ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০২৫

Dibyendu Haldar: আমার সিদ্ধান্তর চেয়েও মুখ্য হয়ে উঠেছিল আর্থিক অনটন


Dibyendu Haldar: ‘আমারও তো মন ভাঙে, চোখে জল আসে আর অভিমান আমারও তো হয়।’

অনুপম রায়ের গানের এই সত্যিকথাগুলো যে শুধুমাত্র ‘আমার জন্যই’ প্রযোজ্য, একথা বলা ভুল হবে। বরং বলা যায় ‘আমার জন্যও’ প্রযোজ্য।

কেন? সেকথার উত্তরে আরেকটা গানের লাইন উঠে আসুক―'আমাকে আমার মতো থাকতে দাও'।

এখানে যদিও আমি অনুপম রায় নয়, আমারই আমার মতো থাকার কথা বলব। তালের রসের মতো গেঁজিয়ে বলব না। আমার কল্পনায়, অনুভূতিতে মিশে থাকা সত্যি কথা বলব। আসলে কি সত্যি বলে সত্যিই কিছু নেই?

অনেককাল আগের কথা। বাড়ি লাগোয়া আমের বাগান ছিল আমাদের। আরও বেশ কিছু গাছ ছিল। ঝড় বৃষ্টিতে যৌথ পরিবারের সকলে হইহই করে আম কুড়াতাম। বেশিরভাগ ব্যাপারটা ঘটত সন্ধেতে। তখন মা, জেঠিরা ছোটকরে হলেও ঘোমটা টানতে ভুলে যেত জেঠুদের সামনে। সে এক অদ্ভুত স্বাধীনতা ছিল, যা কাউকে কখনও চেয়ে নিতে হয়নি। আবার কেউ বাধাও দিত না। কেউ বলত না, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।

শুনেছি জেঠুর মেয়ের কোল থেকে নাকি একবার গরম উনুনে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম! খুব ছোট ছিলাম কিনা। দেড় কিলোর কম। বড়মামা ভয় করত, এ ছেলে টিকবে কিনা!

অন্নপ্রাশনের দিন আকাশ কালো করে মেঘ উঠেছিল। বাড়িভর্তি লোকজন, এত আয়োজন সব পণ্ড হবে! বড়পিসি কী একটা মানত করেছিল। মেঘ কেটে গেছিল। মেঘ বাবাজীবনেরও তার মতো করে থাকার সাধ্য ছিল কই? পরে অবশ্য শোধ তুলে নিয়েছিল। বড়পিসিকে বুদ্ধি পরে আর দেখিনি।

আমার হামাগুড়ি দেবার বয়স পেরিয়ে যখন সামান্য এদিক ওদিক যেতাম, কেউ বাধা দেয়নি। মনে আছে, মাটি খেতাম, বকুনি খেতাম। ভাত তরকারি যে খাইনি তেমন নয়, তবুও শরীরটা মাটিতে মিশে যাবার মতো করেই বেড়ে উঠতে লাগল। আমি আমার মতো করে থাকার আগেই ভাই এল। ভাই বা বোন আসবে একথা শুনেই আমি ভাই চাইতাম। মেলা থেকে দুটো ভাইয়ের ছবি পোস্টার কিনে এনেছিলাম। একটা দরজায়, একটা দেওয়ালে। ভাইয়ের বয়স এখন প্রায় তেইশ। আমাদের মাটির দেওয়ালে ওই ছবি এখনও সাঁটা আছে।

ক্লাস ফোরে যখন বন্ধু পাপাই মানির সঙ্গে মিলে একটা ছড়া লিখলাম, সেদিনও টুটুল স্যার ফিসফিসিয়ে কথা বলার দরুন নিলডাউন করিয়ে দিয়েছিল। আমার মতো করে লেখা শুরু করার সেই প্রথম শাস্তি। তারপর থেকে মেয়াদ বেড়েই চলেছে।

ক্লাস ফাইভে উঠে ফুলপ্যান্টে হাইস্কুলে যেতাম। হাইটে অনেকের চেয়ে ছোট, সামনের দিকে বসতাম। সে কী ভীষণ চেহারার সব বন্ধু আমার! হলঘরে মঞ্চের নীচে ঢুকবার জায়গা ছিল। একটা ছেলে আমাকে ওর মধ্যে জোর করে অনেকক্ষণ ঢুকিয়ে রেখেছিল। আমি আমার মতো ছিলাম? বাবার সাইকেলে চেপে কল্যাণ স্যারের কাছে পড়তে যেতাম। কল্যাণ স্যার আমার রামকৃষ্ণ সারদা বিদ্যামন্দিরের স্যার ছিল। কিন্তু হাইস্কুলে উঠেও তার কাছেই পড়তে যেতে হতো। যদিও বাড়িতে আলাদাভাবে আমি দাদা দিদিরা পড়তাম রামকৃষ্ণ স্যারের কাছে।

যাইহোক, কল্যাণ স্যারের কাছে সিনিয়র জুনিয়র মিলিয়ে পড়া। বড়রা আমায় বেশ রাগাত। পড়তে যেতে চাইতাম না। বাবা এক টাকা করে দিত সাইকেল থেকে নামিয়ে দিয়ে। তবুও ওখানে পড়া ছেড়ে দিলাম। সেবছর বাবাও চলে গেল। আর আমাদের যৌথ পরিবারের ভাঙনও ওই শুরু হল। আমাকে বলা হল রাস্তার ছেলে।

রাস্তার নাকি ঘরের নাকি আমি শুধুই আমার তার জবাব দেবার বয়স তখন ছিল না। গায়ে জ্বর ছিল বলে বাবার মুখাগ্নি করতে দেওয়া হল না। ছোটমামা একটা আপেল কিনে দিয়েছিল। খেয়েছিলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও।

আমি ডানপিটে ছিলাম। মারপিট, গালিগালাজ এগুলোর মাঝে বেড়ে উঠছিলাম। কিন্তু ঘুরিয়ে কেউ মারার বদলে বলত, ওকে মারিস না, ওর বাবা নেই। আমাকে আমার মতো থাকতে দেবে বলে বন্ধুরা প্রায় সকলেই করুণা করত।

তারপর থেকে দীর্ঘ সময় আমি আমার মতো করেই থেকেছি।

টিউশনি পড়তে গিয়ে একই ঘটনা ঘটছে হায়ার সেকেন্ডারিতেও। পড়াশোনা আমি ছাড়িনি। কিন্তু একপেশে অঘোষিত র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়েছি একথা বলতেই হবে। প্রভাব পড়েছে রেজাল্টেও। আমার পারিপার্শ্বিক জগৎ, আমার কবিতা চেতনা সমস্ত কিছুর ওপর। আমার নিজের মতো করে থাকার মানেগুলোও এর সাথে সাথে পাল্টে চলেছে।

কলেজে অনার্স পড়ব নাকি জেনারেল পড়ব সে নিয়ে আমার সিদ্ধান্তর চেয়েও মুখ্য হয়ে উঠেছিল আর্থিক অনটন। যাতে খরচ কম, তাই নিয়ে পড়া ভালো এবং জীবনের ভুলভাল রাস্তা বাতলে দেওয়ার লোকজন জুটতে থাকল আমার আর মায়ের আশেপাশে। আমি আর মা কেউই আজীবন আমাদের মতো করে থাকতে পারলাম না।

আমি গিয়ে উঠলাম মাসির বাড়ি। একবছর না গড়াতেই টিউশন ফি বাকি পড়ে গেল। আমার মতো করে রোজগারের সেই শুরু। ফিরলাম বাড়িতে। নিজে পড়াই, তাই দিয়ে পড়ি। চোখে জল আসে, অভিমান হয় বড়দের উপর। আমাকে আমার মতো পড়তে দাও―বলতে পারিনি আজও।

কর্মজীবনে কী করব তাও ঠিক করে দিতে লাগল কাছের মানুষেরা। সরকারি বিস্তর পরীক্ষা দিই, কয়েকটা পাশও করি। কিন্তু হয় না। এইবার কিন্তু কারোর কথা শুনলাম না। যেটুকু লেখালেখি, সম্পাদনার পুঁজি ছিল তাই নিয়ে ইন্টারভিউ দিলাম পত্রভারতীতে। হয়েও গেল চাকরিটা। আমি আমার মতো থাকব বলে চলে এলাম কলকাতা।

এইবার লড়াই শুরু অন্যরকম। মেসবাড়ি। বিছানায় আমি আর পাশবালিশ। একজন আরেকজনের পিঠে না উঠলে ধরে না। এখানেও তালাবন্ধ রইলাম রুমমেটের কৃপায়। মেসমালিকের এক্সট্রা চাবি বাঁচিয়ে দিল। কিন্তু আমি তারমধ্যেও থাকতে পারলাম কই! এত মানুষের সঙ্গে লড়াই করলাম। হারিয়ে দিল ছারপোকার গুপ্তদল। সে গল্প অন্যসময় হবে।

চলে এলাম অফিসলাগোয়া একটা ঘরে। এখন অফিসই বাড়ি, বাড়িই অফিস। আর রাতদিন আমাকে আমার মতো পড়তে দাও। আমাকে আমার মতো কাটতে দাও―গল্প, উপন্যাস এ বি সি...এম এন ও। কিন্তু আমি আমার মতো থাকতে পারলাম কি? এই প্রশ্ন এখনও মনে জাগে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন