নিজের লেখা কবিতা, নিবন্ধ, গল্প পাঠান হোয়াটসঅ্যাপ করে 7384324180 এই নম্বরে

সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

হা রে আমার স্বাধীনতা - কলমে সোমা নায়ক


আমার অক্ষমতার মুখে এক মুঠো আগুন দিও তুমি 

হয় জ্বলতে জ্বলতে পুড়ে মরবো নয়তো মশাল হয়ে পথ দেখাব

তবু হাল ছাড়বো না কখনো 

যে এমন কথা বলতো হাজারবার

সেই মেয়েটার মুখাগ্নি হয়েছে 

গুণে গুণে আজ থেকে ঠিক ১৩ দিন আগে

কোলের শিশুটা তার কন্যা সন্তান, 

বিবর্ণ মুখে উজ্জ্বল দুই চোখ, 

খিদেয় তেষ্টায় প্রায় সারাদিন সারারাত সে কাঁদে।

এই ছিল তার অপরাধ।


মা এবং মেয়ে দুজনেই সমান অপরাধে অপরাধী।


হসপিটালের বেডে শুয়ে সদ্য মা হওয়া সেই মেয়েটিই একদিন তার স্বামীকে বলেছিল, তুমি বাবা হয়েছো আর আমি, মা। 

আমাদের সন্তান পৃথিবীর আলো দেখলো আজ। তুমি খুশি? তুমি খুশি তো?


বাবা নিরুত্তর। স্ত্রীর হাতটা নিজের হাতে ধরে শুধু বলেছিল, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরো, তোমাকে ছাড়া আমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে।


আমায় ছাড়া সংসার একেবারে অচল, এই ভেবে মেয়েটা সেদিন খুব খুশি হয়েছিল।


তাই, ছয় দিনের মাথায় বাড়ি ফিরে কোলের সন্তানকে বিছানায় রেখে ঢুকতে হয়েছিল রান্নাঘরে।


 কর্তার অফিসের ভাত, ননদের কলেজের নিত্য নতুন টিফিন, শাশুড়ির পুজোর ফুল, বাতের ব্যথায় গরম তেলের মালিশ থেকে শ্বশুরের জীবনে কঠিন নিয়মানুবর্তিতা সবকিছুই ঘড়ির কাঁটা ধরে একদম হিসেব মতো চলতো।


এ কেমন সাজ ধরে থাকো সারাদিন! অফিসের ওই গো গাধা খাটুনির পর দিনের শেষে বাড়ি ফিরে এমন ঝিয়ের মত মুখ দেখলে ঘরে আসার ইচ্ছেটাই যে চলে যায়। একটু আধটু সেজেগুজেও তো থাকতে পারো।


আর তোমার এই মেয়েটাকে একটু শান্তশিষ্ট বানাতে পার না।  সারা দিনরাত খালি কান্না আর কান্না, অসহ্য একেবারে....


 প্রিয় মানুষটার মুখে এমন কথা শুনে মেয়েটা প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিল তারপর কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তাকিয়ে ছিল নিজের স্বামীর দিকে।


 আস্তে আস্তে কেটে কেটে শান্ত স্বরে বলেছিল, সময় কোথায় আমার! মেয়েটাকে একটু খাওয়ানোরই সময় তো পাই না! সারাদিন এত কাজ, আমি যে আর পারি না গো...  অন্তত একটা ঠিকে কাজের লোক


ওখানেই থেমে যেতে হয়েছিল। কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই গালে এসে পড়েছিল একটা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। 


আর কাজের লোকের পয়সা কে দেবে? তোর বাপ? নাকি তুই? হাজারে লাখে কামাচ্ছিস বুঝি আজকাল?


চেনা মানুষটা কেমন নিমেষেই যেন অচেনা হয়ে উঠেছিল সেদিন। 


সেই শুরু। অশ্রাব্য গালিগালাজ এর সাথে অকথ্য শারীরিক অত্যাচার।


কলেজ ক্যাম্পাসে যে মেয়েটা একদিন আগুন ঝরানো বক্তৃতা দিত, যার মুখের কথায় উৎসাহিত হয়ে আশেপাশের মানুষের রক্ত গরম হয়ে উঠতো সমাজ বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতো, সেই মেয়েটি কেমন নীরব হয়ে গেল, বোবা হয়ে যেতে লাগলো। দিনরাত মানুষের অত্যাচার সয়েও সে প্রতিবাদী হতে ভুলে গেল


কিন্তু কেন? কেন এই নীরবতা?


ভালোবাসা!


 এই ভালোবাসাই তাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চিত। কিন্তু হলো কোথায়।


মা শিখিয়েছিল, বোবার কোন শত্রু নেই।

বাবা শিখিয়েছিল, মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে একটু একটু মানিয়ে নিতে হয়। 

ভাই বলেছিল, আমার সংসারই আমি ঠিক মতো সামলে উঠতে পারি না, তোর দায় নেব কিভাবে। যত্তসব উটকো ঝামেলা।


যে মেয়েটা নিজের চেষ্টায়, পরিশ্রমে একদিন কলেজে ভর্তি হয়েছিল শুধু নিজের ইচ্ছে বা স্বপ্নকে প্রাধান্য দিয়ে অথচ আজকাল সে নিজের ইচ্ছেতে দুগাল ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না। শরীর খারাপ হলে ডাক্তার দেখাতে পারেনা এমনকি নিজের কোনো সখ আহ্লাদ কোন কালে ছিল বলে আজ আর তার মনেও পড়ে না তবু সে স্বপ্ন দেখে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। 

কিন্তু হলো কোথায়!


মেয়ের ৬ বছরের জন্মদিনে বড্ড শখ করে বানানো একটু পায়েস আর দোকানে অর্ডার দিয়ে বানানো একটা কেকের সাথে মেয়ের জন্য নতুন একটা জামা কিনে আনা ... কয়েকটা লাল নীল গোলাপী বেলুনের সাথে মোমবাতি। রান্না ঘরের ছুরিটা রাখা ছিল পাশে। সমস্ত ব্যবস্থাটা সে কাউকে কিছু না জানিয়ে একা একাই করেছিল, বাড়ির সবাইকে সারপ্রাইজ দেবে বলে।


 এই ছিল তার দোষ। কাউকে কিছু না জানিয়ে কেন এত কিছু করা? আর এত টাকাই বা এলো কোথা থেকে? নিশ্চয়ই স্বামীর পকেট কাটে, নিশ্চয়ই ওর কাছে আরও টাকা আছে। 


কেড়ে নাও সুখ, ছিনিয়ে নাও স্বাধীনতা, মেয়ে মানুষের এত বাড়াবাড়ি কিসের!


সহ্যেরও তো একটা সীমা থাকে। মেয়েটারও হয়তো সেদিন সহ্যের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গেছিল। হয়তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিল তার। 


তাই কেকের উপর রাখা জ্বলন্ত মোমবাতিটা যখন মেয়েটার মুখে ছুঁড়ে দিয়েছিল তার ঠাকুমা, মা হয়ে আর সে চুপ থাকতে পারেনি। ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল তার শাশুড়িকে। 


এ যে অপরাধের সাথে সাথে চরম অপমানও বটে!


তাই মায়ের অপমানের বদলা নিতে মায়ের ছেলে পাশেই পড়ে থাকা ছুরিটা নিয়ে এক লহমায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল ভালবেসে বিয়ে করা বউয়ের পেটে, নিজের সন্তানের মায়ের পেটে, কি নিষ্ঠুর ভাবে।


মেয়েটা আর কাঁদে না, শুধু ফ্যালফ্যালিয়ে তাকায়। দেখে, ঘরভর্তি লোকজনের মাঝখানে, বাবা, দাদু, ঠাম্মা এমনকি পিসি পর্যন্ত কেমন হঠাৎ হঠাৎ কেঁদে উঠছে। 

এই কান্না শুনতে তার একদম ভালো লাগে না। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ঘরে ‌কোনায় সাজিয়ে রাখা মায়ের ছবিটার কাছে। হাঁটু মুড়ে বসে, একমনে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে আর হাসে। কখনো মুচকি মুচকি আবার কখনো খিলখিলিয়ে। 


সে আর কাঁদে না, এখন সে কেবল হাসে, সারাক্ষণ শুধু হাসে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন