আমন্ত্রিত কলম
পঁচিশে বৈশাখে "গানের ওপারে"
লেখিকাঃ- ঈশিতা মন্ডল
" রবীন্দ্রনাথ " শব্দ টার সাথে পরিচিত নেই এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর। আর কিছু না হোক অন্তত রোদ্দুর রায় এর সুবাদে হলেও রবীন্দ্রনাথের নাম টা বাঙালি জানে।। কিন্তু বিষয়টা হল, আসলে " রবীন্দ্রনাথ " না কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়; রবীন্দ্রনাথ একটা আশ্রয়ের নাম, একটা বিশ্বাসের জায়গা, একটা আসমুদ্র হিমাচল যার মধ্যে আনন্দ, শোক , বিহ্বলতা , প্রেম , ভক্তি , স্নেহ সব ধারণের জায়গা আছে।। রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাণের আরাম,মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি।
এহেন রবীন্দ্রনাথের গান - গল্প - কবিতা - জীবনদর্শন ইত্যাদি নিয়ে বহু বিদগ্ধ মানুষ বহু কিছু লিখেছেন, লিখছেন, এবং ভবিষ্যতেও লিখবেন। তাই এবারের ২৫ শে বৈশাখে আমরা বরং একটু অন্য বিষয়ে কথা বলি।। বিষয়টা কবিগুরু কে নিয়েই , তবে প্রেক্ষাপট টা একটু আলাদা । কথা বলব একটি বাংলা ধারাবাহিক নিয়ে। হ্যাঁ জানি, ধারাবাহিক বললেই জুন আন্টি - শ্রীময়ী - অনিন্দ্য দা র ত্রিকোণ প্রেম আর নাহলে সাধারণ কাঁচি দিয়ে জবা নামক যুবতীর বম্ব ডিফিউস করার ভিডিও আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।। কিন্তু এসবের মধ্যেও কখনো কখনো উঠে আসে এমন কিছু ধারাবাহিক যা স্বাদে গন্ধে সত্যিই অতুলনীয়।। এরকম ধারাবাহিক গোটা পাঁচ দশ চললে বাংলা ধারাবাহিকের এতটা দুর্নাম বোধহয় হত না। এমনই একটি ধারাবাহিক , "গানের ওপারে" । ঋতুপর্ণ ঘোষের কনসেপ্ট এবং স্ক্রিপ্ট নিয়ে জয়দীপ মুখার্জি র পরিচালনা এবং প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি র প্রযোজনায় তৈরি হয় ধারাবাহিক টি।
" ভাগ্যিস উনি আড়াই হাজার টা গান লিখে ফেলেছিলেন; কোথাও বোধ হয় ওনার মনে হয়েছিল যে যদি কিছু বাঁচিয়ে রাখে , তো ওনার গান ওনাকে বাঁচিয়ে রাখবে।"
প্রথম পর্বে ঝিনুক, যার জবানিতে গল্প শুরু হয়, তার মুখ দিয়ে এই উপরোক্ত ভীষণ সত্যি কথা টা বলিয়ে দিয়েছিলেন নির্মাতা রা। সত্যিই আজ দেখতে গেলে "রামকানাই এর নির্বুদ্ধিতা" , "জীবিত ও মৃত" , " অনধিকার প্রবেশ" , " ছুটি" , " অতিথি" র চেয়ে "আমার পরান যাহা চায়" , " আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী", " ও যে মানে না মানা" অনেক বেশি জনপ্রিয়।। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়শই ভেসে ওঠে এরা, লাইক, শেয়ার, লাভ রিয়্যাক্ট এর বন্যা ছুটে যায়।। তো এভাবেই ধারাবাহিকের গল্পের শুরু হয় , ঝিনুক এর জবানিতে।। পরে আস্তে আস্তে যদিও ঝিনুক ও গল্পের একটি চরিত্র হয়ে ওঠে।। কালচারাল জার্নালিস্ট ঝিনুক নিজের চ্যানেলে রবীন্দ্রনাথের জন্ম সার্ধ শতবর্ষ উদযাপনের জন্য রসদ খুঁজতে পৌঁছে যায় চন্দ্রশেখর বাবু র " সোনার তরী " তে। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের একদা ছাত্র ,বর্তমানে রবীন্দ্রানুরাগী হিসেবে বিশেষভাবে খ্যাত চন্দ্রশেখর বাবুর বাড়ির নাম টি হল " সোনার তরী" । শুধু বাড়ির নাম ই নয়, তাঁর বাড়ির সদস্য দের নাম ও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি থেকে সযত্নে তুলে আনা -- "ঘরে বাইরে"র নিখিলেশ, " গোরা" র সুবিনয় ইত্যাদি। প্রত্যেক সদস্যই কোনো না কোনো ভাবে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে যুক্ত, তাদের ও আছে নিজস্ব টানাপোড়েন। গল্পের নায়িকা হল পুপে ওরফে সোহিনী, চন্দ্রশেখর বাবু র নাতনি। গানের গলা চমৎকার এবং নিয়মিত ভাবে হারমোনিয়াম, তানপুরা র মূর্ছনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করেন। আর অন্যদিকে গল্পের নায়ক গোরা, যার জীবনে ও রবীন্দ্রনাথ ভীষণভাবে আছেন, তবে রবীন্দ্রচর্চা টা তার একটু অন্যরকম।। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নতুন এক্সপেরিমেন্ট করে সে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে।। অন্যভাবে সুন্দর রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে গানগুলোয়।। আর এখানেই বাধে সংঘাত। সোজাসুজি একদম হারমোনিয়াম - তবলা আর গিটার- ড্রাম এর মধ্যে লেগে যায় নারদ নারদ।। যদিও অবশেষে গোরা - পুপে র প্রেম মিলনে দুই ভিন্ন সত্তা মিশে গিয়ে দুই ভিন্ন মেরুর রবীন্দ্র চর্চা একসাথে সহাবস্থান করে।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ কে মর্মে মর্মে উপলব্ধি না করলে এই ধারাবাহিক বানানো সম্ভব নয়। রীতিমত কবিগুরুর জীবনদর্শন কে অন্তঃকরণে উপলব্ধি করে তবেই এই কাজ সম্ভব। তাই জন্যেই তো হালফিলের রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে হিপোক্রেসি র চূড়ান্ত সমালোচনা করেছেন গল্পকার , ঝিনুকের ঠাকুমা সুচরিতার মাধ্যমে , " আরে বাবা, বাড়ির নাম "সোনার তরী" রাখলেই কি আর রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হওয়া যায়?!" বারবার এরকম সংলাপের মধ্যে দিয়ে, বিভিন্ন ঘটনা স্রোতের মধ্যে দিয়ে একটাই কথা বারবার উঠে এসেছে, রবীন্দ্রনাথ একটা প্রবহমান দর্শন এর নাম। তাকে কোনো নির্দিষ্ট ধাঁচে ফেলা সম্ভব নয়। ধারাবাহিক টি যে ভাবে তথ্যসম্বলিত তাতে অস্বীকার করার উপায় নেই যে নির্মাতা রা বেশ ভালো রকম হোম ওয়ার্ক করেই মঞ্চে নেমেছিলেন।। ঠাকুরবাড়ির সন্তানদের নামকরণের বিধি থেকে শুরু করে কবিগুরুর কোন ঋতুতে কি ফুল প্রিয় ছিল তার সমস্ত ধারাবিবরণী পাওয়া যায় এই ধারাবাহিকে।। এবার আসি ধারাবাহিকের মূল উপজীব্য বিষয়, যা কিনা এক ই সাথে বিতর্ক সভার বিষয় ও হতে পারে, বিষয় টি হল , রবীন্দ্রসঙ্গীত কে কি ভাঙ্গা গড়া যায়? কেউ এর পক্ষে বলবেন , কেউ বা বিপক্ষে।। ধারাবাহিক টির ভীত মূলত এই বিতর্ক টাকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।। গোরা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে সেটা পরিবেশন করে এবং তার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে কোথাও না কোথাও বারবার এই ভাবনা উঠে এসেছে, যে রবীন্দ্রপ্রেম বা রবীন্দ্রনাথ ও তার জীবনদর্শন এর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ শুধুই হারমোনিয়াম, তবলা , তানপুরা, পাট করে পরা শাড়ি , ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি কিংবা বসার ঘরের শো কেস এ সাজানো গীতবিতান , সঞ্চয়িতা দিয়েই বোঝানো যায় না, ওগুলো কেবলমাত্র রবীন্দ্রপ্রেম প্রকাশের অনেকগুলো মাধ্যমের একটা ।। রবীন্দ্রনাথ কে ভালোবাসতে গেলে এসব না থাকলেও চলে, রবীন্দ্র দর্শন কে অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করতে গেলে শাড়ি- পাঞ্জাবি না পরলেও চলে, গীতবিতান টা বসার ঘরে না রেখে পড়ার টেবিল এ রাখলেও চলে।।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, যখন গান নিয়ে বিভিন্ন কাজ মানুষ গ্রহণ করছে, রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়েও বিভিন্ন নতুন কাজ মানুষ পছন্দ করেছেন, তখন আমাদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট এর কথা শুনতে অতটা অস্বাভাবিক হয়ত লাগবে না, কিন্তু ঠিক দশ বছর আগে তখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট এর বিষয় ধারাবাহিকে উপস্থাপন কিন্তু খুব একটা সহজ ছিলনা। কারণ তখনও বাঙালির অন্তরে রবীন্দ্রনাথ "ঠাকুর" , আর রবীন্দ্রসঙ্গীত সেই ঈশ্বরের পুজোর অর্ঘ্য। গিটারের তারে রবীন্দ্রসঙ্গীত খেলানো বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক্সপেরিমেন্টাল রিমিক্স দেখানো নির্মাতাদের কাছে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ছিল। সামন্তক সিংহ এবং অন্যান্য আরো সংগীতশিল্পী রা মিলে যথেষ্ট দক্ষতার সাথে গানগুলি গেয়েছেন, কখনো গোরার গলায় অপ্রচলিত ধারার গান কখনো বা পুপে র কণ্ঠে ট্র্যাডিশনাল সুরের ছোঁয়া। সবটাই গাওয়া হয়েছে অসম্ভব ভালোবাসা এবং ডেডিকেশন দিয়ে।।
রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন কে যাঁরা বাস্তবিকই আত্মস্থ করতে পেরেছেন, তাঁরা জানেন, বিশ্বকবি নিজে ভাঙ্গা - গড়া এবং ছক ভেঙে নতুন সৃষ্টি তে কতটা বিশ্বাসী ছিলেন।। সুতরাং, রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নতুন ধরনের কাজ হলে নীতি পুলিশ হওয়ার কোনো যুক্তি নেই বলেই আমার ব্যক্তিগত মতামত, কবিগুরু নিজেও এ ধরনের কাজ দেখলে খুশি বই দুঃখিত হতেন না ।। তবে হ্যাঁ, ভাঙ্গা চোরা যাই হোক, নতুন সৃষ্টির মধ্যে প্রকৃত দর্শন টা অক্ষুন্ন রাখাটা বাঞ্ছনীয়।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন