ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০

সেই রাতে( অনুগল্প বিভাগ )

পারমিতা মন্ডল


দুপুরের সব কাজকর্ম সেরে চটপট রেডি হয়ে নেয় রাশি।প্রতীক কে আগেই বলে রেখেছে আজ একটি পত্রিকা প্রকাশিত হবে। সেই অনুষ্ঠানে যাবে সে। প্রতীকের রাশির এই লেখালেখি ব্যাপার টা বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি মনে হয়।ওর কাছে এটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়।তাই কোনো সমর্থন এর আশা না করেই শুধুমাত্র কর্তব্য বশত বলা। যাওয়ার সময় রাশি "এলাম" বললেও কোনো উত্তর দেয় না প্রতীক।

ফিরতে একটু দেরিই হলো।রাত আটটা। বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই বিভিন্ন প্রশ্ন বাণে বিদ্ধ হতে থাকে সে। বাথরুমে ঢুকে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।কলের জল পড়ার আওয়াজ কান্নার শব্দ কে আড়াল করে।আড়াল, হ্যাঁ এতো দিন পড়াশোনা বইপত্র সবার সাথে আড়ালেই থেকেছে রাশি। কিন্তু এই লেখার নেশা ওকে নিয়ে এসেছে সবার সামনে।আড়াল থেকে প্রকাশ্যে আসতে যে কত জ্বলন্ত কয়লার পথ অতিক্রম করতে হয়েছে ,এখনো হচ্ছে,আগামী দিনেও হবে এটা ভালো করে জানে বছর তিরিশের রাশি।

সকালে চা করতে যায় রান্না ঘরে। হঠাৎ পেছন থেকে শ্বাশুড়ি বলে ওঠে,"বৌমা, তোমার এই লেখালেখি করা বন্ধ কর, বাচ্চার দিকে সংসারের দিকে মন দাও। ভুলে যেওনা আমাদের বাড়ির একটা মান সম্মান আছে।" কথাগুলো এমন মনে হলো যেন কেউ জীবন কেড়ে নিতে চাইছে। নিমেষে চোখের জল মুছে শুধু আচ্ছা বলে চুপ করে গেল রাশি।

কিছুদিন পরেই বিবাহ বার্ষিকী।দশ বছর।প্রতিবার ই সোনার জিনিস উপহার দেয় প্রতীক।এবার রাশি একদিন সন্ধ্যায় আবহাওয়া ভালো দেখে প্রতীকের কাছে আবদার করে
- আমাকে একটা আলমারি বানিয়ে দেবে এবার? বইগুলো যত্ন করে রাখবো।
- কি বলছ, হ্যাঁ! আমার অত টাকা নেই যে তোমার বই রাখার জন্য আলমারি করে দেব!বরং বইগুলো বেঁধে পুরনো তাকে তুলে দেব!আর একটা কথা শুনে রাখ।এক পয়সা খরচ করতে পারবোনা তোমার বই কেনার জন্য।
- না, তোমাকে দিতে হবে না। আমার মা বাবা পুজোয় ষষ্ঠীতে পয়লা বৈশাখে শাড়ি কিনতে যে টাকা দেয় তা দিয়ে ই কিনবো।
- না, ভালো কথা বলছি, সংসারে মন দাও।এসব বাদ দাও, তোমার যা হবার হয়ে গেছে।আর এসবের দরকার নেই। মেয়েকে মানুষ কর।
- মেয়েকে কি আমি দেখি না?
- আরো দেখতে হবে।পড়ে দেশ উদ্ধার করবে না তুমি। যত্তসব ফালতু কাজ!লেখা তোমাকে খাওয়াবে?
মেঝের এক কোণে পড়ে থাকা বইগুলোর দিকে এক করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাশি।ওর যেন অস্তিত্বটাই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে ‌। একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে রাশি।
- কি বললে! আমার বই বেঁধে তাকে তুলে দেবে! দেখি কি করতে পারো তুমি। আমি লিখবো,পড়বো । Nobody can stop me.তোমার কথা মতো এটাতে হয়তো টাকা আসে না। কিন্তু এই জগতে ভাসতে ভালো লাগে আমার।আমার মনের খোরাক যোগায় এইসব।তুমি একজন উচ্চ শিক্ষিত হয়ে কিভাবে বল এসব? তোমাদের মতো পুরুষ মানুষের জন্য মেয়েরা পিছিয়ে। উৎসাহ দিতে না পারো এইভাবে অপমান কোরো না।আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ আমি বিশ্বাস করি পড়াশোনার কোনো বয়স হয় না।তাই পড়া লেখা থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না আমাকে।এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল রাশি।

রাত বারোটা।সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এতোক্ষণ চুপচাপ ছিল রাশি। আসতে করে উঠে বইগুলোর কাছে গেল সে।তারপর বইগুলোর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললো তোদের আমার কাছ থেকে কেউ কোনোদিন কেড়ে নিতে পারবে না। আমাদের বন্ধন ও বন্ধুত্ব অটুট।তারপর রাশি ওর প্রাণের বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। সে যেন এক যুদ্ধে জেতা সৈনিক হয়ে ওঠে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন