মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান :-
বেদশ্রুতি মুখার্জী
ফোন বেজে উঠতেই তীব্র ঝগড়া শুরু হলো দুই বান্ধবীর। শুধুই দুই সখী নয়, তারা কলিগ, হরিহর আত্মাও। স্কুলে পাশাপাশি টিফিন ভাগাভাগি করে খাওয়া, টিচার হয়েও সেই শৈশবের মতোই। চোখের ইশারায় ই পড়া হয়ে যায় একে অপরের মনের চোরাপথ। রিনা আর রাই। রাই মানে রাইকিশোরী বাংলার, রিনা ভূগোলের। এক SSC তেই জয়েনিং, একসাথে সেই প্রথম থেকে স্টাফরুমের হালহকিকৎ, ইনার পলিটিক্স বোঝা থেকে শুরু করে ডিআই অফিস দৌড়োদৌড়ি অ্যাপ্রুভাল- কনফারমেশনের জন্য থেকে শুরু করে কনফারমেশনের পর একসাথে রাইয়ের গাড়ি করে লংড্রাইভে গিয়ে কনফার্ম হবার চকলেট কেক মাখামাখি করে ট্রিট থেকে শুরু করে রিনার ইন্টার রিলিজিওন ম্যারেজে যখন বন্যার জলের মতোই মিডিয়া নিয়ে ডেপুটেশনে আছড়ে পড়ল গ্রামবাসী, কাঁদতে কাঁদতে রিনা ছেড়েই হয়তোবা দিতো চাকরিটাও, সেদিন ব্রাহ্মণ কন্যা রাইই অন্তর্মুখী স্বভাবের বন্ধ দরজার আগল ভেঙে ফেটে পড়েছিল স্টাফরুমে- "শট আপ্, চাকরির শর্ত কোথাও ছিল না বরের জাত, ম্যাডাম কি পরাচ্ছেন দেখার দায়িত্ব আপনাদের, সেখানে ত্রুটি হলে স্বাগত হাজার বার, কিন্তু ব্যক্তিপরিসরে নাক গলাবেন না, মানহানিতে যেতে হতে পারে আপনাদের। আর আমি ব্রাহ্মণ তা বলে কি মুসলিম ছাত্রীদের সমানতালে আদর করে পড়াই না??? তবে এই ম্যাডামের বরের জাত নিয়ে কথা কেন, ভূগোল পড়াবেন উনি, ধর্ম নয়, থামান মধ্যযুগীয় বর্বরতা"... চুপ হয়ে গেছিল জনস্রোত, এভাবে এত লোকের সামনে গলা চড়ায়নি কখনো রাই, কাঁপছিল সে নিজেও তবুও আপ্রাণ সাপোর্ট করে গেছে বান্ধবীকে, আসলে এভাবে আগে কখনো কথা বলেনি সে, বরাবরই মুখচোরা, চেনা স্রোতের বিপরীতে হাঁটা কমপ্লেক্সে ভোগা মেয়ে সে। বাড়িতে কথা বলতে গেলে ব্যক্তিত্বময়ী বিখ্যাত মা থামিয়ে দেয় বরাবরই-" চুপ করো ছোটো ছোটোর মতো থাকো"... এই ছোটো হওয়া থেকে সে আর বড়ো হলোনা কখনোই মননে চিন্তনে। ইউনিভার্সিটি তে বাইরে গিয়েও ছিল মাতৃআজ্ঞা-"প্রেম কোরোনা যেন, কথা দাও"। কথা দিয়েছিল বলেই শিবমন্দিরের প্রেমঘন কদম গাছের তলায় একা একা ঝালমুড়ি খেয়ে গেছে দুটো বছর আর আশেপাশের ছেলেমেয়েদের পরস্পরের কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকতে দেখেছে, ভেবেছে ওরা এত কিইবা গল্প করে, কখনো বুড়ো বটগাছ গুলোর আড়ালে আড়চোখে দেখেছে ইমরান হাসমি মার্কা কিসিং স্মুচিংও, চোখ নামিয়েছে দ্রত নইলে অস্বস্তি টা নিজেরই হবে, রাত্তিরে পড়াটরা মাথায় উঠবে। আর তখনই মাথা নামিয়ে ছোলা ছিটিয়ে দিয়েছে খালের মাছগুলোকে। ওরাও ওর মতোই একা। শিবমন্দিরের প্রতিটি গাছ কথা বলে, গল্প বলে নতুন নতুন, প্রতি বছরের নতুন শাড়ির ভাঁজের মতোই নতুন প্রেমের গল্প, অধিকাংশই ইউনিভার্সিটির সাথে সাথেই ইতি টানে, টেন পার্সেন্ট বিয়ে অবধি গড়ায়, তাও বহুবছর পর, চাকরিবাকরি পেলে, আর ওয়ান পার্সেন্ট ওর মত লোনলি আনফরচুনেট সিঙ্গেল। চাইলেই করতে পারত মিনিমাম হাফ ডজন প্রেম, অফার আসত প্রায়শই। দেখতে শুনতে সে খুব একটা মন্দ নয়, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, হাইট পাঁচ ফুট দুই, ছিপছিপে কার্ভি ফিগার, মায়াভরা ঝকঝকে চশমাঘেরা চোখের চাহনি, পড়াশোনায় সবাই বলে বেশ ভালো, মেধাবী সিনসিয়ার, ক্লাসে রোজ পড়া পারা একবাক্যে নজরকাড়া মেয়ে, টিচারদের সবার ফেভারিট, কিন্তু বাধ সাধলো ঐযে মাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা টা। তাই রানা ডাগ্গুবাটির মতো দেখতে সৈকতও যেদিন অফার দিয়েছিল মিউজিয়ামের মৃত মমির সামনে, তখনো চোখটা নামিয়ে নাইই করে দিয়েছিল সে, রাতে চোখের কোণটা চিকচিক করছিল, রাতের সঙ্গী বলতে ছিল তারার পাল আর শিলিগুড়ি এফ এম এর জনপ্রিয় আরজে আকাশের কণ্ঠ। এভাবেই অপ্রেমে কেটে গেছে এত বসন্ত, আসলে বসন্ত ঠিক নয়, শীতঘুম।
তাই সেই রাই যখন রিনার জন্য এতটা গর্জে উঠলো সবচেয়ে বেশি চমকেছিল সে নিজেই, নিজের স্পর্ধাকে, নিজের কণ্ঠকে নিজের ভেতরেরই কেউ যেন ব্যঙ্গের হাসিতে ভরিয়ে দিচ্ছিল। সেদিন থেকে রিনা ওর বান্ধবী শুধু নয়, ভক্ত হয়ে ওঠে। নিজের ফ্যান পাওয়াটাও একটা আত্মপ্রতিষ্ঠার আত্মপ্রত্যয়ের জায়গা, তাই এনজয় করছিল এতকাল রিনা আর তার বন্ধুত্ব। বাধ সাধলো আজকের ফোন কলটা।
যদিও কিছুদিন থেকেই রিনার অধিকারবোধের দখলদারীটা দ্রব্যমূল্যের মতোই পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল, আসলে ঘটনা আর কিছুই নয় রাই এতদিনে প্রেমে পড়েছে, ছেলেটার সঙ্গে ফেসবুকে আলাপ, বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব আর অনেক দূরের। তাই রাইয়ের যতই তাকে ভালো লাগছিল, যতই চুম্বকীয় আকর্ষণে নর্থপোল সাউথ পোলের দিকে ছুটছিল, ততই রিনা রাশ টেনে ধরছিল- "এত ভালো হতে পারেনা কেউ, নিশ্চয়ই ডালমে কুছ কালা হ্যায়।" ব্যস তাহলে আর কি, হয়ে যাও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, খোঁড়ো অতীত ইতিহাস। সবটুকু ই কিন্তু রাইয়ের অগোচরেই, তবে খুঁড়তে খুঁড়তে পাওয়া একটার পর একটা স্কৃনশটের পাথর এনে চাপা দিচ্ছিল রাইয়েরই বুকে। গোটা পৃথিবীটা একদিন বোধহয় স্কৃনশটই হয়ে যাবে, মা শিশুর মুখে স্তন ঠাসার আগেও ছবি তুলে রাখবে আর পাঠাবে সেই সেলফি বা স্কৃনশট অফিসে বসা স্বামীর সেলফোনে, বাবার মৃতদেহ এনে উঠোনে রেখেও ছেলে মাকে ডেথ সার্টিফিকেট স্কৃনশট করে পাঠাবে, সিঁদুর পরাতে গিয়েও হয়তোবা স্কৃনশট লাগবে। এমনকি ফুলশয্যায় হয়তোবা একদিন ফুলের বদলে স্কৃনশটের প্রিন্ট আউট ছড়িয়ে রাখা হবে। রাই বলেছিল কিন্তু রিনাকে-" আমার করুণাময়কে ভীষণ বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, আর তোর স্কৃনশট স্কৃনশট খেলা বন্ধ কর। আমার ময় আমার জীবন, ওকে ছাড়া বাঁচবোই না"... আর সেদিন ফোনে চিৎকার করে রিনা তাকে তৃতীয় ব্যক্তি বলে, বলে-" হারামজাদি তুই অন্য একটা মেয়ের ঘর ভাঙছিস জানিস, আরে করুণাময়ের আগের গার্লফ্রেন্ড নাকি প্রেগনেন্ট, তিন মাসের, তুই কি শেষে প্রস্টিটিউট হবি আজীবন ভালো থাকার পর।ওকেও যেমন ছেড়েছে তোর সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগার পর, তুই যেমন রিপ্লেস করলি ওকে, তোকেও করবেই কেউ অচিরেই।" নিতে পারেনি রাই এই ফোনকলটা, পা ধরে বলেছিল এসব বন্ধ করতে, কিন্তু তবুও বন্ধ তো হলোইনা, বরংচ এমন জায়গায় চলে গেল ঘটনাটা যেখান থেকে তার মনেও রিনার বলা রোজকার বিষবাষ্প এসে অ্যাসিড বৃষ্টি নামালো, সেও বলে ফেলল তার করুণাময়কে কিছু তীব্র কটুকথা। বাক সংযমী এক আকাশ সমান ভালোবাসার মানুষটি কিন্তু কিচ্ছু উত্তর দিলোনা, এমন কিচ্ছু বললোনা যাতে তার কষ্ট অন্তর্দ্বন্দ্ব আরো বাড়ে, শুধু ডিপিটা সদ্যবিধবার সিঁথির মত সাদা হয়ে গেল। অনন্ত সূর্য হতে পারলোনা করুণাময়, ক্ষমা করতে পারলোনা।
কত কত ভালো মুহুর্ত কাটিয়েছে তারা এই লকডাউনের দুইমাস। যখন গোটা পৃথিবী এক প্রবল ভাইরাসের কবলে বিধ্বস্ত, তার কিছু দিন আগেই পরিচয় তাদের, লকডাউনে কাছাকাছি আসা, দিনরাত কথা বলা ফোনে আর একদিন ভালোবেসে ফেলা। জীবন এই প্রথমবার রাই কাউকে ভালো বেসে ফেলেছিল, আসলে করুণাময়ের পার্সোনালিটি ই এমন, এজন্যই সে সবার হার্টথ্রব, ফর্সা ছ ফুটের দুর্দান্ত হিরোটাইপ চেহারা, ঝকঝকে জ্বলন্ত সূর্যের মত দুইচোখের মালিক, তুখোড় বাগ্মী, নামকরা গায়ক, হাসলে গালের টোলটা দাড়িতে ঢাকা পড়লে মনে হয় যেন মেঘে আকাশ ঢাকা পড়লো। সিগারেট ধরানোর স্টাইলে আজ থাকলে বোধহয় মহানায়কও আড়চোখে দেখতেন। রাতের পর রাত দিনের পর দিন তারা কথা বলে গেছে, স্বপ্নের জাল বুনে গেছে, রাই জানতোই না রিনা ইঁদুরের মত সেই জাল ছিঁড়তে উঠেপড়ে লেগেছে। বলেছিল তবে করুণাময় - "বিশ্বাস করলে এতটাই করো, যেন পৃথিবীতে কেউ তোমার বিশ্বাস ভাঙতে না পারে, আর মেয়েরা অন্যের স্বামীকে এতবড় দেখতে পারেনা, যেখান থেকে নিজের মানুষটাকে ছোট লাগে।" রাই কিন্তু অবিশ্বাস করেনি, প্রবলভাবে ই বিশ্বাস করেছিল তাকে, ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল তার জীবনের শেষ অবলম্বন সেলিব্রেটি করুণাময়কে। নিজের দুঃখবিলাসের পদাবলী পেরিয়ে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল করুণাময়ের অতীতটাকে, কিন্তু এমন খেলা খেলল সময়, পারলোনা। করুণাময়ের অতীতের অন্ধকার তাকে অজগরের মত করে গিলে গিলে খেয়ে ফেললো। একটা ছোট্ট অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছিল মনের অন্তরালেই, আর কোথায় যেন মনে হচ্ছিল সে তাহলে কী হবে সমাজের চোখে, করুণার স্ত্রী না বিকল্প তুলে আনা কোনো নুড়ি পাথর। ঐ মেয়েটির বাচ্চা কাঁটা নিয়ে কীভাবে আজীবন ঘর করবে। তবুও সবকিছু এড়োনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, চোখের জল লুকিয়ে প্রাণপণ হেসে হেসে খুশি রাখার চেষ্টা করছিল করুণাময়কে। এই লকডাউনের দুই মাসে কত শত রাত ভোর হয়ে গেছে কখন টেরই পায়নি, করুণাময়ের প্রগাঢ় জ্ঞান, বাকচাতুর্যে এত বছরের অনন্ত রাতগুলো যেন খুব ছোট হয়ে আসছিল হঠাৎই। স্বপ্নের জাল বুনছিল আসন্ন সাদা ধুতি আর লাল রঙা বেনারসি। করুণাময় একদিন বলল-" রাই, তুমি আজীবন আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমোবে, আমি তোমাকে গল্প শোনাবো এভাবেই, এখন যেমনটি ফোনে শোনাই।" রাই দেখতে পাচ্ছিল একটা খোলা বুক, করুণাময়ের অপূর্ব সুন্দর মুখটা, ওর দাড়িটা নিজের গালে অনুভব করছিল আর ততই ওর নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছিল, শুধু মুখে জেদ করতো-" অ্যাই ময়, ঘুম পাড়িয়ে দাও"। করুণাময়ও পরম আদরে আদর্শ হবু স্বামীর সব কর্তব্য ই পালন করছিল ওর এত বিজি শিডিউলের মধ্যেও, রেকর্ডিং স্টুডিও তো এখন বন্ধ, লকডাউন তাই দিনের পর দিন রাতের পর রাত ওর সব কথা সব জেদ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিল, আর ততই রাই ফিরে যাচ্ছিল অতীতে, ঠিক যেভাবে ও ওর মৃতা মার কাছে জেদ করত, সেভাবে ই আদুরে বিড়ালের মতোই করুণাময়ের কাছে জেদ করত, ঘুম পাড়ানোর আব্দার, গল্প শোনার জেদ, সারা রাত কথা বলার জেদ, দুজনেই বিভোর হয়ে যাচ্ছিল দুজনের প্রেমে, ওর রক্তে মিশে যাচ্ছিল করুণাময়, সৌজন্য অবশ্যই লকডাউন এর এই বন্দীসময়, নইলে সেলিব্রেটি করুণাময়ের এত সময় কোথায় আর তারও তো স্কুল থাকে, সারা রাত কথা বললে যেতে পারা যায় নাকি পরদিন স্কুলে। লকডাউনের বাজারে তারা করোনা ভাইরাসকে আখ্যা দিয়েছিল- "কিউট ভাইরাস", যার সৌজন্যেই তাদের কাছাকাছি আসা আর এত এত কথা বলার সুযোগ পাওয়া। বিয়ে করার কথা ছিল লকডাউন মিটলেই, কিন্তু বাধ সাধলো করুণাময়ের অতীত রহস্য খোঁড়ায় তৎপর রিনা। দশচক্রে ভগবানও ভূত হয়, করুণাময়ের একযুগের গার্লফ্রেন্ড যখন রাইয়েরই একটার পর একটা খুঁটিনাটি বলে বলতে লাগলো করুণাময়ের জীবনের বীভৎস অন্ধকার এর ইতিহাস, তখন তলিয়ে যেতে লাগলো রাই, বারবারই মনে হতে লাগলো এ আমার এত কথা জানলো কিভাবে যদি সত্যিই ময় না বলে থাকে, আর তাহলে এই মেয়েটা কি সত্যিই বলছে, ময় কি ওদের দুজনকেই নাচাচ্ছে, দুজনের সঙ্গেই কথা বলছে রোজ আর তাহলে মেয়েটা কি সত্যিই বলছে যে ময় বলেছে সে তাকেও বিয়ে করবে, কারণ এতবছর ভোলা যায় না, দুইবৌ নিয়ে বাস করবে, ময়ের সন্তানের মা হতে চলেছে এটাও কি তবে সত্যিই বলছে মেয়েটা। আর তাতেই চিৎকার করে করুণাময়ের ওপর রাগে ফেটে পড়লো রাই একদিন-
" কি খেলা খেলছ তোমার গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে আমার সাথে, দুটো প্রেম চালাচ্ছ তাইনা, দুই বিয়ে করবা??" ব্যস আর উত্তর টুকুও দিলোনা করুণাময়, চলে গেল চিরতরে ছি ছিক্কার করতে করতে, কানে বাজে আজো সেই কঠোর ঘৃণার স্বর। সে ভেবেছিল করুণাময় অনন্ত শক্তির আধার ঐ সূর্যটার মতোই চিরকালীন, তার মায়ের মতোই চিরপ্রশ্রয় চির আদরের আধার, তার ময় তাকে সেরকম ই বলেছিল, "আমি ই তোমার বাবা, আমিই তোমার মা, আমিই তোমার বর, তোমার সবকিছুই আমি, তোমার আর কাউকে লাগবে না, মরে না গেলে আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাবোনা"... আরো বলেছিল, "তোমার মধ্যে আমি অসীম আলো আর অনন্ত শান্তি খুঁজে পাই জানো, যেন ঠিক আমার মাকে দেখতে পাই, তোমার মত এত ভালো মেয়ে আমি কখনো দেখিনি গো"... কিন্তু তবুও সবকিছু ভুলে চলে গেল , সূর্যটা জ্বলার আগেই নিভে গেল, অনন্ত হতে পারলোনা, শুধুই আবিষ্কারক আনন্দের বন্দরের নাবিক প্রেমিক হয়েই থাকলো, সুখদুঃখের চিরসাথী হয়ে একটা ফোন কল ভুলে ক্ষমা করে থাকতে পারলোনা, এত ফোনকলের সুখস্মৃতি তুচ্ছ হয়ে গেল কেবলমাত্র একটা প্রশ্নেই, সকলের সাচঝুটের চক্রান্তে হারিয়ে ফেলল বোকা রাই তার একমাত্র ভালোবাসাটাকে।
নিঃস্ব রাই এখন হসপিটালে, করোনার আবহেও সে গত তিন চারদিন জলস্পর্শ না করায় আজ তাকে অ্যাডমিট করা হয়েছে এখানে, সেলাইন চলছে, ডক্টর দেখে যা তা বলে গেছেন। সত্যিই তো ওনাদের ওপর দিয়ে যা ঝড় চলছে এখন, বাড়িতে যাওয়াও হচ্ছেনা দিনের পর দিন, রাতদিন ডিউটি, চারিদিকে করোনা আতঙ্কে লড়ছেন তারা আপ্রাণ আর তার মধ্যে যদি এসব ইচ্ছাকৃত পেশেন্ট আসে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এদিকে রাই ভাবছে কখন আবার একটু মাথা তুলতে পেরে বাড়ি যাবে, এইবার হসপিটালে নয়, মর্গে আসার জন্য... দূরে কোনো বাড়ি থেকে যেন গোটা বিশ্বে বিষাদের সুর ছড়িয়ে কেউ গাইছে- "মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান"...
-----------------------------------------
বেদশ্রুতি মুখার্জী
ফোন বেজে উঠতেই তীব্র ঝগড়া শুরু হলো দুই বান্ধবীর। শুধুই দুই সখী নয়, তারা কলিগ, হরিহর আত্মাও। স্কুলে পাশাপাশি টিফিন ভাগাভাগি করে খাওয়া, টিচার হয়েও সেই শৈশবের মতোই। চোখের ইশারায় ই পড়া হয়ে যায় একে অপরের মনের চোরাপথ। রিনা আর রাই। রাই মানে রাইকিশোরী বাংলার, রিনা ভূগোলের। এক SSC তেই জয়েনিং, একসাথে সেই প্রথম থেকে স্টাফরুমের হালহকিকৎ, ইনার পলিটিক্স বোঝা থেকে শুরু করে ডিআই অফিস দৌড়োদৌড়ি অ্যাপ্রুভাল- কনফারমেশনের জন্য থেকে শুরু করে কনফারমেশনের পর একসাথে রাইয়ের গাড়ি করে লংড্রাইভে গিয়ে কনফার্ম হবার চকলেট কেক মাখামাখি করে ট্রিট থেকে শুরু করে রিনার ইন্টার রিলিজিওন ম্যারেজে যখন বন্যার জলের মতোই মিডিয়া নিয়ে ডেপুটেশনে আছড়ে পড়ল গ্রামবাসী, কাঁদতে কাঁদতে রিনা ছেড়েই হয়তোবা দিতো চাকরিটাও, সেদিন ব্রাহ্মণ কন্যা রাইই অন্তর্মুখী স্বভাবের বন্ধ দরজার আগল ভেঙে ফেটে পড়েছিল স্টাফরুমে- "শট আপ্, চাকরির শর্ত কোথাও ছিল না বরের জাত, ম্যাডাম কি পরাচ্ছেন দেখার দায়িত্ব আপনাদের, সেখানে ত্রুটি হলে স্বাগত হাজার বার, কিন্তু ব্যক্তিপরিসরে নাক গলাবেন না, মানহানিতে যেতে হতে পারে আপনাদের। আর আমি ব্রাহ্মণ তা বলে কি মুসলিম ছাত্রীদের সমানতালে আদর করে পড়াই না??? তবে এই ম্যাডামের বরের জাত নিয়ে কথা কেন, ভূগোল পড়াবেন উনি, ধর্ম নয়, থামান মধ্যযুগীয় বর্বরতা"... চুপ হয়ে গেছিল জনস্রোত, এভাবে এত লোকের সামনে গলা চড়ায়নি কখনো রাই, কাঁপছিল সে নিজেও তবুও আপ্রাণ সাপোর্ট করে গেছে বান্ধবীকে, আসলে এভাবে আগে কখনো কথা বলেনি সে, বরাবরই মুখচোরা, চেনা স্রোতের বিপরীতে হাঁটা কমপ্লেক্সে ভোগা মেয়ে সে। বাড়িতে কথা বলতে গেলে ব্যক্তিত্বময়ী বিখ্যাত মা থামিয়ে দেয় বরাবরই-" চুপ করো ছোটো ছোটোর মতো থাকো"... এই ছোটো হওয়া থেকে সে আর বড়ো হলোনা কখনোই মননে চিন্তনে। ইউনিভার্সিটি তে বাইরে গিয়েও ছিল মাতৃআজ্ঞা-"প্রেম কোরোনা যেন, কথা দাও"। কথা দিয়েছিল বলেই শিবমন্দিরের প্রেমঘন কদম গাছের তলায় একা একা ঝালমুড়ি খেয়ে গেছে দুটো বছর আর আশেপাশের ছেলেমেয়েদের পরস্পরের কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকতে দেখেছে, ভেবেছে ওরা এত কিইবা গল্প করে, কখনো বুড়ো বটগাছ গুলোর আড়ালে আড়চোখে দেখেছে ইমরান হাসমি মার্কা কিসিং স্মুচিংও, চোখ নামিয়েছে দ্রত নইলে অস্বস্তি টা নিজেরই হবে, রাত্তিরে পড়াটরা মাথায় উঠবে। আর তখনই মাথা নামিয়ে ছোলা ছিটিয়ে দিয়েছে খালের মাছগুলোকে। ওরাও ওর মতোই একা। শিবমন্দিরের প্রতিটি গাছ কথা বলে, গল্প বলে নতুন নতুন, প্রতি বছরের নতুন শাড়ির ভাঁজের মতোই নতুন প্রেমের গল্প, অধিকাংশই ইউনিভার্সিটির সাথে সাথেই ইতি টানে, টেন পার্সেন্ট বিয়ে অবধি গড়ায়, তাও বহুবছর পর, চাকরিবাকরি পেলে, আর ওয়ান পার্সেন্ট ওর মত লোনলি আনফরচুনেট সিঙ্গেল। চাইলেই করতে পারত মিনিমাম হাফ ডজন প্রেম, অফার আসত প্রায়শই। দেখতে শুনতে সে খুব একটা মন্দ নয়, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, হাইট পাঁচ ফুট দুই, ছিপছিপে কার্ভি ফিগার, মায়াভরা ঝকঝকে চশমাঘেরা চোখের চাহনি, পড়াশোনায় সবাই বলে বেশ ভালো, মেধাবী সিনসিয়ার, ক্লাসে রোজ পড়া পারা একবাক্যে নজরকাড়া মেয়ে, টিচারদের সবার ফেভারিট, কিন্তু বাধ সাধলো ঐযে মাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা টা। তাই রানা ডাগ্গুবাটির মতো দেখতে সৈকতও যেদিন অফার দিয়েছিল মিউজিয়ামের মৃত মমির সামনে, তখনো চোখটা নামিয়ে নাইই করে দিয়েছিল সে, রাতে চোখের কোণটা চিকচিক করছিল, রাতের সঙ্গী বলতে ছিল তারার পাল আর শিলিগুড়ি এফ এম এর জনপ্রিয় আরজে আকাশের কণ্ঠ। এভাবেই অপ্রেমে কেটে গেছে এত বসন্ত, আসলে বসন্ত ঠিক নয়, শীতঘুম।
তাই সেই রাই যখন রিনার জন্য এতটা গর্জে উঠলো সবচেয়ে বেশি চমকেছিল সে নিজেই, নিজের স্পর্ধাকে, নিজের কণ্ঠকে নিজের ভেতরেরই কেউ যেন ব্যঙ্গের হাসিতে ভরিয়ে দিচ্ছিল। সেদিন থেকে রিনা ওর বান্ধবী শুধু নয়, ভক্ত হয়ে ওঠে। নিজের ফ্যান পাওয়াটাও একটা আত্মপ্রতিষ্ঠার আত্মপ্রত্যয়ের জায়গা, তাই এনজয় করছিল এতকাল রিনা আর তার বন্ধুত্ব। বাধ সাধলো আজকের ফোন কলটা।
যদিও কিছুদিন থেকেই রিনার অধিকারবোধের দখলদারীটা দ্রব্যমূল্যের মতোই পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল, আসলে ঘটনা আর কিছুই নয় রাই এতদিনে প্রেমে পড়েছে, ছেলেটার সঙ্গে ফেসবুকে আলাপ, বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব আর অনেক দূরের। তাই রাইয়ের যতই তাকে ভালো লাগছিল, যতই চুম্বকীয় আকর্ষণে নর্থপোল সাউথ পোলের দিকে ছুটছিল, ততই রিনা রাশ টেনে ধরছিল- "এত ভালো হতে পারেনা কেউ, নিশ্চয়ই ডালমে কুছ কালা হ্যায়।" ব্যস তাহলে আর কি, হয়ে যাও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, খোঁড়ো অতীত ইতিহাস। সবটুকু ই কিন্তু রাইয়ের অগোচরেই, তবে খুঁড়তে খুঁড়তে পাওয়া একটার পর একটা স্কৃনশটের পাথর এনে চাপা দিচ্ছিল রাইয়েরই বুকে। গোটা পৃথিবীটা একদিন বোধহয় স্কৃনশটই হয়ে যাবে, মা শিশুর মুখে স্তন ঠাসার আগেও ছবি তুলে রাখবে আর পাঠাবে সেই সেলফি বা স্কৃনশট অফিসে বসা স্বামীর সেলফোনে, বাবার মৃতদেহ এনে উঠোনে রেখেও ছেলে মাকে ডেথ সার্টিফিকেট স্কৃনশট করে পাঠাবে, সিঁদুর পরাতে গিয়েও হয়তোবা স্কৃনশট লাগবে। এমনকি ফুলশয্যায় হয়তোবা একদিন ফুলের বদলে স্কৃনশটের প্রিন্ট আউট ছড়িয়ে রাখা হবে। রাই বলেছিল কিন্তু রিনাকে-" আমার করুণাময়কে ভীষণ বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, আর তোর স্কৃনশট স্কৃনশট খেলা বন্ধ কর। আমার ময় আমার জীবন, ওকে ছাড়া বাঁচবোই না"... আর সেদিন ফোনে চিৎকার করে রিনা তাকে তৃতীয় ব্যক্তি বলে, বলে-" হারামজাদি তুই অন্য একটা মেয়ের ঘর ভাঙছিস জানিস, আরে করুণাময়ের আগের গার্লফ্রেন্ড নাকি প্রেগনেন্ট, তিন মাসের, তুই কি শেষে প্রস্টিটিউট হবি আজীবন ভালো থাকার পর।ওকেও যেমন ছেড়েছে তোর সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগার পর, তুই যেমন রিপ্লেস করলি ওকে, তোকেও করবেই কেউ অচিরেই।" নিতে পারেনি রাই এই ফোনকলটা, পা ধরে বলেছিল এসব বন্ধ করতে, কিন্তু তবুও বন্ধ তো হলোইনা, বরংচ এমন জায়গায় চলে গেল ঘটনাটা যেখান থেকে তার মনেও রিনার বলা রোজকার বিষবাষ্প এসে অ্যাসিড বৃষ্টি নামালো, সেও বলে ফেলল তার করুণাময়কে কিছু তীব্র কটুকথা। বাক সংযমী এক আকাশ সমান ভালোবাসার মানুষটি কিন্তু কিচ্ছু উত্তর দিলোনা, এমন কিচ্ছু বললোনা যাতে তার কষ্ট অন্তর্দ্বন্দ্ব আরো বাড়ে, শুধু ডিপিটা সদ্যবিধবার সিঁথির মত সাদা হয়ে গেল। অনন্ত সূর্য হতে পারলোনা করুণাময়, ক্ষমা করতে পারলোনা।
কত কত ভালো মুহুর্ত কাটিয়েছে তারা এই লকডাউনের দুইমাস। যখন গোটা পৃথিবী এক প্রবল ভাইরাসের কবলে বিধ্বস্ত, তার কিছু দিন আগেই পরিচয় তাদের, লকডাউনে কাছাকাছি আসা, দিনরাত কথা বলা ফোনে আর একদিন ভালোবেসে ফেলা। জীবন এই প্রথমবার রাই কাউকে ভালো বেসে ফেলেছিল, আসলে করুণাময়ের পার্সোনালিটি ই এমন, এজন্যই সে সবার হার্টথ্রব, ফর্সা ছ ফুটের দুর্দান্ত হিরোটাইপ চেহারা, ঝকঝকে জ্বলন্ত সূর্যের মত দুইচোখের মালিক, তুখোড় বাগ্মী, নামকরা গায়ক, হাসলে গালের টোলটা দাড়িতে ঢাকা পড়লে মনে হয় যেন মেঘে আকাশ ঢাকা পড়লো। সিগারেট ধরানোর স্টাইলে আজ থাকলে বোধহয় মহানায়কও আড়চোখে দেখতেন। রাতের পর রাত দিনের পর দিন তারা কথা বলে গেছে, স্বপ্নের জাল বুনে গেছে, রাই জানতোই না রিনা ইঁদুরের মত সেই জাল ছিঁড়তে উঠেপড়ে লেগেছে। বলেছিল তবে করুণাময় - "বিশ্বাস করলে এতটাই করো, যেন পৃথিবীতে কেউ তোমার বিশ্বাস ভাঙতে না পারে, আর মেয়েরা অন্যের স্বামীকে এতবড় দেখতে পারেনা, যেখান থেকে নিজের মানুষটাকে ছোট লাগে।" রাই কিন্তু অবিশ্বাস করেনি, প্রবলভাবে ই বিশ্বাস করেছিল তাকে, ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল তার জীবনের শেষ অবলম্বন সেলিব্রেটি করুণাময়কে। নিজের দুঃখবিলাসের পদাবলী পেরিয়ে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল করুণাময়ের অতীতটাকে, কিন্তু এমন খেলা খেলল সময়, পারলোনা। করুণাময়ের অতীতের অন্ধকার তাকে অজগরের মত করে গিলে গিলে খেয়ে ফেললো। একটা ছোট্ট অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছিল মনের অন্তরালেই, আর কোথায় যেন মনে হচ্ছিল সে তাহলে কী হবে সমাজের চোখে, করুণার স্ত্রী না বিকল্প তুলে আনা কোনো নুড়ি পাথর। ঐ মেয়েটির বাচ্চা কাঁটা নিয়ে কীভাবে আজীবন ঘর করবে। তবুও সবকিছু এড়োনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, চোখের জল লুকিয়ে প্রাণপণ হেসে হেসে খুশি রাখার চেষ্টা করছিল করুণাময়কে। এই লকডাউনের দুই মাসে কত শত রাত ভোর হয়ে গেছে কখন টেরই পায়নি, করুণাময়ের প্রগাঢ় জ্ঞান, বাকচাতুর্যে এত বছরের অনন্ত রাতগুলো যেন খুব ছোট হয়ে আসছিল হঠাৎই। স্বপ্নের জাল বুনছিল আসন্ন সাদা ধুতি আর লাল রঙা বেনারসি। করুণাময় একদিন বলল-" রাই, তুমি আজীবন আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমোবে, আমি তোমাকে গল্প শোনাবো এভাবেই, এখন যেমনটি ফোনে শোনাই।" রাই দেখতে পাচ্ছিল একটা খোলা বুক, করুণাময়ের অপূর্ব সুন্দর মুখটা, ওর দাড়িটা নিজের গালে অনুভব করছিল আর ততই ওর নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছিল, শুধু মুখে জেদ করতো-" অ্যাই ময়, ঘুম পাড়িয়ে দাও"। করুণাময়ও পরম আদরে আদর্শ হবু স্বামীর সব কর্তব্য ই পালন করছিল ওর এত বিজি শিডিউলের মধ্যেও, রেকর্ডিং স্টুডিও তো এখন বন্ধ, লকডাউন তাই দিনের পর দিন রাতের পর রাত ওর সব কথা সব জেদ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিল, আর ততই রাই ফিরে যাচ্ছিল অতীতে, ঠিক যেভাবে ও ওর মৃতা মার কাছে জেদ করত, সেভাবে ই আদুরে বিড়ালের মতোই করুণাময়ের কাছে জেদ করত, ঘুম পাড়ানোর আব্দার, গল্প শোনার জেদ, সারা রাত কথা বলার জেদ, দুজনেই বিভোর হয়ে যাচ্ছিল দুজনের প্রেমে, ওর রক্তে মিশে যাচ্ছিল করুণাময়, সৌজন্য অবশ্যই লকডাউন এর এই বন্দীসময়, নইলে সেলিব্রেটি করুণাময়ের এত সময় কোথায় আর তারও তো স্কুল থাকে, সারা রাত কথা বললে যেতে পারা যায় নাকি পরদিন স্কুলে। লকডাউনের বাজারে তারা করোনা ভাইরাসকে আখ্যা দিয়েছিল- "কিউট ভাইরাস", যার সৌজন্যেই তাদের কাছাকাছি আসা আর এত এত কথা বলার সুযোগ পাওয়া। বিয়ে করার কথা ছিল লকডাউন মিটলেই, কিন্তু বাধ সাধলো করুণাময়ের অতীত রহস্য খোঁড়ায় তৎপর রিনা। দশচক্রে ভগবানও ভূত হয়, করুণাময়ের একযুগের গার্লফ্রেন্ড যখন রাইয়েরই একটার পর একটা খুঁটিনাটি বলে বলতে লাগলো করুণাময়ের জীবনের বীভৎস অন্ধকার এর ইতিহাস, তখন তলিয়ে যেতে লাগলো রাই, বারবারই মনে হতে লাগলো এ আমার এত কথা জানলো কিভাবে যদি সত্যিই ময় না বলে থাকে, আর তাহলে এই মেয়েটা কি সত্যিই বলছে, ময় কি ওদের দুজনকেই নাচাচ্ছে, দুজনের সঙ্গেই কথা বলছে রোজ আর তাহলে মেয়েটা কি সত্যিই বলছে যে ময় বলেছে সে তাকেও বিয়ে করবে, কারণ এতবছর ভোলা যায় না, দুইবৌ নিয়ে বাস করবে, ময়ের সন্তানের মা হতে চলেছে এটাও কি তবে সত্যিই বলছে মেয়েটা। আর তাতেই চিৎকার করে করুণাময়ের ওপর রাগে ফেটে পড়লো রাই একদিন-
" কি খেলা খেলছ তোমার গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে আমার সাথে, দুটো প্রেম চালাচ্ছ তাইনা, দুই বিয়ে করবা??" ব্যস আর উত্তর টুকুও দিলোনা করুণাময়, চলে গেল চিরতরে ছি ছিক্কার করতে করতে, কানে বাজে আজো সেই কঠোর ঘৃণার স্বর। সে ভেবেছিল করুণাময় অনন্ত শক্তির আধার ঐ সূর্যটার মতোই চিরকালীন, তার মায়ের মতোই চিরপ্রশ্রয় চির আদরের আধার, তার ময় তাকে সেরকম ই বলেছিল, "আমি ই তোমার বাবা, আমিই তোমার মা, আমিই তোমার বর, তোমার সবকিছুই আমি, তোমার আর কাউকে লাগবে না, মরে না গেলে আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাবোনা"... আরো বলেছিল, "তোমার মধ্যে আমি অসীম আলো আর অনন্ত শান্তি খুঁজে পাই জানো, যেন ঠিক আমার মাকে দেখতে পাই, তোমার মত এত ভালো মেয়ে আমি কখনো দেখিনি গো"... কিন্তু তবুও সবকিছু ভুলে চলে গেল , সূর্যটা জ্বলার আগেই নিভে গেল, অনন্ত হতে পারলোনা, শুধুই আবিষ্কারক আনন্দের বন্দরের নাবিক প্রেমিক হয়েই থাকলো, সুখদুঃখের চিরসাথী হয়ে একটা ফোন কল ভুলে ক্ষমা করে থাকতে পারলোনা, এত ফোনকলের সুখস্মৃতি তুচ্ছ হয়ে গেল কেবলমাত্র একটা প্রশ্নেই, সকলের সাচঝুটের চক্রান্তে হারিয়ে ফেলল বোকা রাই তার একমাত্র ভালোবাসাটাকে।
নিঃস্ব রাই এখন হসপিটালে, করোনার আবহেও সে গত তিন চারদিন জলস্পর্শ না করায় আজ তাকে অ্যাডমিট করা হয়েছে এখানে, সেলাইন চলছে, ডক্টর দেখে যা তা বলে গেছেন। সত্যিই তো ওনাদের ওপর দিয়ে যা ঝড় চলছে এখন, বাড়িতে যাওয়াও হচ্ছেনা দিনের পর দিন, রাতদিন ডিউটি, চারিদিকে করোনা আতঙ্কে লড়ছেন তারা আপ্রাণ আর তার মধ্যে যদি এসব ইচ্ছাকৃত পেশেন্ট আসে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এদিকে রাই ভাবছে কখন আবার একটু মাথা তুলতে পেরে বাড়ি যাবে, এইবার হসপিটালে নয়, মর্গে আসার জন্য... দূরে কোনো বাড়ি থেকে যেন গোটা বিশ্বে বিষাদের সুর ছড়িয়ে কেউ গাইছে- "মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান"...
-----------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন