ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০




প্রবন্ধ বিভাগ

একুশ শতকে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা






*****
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামটির বিশালতা বা ব্যপকতা নিয়ে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সন্তান হলেও, তিনি নিজেকে শুধুমাত্র সেখানেই আবদ্ধ করে রাখেননি। সমগ্র ভারতবর্ষ এমনকি সারা পৃথিবী ওনাকে এক ডাকে চেনে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়।

ওনার প্রাসঙ্গিকতা শুধুমাত্র উনিশ, কুড়ি বা একুশ শতকে নয়.... যতদিন পৃথিবীর বুকে বাঙালী থাকবে, রবীন্দ্রনাথ নামের সূর্যও চির আলোকিত হয়ে থাকবে। ওনার লেখার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে, উনি নিজেও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তাই তো লিখেছিলেন----
"আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহল ভরে--"
সত্যিই তাই ওনাকে নিয়ে কৌতূহলের কোনো সীমা নেই আমাদের। ওনাকে জানা, খোঁজার কোনো শেষও নেই। জীবনের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে উনি নেই। এমন কোনো অনুভূতি নেই যেটা নিয়ে উনি বলেন নি। জনজীবন, সমাজ,শিক্ষা, সংস্কৃতি, দর্শন আরও অনেক বিষয়ে উনি ওনার মহামূল্যবান মতামত প্রকাশ করেছেন, যা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রেম, প্রকৃতি, বাস্তব, আধ্যাত্মিক সব ক্ষেত্রেই ওনার কৃতিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট।
সৃজনশীলতা, আচার-বিচার এবং মননে তিনি ছিলেন চিরআধুনিক। ওনার উন্নত চিন্তাধারার যে বীজ শান্তিনিকেতনে বপন করেছিলেন, তা আজও সমুজ্জ্বল। ওনার ভাবধারা, ওনার আদর্শ লক্ষ, কোটি হৃদয়ে আজও প্রজ্জ্বলিত।

যতই দিন যাচ্ছে ততই তাঁর রচনার নান্দনিক, দার্শনিক, কাঠামোগত, আন্তঃসাংস্কৃতিক, পারিবেশিক এবং একবিশ্বকেন্দ্রিক মানবতাবাদী চেতনার উত্তরোত্তর পুনর্বীক্ষণ ও পুনর্মূল্যায়ন হয়ে চলেছে। কেবল তার প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের গবেষক সম্প্রদায় কিংবা তাঁর স্বপ্নাশ্রিত জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের গবেষক ও সংগীতশিল্পীরাই নয়, সারা বিশ্বের মানব কল্যাণকামী সারস্বত সমাজ তাঁর রচনার পাঠ, পুনর্পাঠ, বিশ্লেষণ, নবায়ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাকে নব আঙ্গিকে উপস্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ফলে বিংশ শতাব্দীর এই নান্দনিক কূটাভাস একবিংশ শতাব্দীর শিল্পস্রষ্টা ও ভোক্তার কাছে এক নবায়িত অবয়ব নিয়ে হাজির হচ্ছে।পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তিনি ক্রমাগত নন্দিত, পঠিত ও বিবেচিত হওয়ার কারণে তাঁর উপস্থিতি সর্বত্রই অনিবার্য হয়ে উঠেছে। দেশে দেশে রবীন্দ্রনাথের এই কালোত্তর উপস্থিতিই একবিংশ শতাব্দীতে তাঁর প্রাসঙ্গিকতার অন্যতম নিয়ন্ত্রক।

স্বীকার্য যে, উত্তরকালে রবীন্দ্র প্রাসঙ্গিকতার ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে একটি কবিতার কথা বিশেষভাবে এসে পড়ে। তিনি তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের জন্য কিছু সহজ সরল অথচ সুষ্পষ্ট বার্তা রেখে গেছেন। এই বার্তাগুলোর একটি হচ্ছে সনাতনকে গ্রহণ বা বর্জন করার ক্ষেত্রে নবীন প্রজন্মের মনোবীক্ষণ।  একশত বছর আগের যৌবনের সৃষ্টিশীলতা আর একশত বছর পরের যৌবনের সৃষ্টিশীলতায় প্রাকরণিক প্রভেদ থাকলেও প্রেরণাগত প্রভেদ তেমন ধর্তব্য নয়। সৃষ্টিশীলতার জন্য তিনি চঞ্চলতার কথা বলেছিলেন, পুলকরাশির কথা বলেছিলেন আর তার সৃষ্টিকে নিখিলের মর্মে আঘাত করতে পারার শক্তির কথা বলেছিলেন। শতবর্ষের ব্যবধানে বসন্ত গানে প্রভেদ থাকবেই, আর থাকবে তার নির্মাণ-কুশলতায় দূরত্ব। এটি কালিক অগ্রগমণে সৃষ্টিশীলতার নবায়ন। একুশ শতকের কবির প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই বার্তাও সবিশেষ প্রাসঙ্গিক।

ওনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে , বুদ্ধদেব বসুর স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে, যত দিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থাকবে, রবীন্দ্রনাথ পঠিত হবেন তত দিন, তাঁর প্রাসঙ্গিকতাও থাকবে—মাত্রার তারতম্যভেদে৷

এককথায় বলতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাণে মিশে গেছেন।উনি আমাদের অনুভূতিতে, আবেগে জড়িয়ে আছেন। উনি স্বমহিমায়, যুগ-যুগান্তর ধরে রয়ে যাবেন আমাদের হৃদ-মাঝারে।
*****
পাপিয়া মণ্ডল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন