী স্পেশাল ডিনার করে টোটো ধরে ক্লান্ত শরীরে হোটেল ফিরলাম ।
পরেরদিন সকালে উঠে গেলাম কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিতে। প্রাচীন মন্দির ধবংস হয়ে যাবার পর বর্তমান মন্দিরটি নির্মান করেন ইন্দোরের মহারানি অহল্যাবাঈ হোলকার (১৭৭৭) সাল। পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিং প্রায় সাড়ে আটশো কেজি ওজনের সোনার পাতে মন্দিরের উপরের অংশ মুড়ে দেন। মন্দিরের মধ্যেই রয়েছে আওরঙ্গজেবের তৈরি জ্ঞানবাপী মসজিদ। 3 ঘন্টা লাইন দিয়ে দ্বাদশ জ্যোতিলিঙ্গের অন্যতম বিশ্বনাথ দর্শন হলো। এরপর কিছু খাওয়া দাওয়া করে গেলাম চুনার দুর্গ। বারাণসী থেকে ৩৫ কিমি দুরে চুনারের প্রধান আকর্ষণ গঙ্গার ধারে সুবিশাল দুর্গ। পুরানমতে বামন অবতারে ভগবান বিষ্ণু তার প্রথম চরণ স্থাপন করেন এখানকার পবিত্র ভূমিখন্ডে তাই এর নাম হয় চরনাদ্রি। উজ্জয়িনীর শাসক মহারাজা বিক্রমাদিত্যের ভাই ভতৃহরি এখানে কঠিন তপস্যা করার পর জীবন্ত সমাধি নিয়েছিলেন। চুনার দুর্গের ইতিহাসও সুপ্রাচীন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে রাজা সহদেব ১০২৯ সালে বর্তমান দুর্গটি নির্মান করেন। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর ১৫২৫ সালে এই দুর্গের অধিকার নেন। মাঝে শেরশাহের হাতে চলে যাবার পর আকবর পুনরায় দুর্গ জয় করেন ১৫৭৪ সালে। এরপর টানা প্রায় দুশো বছর মোঘলদের অধীনে থাকার পর ১৭৭২-এ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল করে ঐতিহাসিক চুনার ফোর্ট। জনশ্রুতি আছে এই দুর্গ থেকে একটি ঐতিহাসিক গোপন সুরঙ্গ পথ গঙ্গায় নেমে গেছে। বর্তমানে ভারত সরকার এখানে গড়ে তুলেছে প্যাকের (প্রভিনশিয়াল আমর্ড কোর) ট্রেনিং সেন্টার। তাই কেবলমাত্র সোনহা মন্ডপ ও ভতৃহরির সমাধি ছাড়া দুর্গের অভ্যন্তরে সাধারন পর্যটকদের প্রবেশ অধিকার নেই। দুর্গ ছাড়াও চুনারে দেখবেন হজরত সুলেমানের সমাধি ও প্রায় ২ কিমি দূরে দূর্গামন্দির ও কালীমন্দির। দুর্গের কুঁয়া টি বিশাল । এরপর গেলাম পূর্বের বারাণসীর রাজাদের দুর্গ রামনগর ফোর্ট। এখানে দেখবেন - রাজাদের ব্যবহত বিভিন্ন আমলের ঘোড়ার গাড়ি, পালকি , কারুকার্যমন্ডিত হাওদা , পোশাক পরিচ্ছদ ,অভিনব ঘড়ি , প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র।
দুর্গের একটা অংশে দেখবেন রামনগরের বিখ্যাত রামলীলার কিছু দৃশ্যের ফটোগ্রাফ। দুর্গের প্রবেশমূল্য 25 টাকা। এরপর গেলাম বারাণসী থেকে ৭০ কিমি দুরে ৫১ সতীপীঠের অন্যতম বিন্ধ্যাচলের প্রধান দ্রষ্টব্য বিন্ধ্যাবাসিনী মন্দির। এই স্থানে সতীর বাম পায়ের আঙুল পড়েছিল। পুরানমতে এই সেই স্থান যেখানে দেবী স্বহস্তে শুম্ভ নিশুম্ভকে বধ করেন। বিন্ধ্যবাসিনী মন্দির থেকে ৩ কিমি দুরে বিন্ধ্যপবর্তের ওপর দেবী অষ্টভুজা মন্দির। সংকীর্ণ গুহাপথে ভেতরে গিয়ে মূর্তি দর্শন করতে হয়। এরপর ফিরে এসে অসি ঘাট থেকে নৌকো নিয়ে দর্শন করলাম দশাশ্বমেধ ঘাট,
মনিকর্নিকা ঘাট, হরিশ্চন্দ্র ঘাট, তুলসী ঘাট,
মানমন্দির ঘাট, কেদার ঘাট প্রভৃতি। এরপর একটু কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরে ডিনার করে শুয়ে পড়লাম।।
পরেরদিন সকালে 9.40 ঘটিকায় বিভূতি এক্সপ্রেসে চেপে বারাণসী স্টেশন থেকে রওয়ানা দিয়ে 12.30 এ পৌছালাম এলাহাবাদ স্টেশনে। রিকশ করে গেলাম আমাদের গন্তব্য হোটেল কাশীতে। এরপর লাঞ্চ করে একটা গাড়ি নিয়ে চললাম শহর দর্শনে। প্রথমে গেলাম আনন্দ ভবন। নেহরুর পৈতৃক বাসভবন বর্তমানে জাতীয় সংগ্রহশালা। পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের ব্যক্তিগত ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখানে খুব সুন্দর করে সাজানো আছে। এখানে আরও দেখবেন , স্বরাজভবন ও জহর প্ল্যানেটোরিয়াম। এরপর দেখলাম এলাহাবাদ মিউজিয়াম ও চন্দ্রশেখর আজাদ গার্ডেন যেখানে উনি পিস্তলের গুলিতে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে অব্যাহতি পেতে। এরপর গেলাম ত্রিবেণী সঙ্গমে যা প্রয়াগ নামে পরিচিত। এখানে উত্তর ভারতের প্রাণদায়ী দুটি প্রধান নদী গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থলে সরস্বতী মিশেছে। ত্রিবেণীকে ঘিরে প্রতি বছর মাঘমাসে বসে মকরসংক্রান্তি মেলা। ছয় বছর অন্তর অর্ধকুম্ভ আর বারো বছর অন্তর বসে পূর্ণকুম্ভ মেলা। পিতামহ ব্রহ্মা 'প্রকৃস্ট যজ্ঞ' করে এই স্থানের নাম রাখেন 'তীর্থরাজ'। নৌকা করে সঙ্গম দর্শন ও পুজো দেওয়ার ব্যাবস্থা আছে। সঙ্গমের কাছে আকবরের তৈরি সুবিশাল এলাহাবাদ কেল্লা যার অধিক অংশ মিলিটারিদের দখলে। সামনের অংশে পাতালপুরী মন্দির ও অক্ষয়বট দেখতে পারেন। পাশেই রয়েছে হনুমান মন্দির। অভিনব মন্দিরে দেখবেন পবনপুত্র হনুমানের বেশ বড় আকারে শায়িত মূর্তি। বলা হয় বছরে একবার হলেও সঙ্গমের জল ফুলে উঠে পবনপুত্রের চরণ ধুইয়ে দেয়। এর পর গেলাম শঙ্কর বিমান মণ্ডপম। সঙ্গমের কাছে হাল আমলে তৈরি ১৩০ ফুট উঁচু চারতলা মন্দিরের বিভিন্ন তলায় দেখবেন তিরুপতি বালাজি, কমক্ষাদেবী, শিবলিঙ্গ সহ জগৎ গুরু শঙ্করা চার্যের বিগ্রহ। এরপর এলাহাবাদ হাই কোর্ট ও চার্চ দেখে চলে গেলাম খুসরুবাগ। সুসজ্জিত উদ্যানের মাঝে জাহাঙ্গিরের বড়ছেলে খুসরুর এই সমাধি সৌধ মোগল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। বেলে পাথরের এই সৌধের পাশে যুবরাজের মা শাহ বেগমকে সমাহিত করা হয়েছে। এরপর হোটেলে ফিরে ডিনার করে রাত 11.40 এ রাজধানী এক্সপ্রেসে চড়ে পরেরদিন সকাল 10 টায় হাওড়া পৌছালাম। স্বল্প সময়ের এই ট্রিপে দর্শন করলাম ইতিহাসের কিছু মনোমুগ্ধকর দলিল।।
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য:
1) জানকী হোটেলের ফোন নম্বর 8067616761. রুম ভাড়া 2000 টাকা সর্বনিম্ন।
2) হোটেল কাশীর ফোন নম্বর 5322400812. সর্বনিম্ন রুম ভাড়া 1900.এখানে লাঞ্চ ও ডিনারে 200 টাকায় নিরামিষ আনলিমিটেড থালির সুব্যবস্থা আছে।।
3) সারনাথের পবিত্র ভূমিতে একরাত কাটাতে চাইলে পাবেন পর্যটন বিভাগের-রাহী ট্যুরিস্ট বাংলো। ফোন নম্বর 5822595965 ।
4) বারাণসীতে স্বল্প দামের অনেক ধর্মশালা আছে যেখানে থাকা ও খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে।
5) ট্রেন ছাড়াও বারাণসী থেকে এলাহাবাদ যাওয়ার বাস ছাড়ে টার্মিনাস থেকে।।
6) নৌকাবিহারের জন্যে অনেক টাকা বেশি চায়। দরাদরি করা অবশ্যকর্তব্য। শেয়ারে 100 টাকা করে নৌকা ভ্রমণে নেয়। তবে ভালো করে ঘুরতে চাইলে আলাদা নৌকা ভাড়া করা ভালো।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন