ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০

খুনের দাগ
             সায়ন মণ্ডল




আমরা গ্রীষ্মকালের রাতে ছাদে বসে বন্ধুরা মিলে গল্প করছিলাম সময়টা ছিল ২০১৫ সাল রাত্রি প্রায় দশটা নাগাদ । তখনও ইন্দ্রজিৎ দা এসে পৌঁছায়নি । আমরা খুনিদের নিয়ে আলোচনা করছিলাম - কিভাবে বড় বড় খুন হয়েছে ? কি কারণে তারা খুন করেছে ? এইসব ব্যাপারে । কিছুটা গল্প হতে হতেই ইন্দ্রজিৎ  দার প্রবেশ , হাতে সিগারেট টানতে টানতে ডুকছে।

ইন্দ্রজিৎ দা বলে উঠলো “কিরে কি গল্প করছিস?”

আমরা বলে উঠলাম “এই খুনিদের নিয়ে আলোচনা  করছি কত বড় বড় খুন হচ্ছে" ।

ইন্দ্রজিৎ দা বলে উঠলো “ভালো ভালো হাওয়া খেতে খেতে এইসব বিষয়ে আলোচনা।”

আমাদের অনেকক্ষণ গল্প হবার পর আমরা ইন্দ্রজিৎ দা কে বললাম - “দাদা তোমার লাইফে কোনো খুন দেখনি । যেহেতু তুমি বেসরকারি ডিটেকটিভ ছিলে শুনেছিলাম।”

ইন্দ্রজিৎ দা বলল “হ্যাঁ আমি প্রথমে সঞ্জয় বাবুর কাছে অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলাম তারপর আমি বেসরকারি ডিটেকটিভ হলাম।”

ইন্দ্রজিত দা ঘটনা বলতে শুরু করল তা আমরা মন দিয়ে শুনতে থাকলাম ।

ইন্দ্রজিৎ দা বলছে-
সালটা ১৯৮৯ নাগাদ, সেদিন আমি ঘরে বসে চা সিগারেট খেতে খেতে গল্পের বই পড়ছিলাম। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক। আমি যখনই দরজাটা খুললাম। একটি ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে , আপনার নাম ইন্দ্রজিৎ মন্ডল?

আমি বলে উঠলাম -“হ্যাঁ আমি ইন্দ্রজিৎ মন্ডল। তা আপনাকে কি একটু জল দেব।"

ছেলেটি বলল হ্যাঁ দিন।

জল পান করার পর ছেলেটি বলে উঠলো “আমার নাম অয়ন মুখার্জি, এখন আমি  ব্যবসা করি। আমার খুব বিপদ আমাকে বাঁচান।”

আমি বললাম কি হয়েছে আপনি আমাকে খুলে বলুন।

ছেলেটি বলল দুদিন আগে আমাকে একটি চিঠির মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

আমি বললাম তা আপনি চিঠিটা এনেছেন ।
ছেলেটি চিঠিটা আমায়় দিল। আমি চিঠিটা হাতে নেওয়ার পর পড়লাম  , তাতে লেখা আছে - তুমি তার জীবন থেকে সরে যাও, নাহলে তোমার কপালে দুর্গতি আছে... ইতি তোমার দ্বিষৎ ।।

ছেলেটি আবার বলে উঠলো - আপনি আমায় বাঁচাতে পারেন , দয়া করে আমাকে বাঁচান।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলা , আপনি কাকে সন্দেহ করছেন?

সে বলল “আমি বুঝতে পারছি না এটা কার কাজ। কিন্তু একজনের আমার উপর রাগ আছে ।”

আমি বললাম “একটু খুলে সবটা বলুন , যাতে আমি সমস্যার সমাধান করতে পারি।”

সে ঘটনাটা আমায়় খুলে বলতে থাকলো। সে বলল.....
সে বিগত এক বছর ধরে একটা মেয়েকে ভালবাসে । সেই মেয়েটার আগে একটা প্রেমিক ছিল। সেই ছেলেটা আমার বন্ধু। সে জানতো না যে আগে ওদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিল।

আমি একটি ছোট গোল্ড ফ্লেক সিগারেট ধরালাম এবং জিজ্ঞেস করলাম - তা আপনার ওই বন্ধুর নাম কি? আর আপনার প্রেমিকার নাম কি?

সে বলল তার বন্ধুর নাম কৌশিক সরকার, আর তার প্রেমিকার নাম পূজা দাস।

আমি তাকে বললাম, ঠিক আছে আপনার কাছ থেকে আমি শুনলাম। আমার দ্বারা আপনাকে যতটা সাহায্য করা যেতে পারে তা আমি সবটাই করব।

ছেলেটি চলে গেল।

তারপরের দিন আমি কৌশিক সরকার এর ঠিকানা জোগাড় করে তার বাড়ি গেলাম।

কৌশিক সরকার দরজা খুললো । সে জিজ্ঞেস করল আপনি কাকে খুজছেন?

দরজা খোলা মাত্র আমি দেখলাম কৌশিক বাবু  গোছা গুুছি করছেন, কোথাও যাবার জন্য। আমি উত্তর দিলাম- নমস্কার আমি ইন্দ্রজিৎ মন্ডল , বেসরকারি ডিটেকটিভ ।

আমাকে ভেতরে ডাকলেন এবং সে বলে উঠলো , তা হঠাৎ আমার বাড়িতে।

আমি বললাম, আমাকে অয়ন মুখার্জি আপনার নাম বললেন ।

ছেলেটি রেগে বলে উঠলো - হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ওকে চিনি ।

আমি বললাম, অয়ন মুখার্জি গতকাল  আমার কাছে এসেছিলেন , তা উনার জীবন খুব সংশয়। তাকে চিঠির মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

কৌশিক সরকার বলে উঠলো , “তাতে আমি কি করতে পারি? তাছাড়া আপনি আমাকে এই কথা বলছেন কেন? আমি তো নিশ্চয়ই চিঠি দিয়ে হুুমকি দিইনি।”

আমি বুঝতে পারলাম কৌশিক সরকার, অয়ন মুখার্জির উপর রেগে আছেন। আমি তাকে ঠান্ডা মাথায় বলি, সে আপনাকে দোষ দিচ্ছে না। উনি আমার কাছে সাহায্য চেয়েছেন। উনি বললেন যে পূজা দাস নামক মেয়েটি হলো  প্রেমিকা । আর তার আগে পূজা দাস এর সাথে আপনার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। তা যদি আপনি বিষয়টা খুলে বলেন তাহলে আমার খুব ভালো হয় তাকে সাহায্য করতে সুবিধা হবে।

কৌশিক সরকার মদ নিয়ে এলেন, এবং আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি পান করব কিনা।

আমি বললাম - মাফ করবেন আমি ঐসব খাই না।

কৌশিক বাবু এক চুমুক দেওয়ার পর বলতে শুরু করলেন।

কৌশিক বাবুু তখন কলেজে পড়েন। তখন পূজা দাস নামের একটি মেয়েকে তার খুব ভালো লাগতো। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক হয়। তাাদের সম্পর্ক দু'বছর ভালোই চলে। বলা যেতে পারে তারা প্রায়ই ঘুরতে যেতো। তারা বেশ মজাতেই দিন কাটাচ্ছিলেন। ২৮শে জানুয়ারী কৌশিক বাবুর জন্মদিন ছিল। সেই দিন তার বাড়িতে তার বন্ধুদের ও তার প্রেমিকাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। যথাযথ সময়মতো সকলেই এসেছিল। কৌশিক বাবু কাছের বন্ধু  অয়ন মুখার্জির সাথে তার প্রেমিকার পরিচয় করিয়ে দেয়। কিছুদিন পর থেকে দেখা যায় কৌশিক বাবুর প্রেমিকা আগের মত কৌশিক বাবুকে ঠিকমতো সময় দেয় না। আবার অন্যদিকে কৌশিক বাবুর কাছের বন্ধু তার সাথে ঝামেলা করে কথা বন্ধ করে দেয়। এতে কৌশিক বাবু সন্দেহ হয়। একদিন কৌশিক বাবু চোখে পড়ে যে তার কাছের বন্ধু ও তার প্রেমিকা একসাথে ঘুরতে বেরিয়েছে। তা কৌশিক বাবু যখন পরে তার প্রেমিকা কেই ঘটনাটা বলে তখন তার প্রেমিকা রেগে গিয়ে বলে তার সাথে সে সম্পর্ক রাখতে পারবে না। তারপর থেকে কৌশিক বাবু তাদের প্রতি খুবই রেগে , যে তিনি সুযোগ পেলে অয়ন মুখার্জি কে খুন করতে পারে এবং তারপর থেকে সে প্রতিদিন মদ্যপান করেন। কৌশিক বাবু তারপর থেকে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখে নি। আর সেই  সময়ে সে শিক্ষক কাজে যুক্ত হয়েছিলেন তাই ব্যস্ত বলে এর বেশি কিছু জানেন না তাদের অবস্থা।

শেষে আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ওখান থেকে উঠে চলে এলাম।

কৌশিক বাবুুর বাড়ি যাবার কিছুদিন পর আমি পূজা দাস এর বাড়ির খোঁজ করলাম এবং তার বাড়ি গিয়ে পৌঁছালাম।

দরজায় গিয়ে নক করলাম। পূজা দাস নিজে দরজা খুললেন। এবং  জিজ্ঞেস করলেন  আপনি কে?

আমি উত্তর দিলাম - “নমস্কার আমি ইন্দ্রজিৎ মন্ডল , বেসরকারি ডিটেকটিভ।”

“তা কি ব্যাপার আমার কাছে আসা?”-পূজা  দাস বললেন।

পূজা দাস কে আমি বললাম যে অয়ন মুখার্জির জীবন এখন খুব বিপদে আমি নিশ্চয়ই জানেন।

পূজা দাস বললেন- “হ্যাঁ ! আমি জানি এটা কৌশিক সরকার এইসব করছেন।” পূজা  দাস বললেন- কৌশিক সরকার ও অয়ন মুখার্জি তারা দুজন আগে খুুব ভালো বন্ধু ছিলেন। তাদের মধ্যে কোন গোপন শত্রুতা আছে কিনা তা জানেন না। তাছাড়া এর বেশি আর কিছু তিনি জানেন না বলে পূজা দাস উঠে গেলেন।

তারপর সেখান থেকে আমি বাড়ি ফিরলাম। এবং সেদিন রাতে আমি একটি লোক ঠিক করলাম যে ওই তিনজনকে লক্ষ্য রাখবে।

তিন দিনের মাথায় শনিবার সকালে আমি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দেখলাম ব্যবসাদার অয়ন মুখার্জি গতকাল রাতে মদ্যপান করে ছাদ থেকে  পড়়ে মারা গেছেন।  এই দেখে আমি তো চমকে উঠলাম। সেইদিন রাতেই যে গুপ্তচর ঠিক করেছিলাম সে এলেন এবং বললেন যে কৌশিক সরকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন এবং প্রতিদিন রাতে তিনি মদ্যপান করে থাকেন আর অয়ন মুখার্জি তো মারাই গেছেন । আর পূজা দাস আরও একটি নতুন প্রেমিক এর সাথে প্রতিদিন রাতে ঘুরতে যান এবং গতকাল রাতে পূজা দাস অয়ন বাবু বাড়ি গিয়েছিলেন আর সেখানে তাদের ভালোবাসার কথা হচ্ছিল। তিনি আরো বলেন, দুদিন আগে পূজা দাস সেইদিন রাতে অয়ন মুখার্জির বাড়ি গিয়েছিলেন । সেখানে তারা অনেকক্ষণ গল্প করছিলেন। এবং পূজা দাস অয়ন মুখার্জি কে ওই চিঠিতে ভয় পেতে বারণ করেছিলেন।

অয়ন মুখার্জির মৃত্যুর পরের দিন আমি অয়ন মুখার্জির বাড়ি যায়। এবং সেখানে গিয়ে দেখি বাড়ির সকলে খুব কান্নাকাটি করছে তার সাথে তার প্রেমিকা কান্নাকাটি করছে। সেখানে শুধু কৌশিক সরকার আসেনি।

কিছুদিন পর একটা কারণের জন্য আমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তারপরই আমি পূজা দাস মেয়েটির বাড়ি যায়। সেখানে কৌশিক সরকার ও অয়ন মুখার্জির পরিবারের সদস্যকে পূজা দাস এর বাড়িতে ডাকেন। সময়মতো তারা সকলেই সেইদিন বিকালে জমাটবদ্ধ হন।

আমি যখনই পূজা দাস কে বললাম অয়ন মুখার্জির খুন টা সে করেছে , পূজা দাস কিছুতেই কথাটা স্বীকার করলেন না। বরং পূজা দাস বলেন সে তার প্রেমিককে কেন খুুন করবে? এই কথা শুনে সেখানে থাকা সকলেই চমকে যায় এবং সকলেই কৌশিক সরকার কে দোষারোপ করেন।

কৌশিক সরকার বারবার বলে ওঠেন সে অয়ন মুখার্জি কে খুুন করেনি।

তখন আমি সবাইকার সামনে সমস্যার সমাধান করতে পুরো গল্পটা খুলে বলি।

কৌশিক সরকার ও পূজা দাস দু'বছর ধরে সম্পর্কে ছিলেন। তারপর হঠাৎ অয়ন মুখার্জির সাথে পূজা দাস এর সম্পর্কে সৃষ্টি হয়। কারণটা হলো পূজা দাস আসলে কাউকে ভালবাসেননি। তিনি সকলকে টাকার জন্য ব্যবহার করেছেন। প্রথমে কৌশিক সরকার যখন তাকে আর ঘুরতে নিয়ে যেতেন না ও তার হাত খরচ দিতেন না তখন তিনি অয়ন মুখার্জির সাথে সম্পর্কে জান। এবং অয়ন  মুখার্জীর সাথে সম্পর্কে থাকাকালীন পূজা দাস আবার একটি অন্য ছেলের সাথে সম্পর্কে যেতে চান এবং সেটা অয়ন মুখার্জির চোখে পড়ে যায়। পূজা দাস সেই সম্পর্কটা কে অয়ন মুখার্জির কাছে বন্ধু বলে প্রকাশ করেন।
পরে পূজা দেবী বুঝতে পারেন যে অয়ন বাবু যদি বেঁচে থাকেন তাহলে পূজা দেবী তার এই অভ্যাসটা চালিয়ে যেতে পারবেন না তাই পূজা দেবী অয়ন বাবুকে চিঠির মাধ্যমে হুমকি দিয়ে সম্পর্ক থেকে সরে যেতে বলেন। আর তিনি এই কাজটা করেছিলেন যাতে সকল এটাই ভাবে যে এ ঘটনাটা কৌশিক বাবু করছেন। এই সমস্ত ঘটনাটা অয়ন বাবু জানতে পেরে যায়। তাই পূজা দেবী শুক্রবার রাতে তার নতুন প্রেমিকের সাথে ঘুরতে গেছিলেন এবং ফিরে এসেছিলেন অয়ন মুখার্জির বাড়িতে। এবং  সেইদিন রাতে অয়ন বাবুকে ভালোবাসার অভিনয় করে জোরজবস্তি মদ্যপান করান এবং ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেন, যাতে সকলেই মনে করেন , কৌশিক বাবুু   অয়ন বাবুকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছেন অথবা অয়ন বাবু নিজে ছাদ থেকে পড়ে গেছেন। এরফলে পূজা দেবী নিজেকে নিরাপদে রাখতে চেয়ে ছিলেন ।

আমি পূজা দেবীকে জিজ্ঞেস করলাম-“তাইতো পূজা দেবী?”

সবশেষে পূজা দেবী সকলের সামনে নিজের দোষ স্বীকার করলেন। এবং পূজা দেবীকে সকলে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন। এর ফলে পূজা দাস এর জীবনে একটি খুনের দাগ লেগে গেল। যেটা আর কোনদিনও মুছার নয়।

আমরা তখন ইন্দ্রজিৎ দা কে বললাম - “বা বা !তুমি এত বড় সমস্যার সমাধান করেছো । তার জন্য সরকার তোমায় কোন উপহার দেয়নি ।”

ইন্দ্রজিৎ দা বলল - “এটা আমার কাজ সত্যটা সকলের সামনে প্রকাশ করা। কোন পুরস্কারের জন্য আমি এটা করি নি ।”

সবশেষে আমরা নিজেদের বাড়ি ফিরলাম এবং ইন্দ্রজিৎ দা একটি ছোট গোল্ড ফ্লেক্ সিগারেট ধরিয়ে বাড়ি চলে গেলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন