"কমলাকান্তের ভূত...
অল্প-স্বল্প শারদ বার্তা
(আর)খিটকেলে অদ্ভুত..."
সুপ্রকাশ অধিকারী
সকাল সকাল কমলাকান্তের সাথে দেখা। ভূমিকা না করেই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রথাগত ভঙ্গিতেই শুরু করলো- ইংরেজ'রা ব্যবসা করতে এসেছিলো এদেশে...অবশ্য তার বহু আগে থেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন জাতি ও তাঁদের কৃষ্টির সমন্বয় এই ভারত আত্মস্থ করেছে কিন্তু বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হয়ে উঠলো ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কবলে। এক্ষেত্রেও একতা'র অভাব ও মুনফা/পদলোভী দেশদ্রোহি প্রবৃত্তির চক্রান্ত জয়লাভ করেছে।
এখন তো আমার আবার মনে হচ্ছে পরিস্থিতি ও দিকেই মোড় নিচ্ছে। আমরা নতুন মোড়কে পরাধীন হয়ে যাচ্ছি না তো? হয়তো নতুন কোনো ইষ্ট ইন্ডিয়া ওঁত্ পেতে অপেক্ষায় ...
চায়ের কাপটা মাটিতে রেখে পুনরায় কমলাকান্ত জানতে চাইলেন-
আচ্ছা একটা সহজ প্রশ্নের উত্তর দেতো- দ্যাখনা, এই যে গোরু আমাদের মাতা, খুব ভালো কথা। জমজমাট করে আদর্শ গো-সন্তানেরা গো-মাতার পুজো করুক;প্রসন্নের গরুকেও কিছু খাবার-দাবার দিলে মন্দ হয় না...সব ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাটা, যে দেশের দ্যাবতা গরু তারই মাংস রপ্তানি করে দেশ আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করবে এটি কি প্রকারে সম্ভব কিছুতেই মস্তিষ্কজাত হচ্ছে না।
এমনি আরো কত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কমলাকান্তের মাথায়! এতবড় মাপের মানুষ দু-টো কথা বলছে, কাজ থাকলেও না শুনে কি উঠতে পারা যায় ? কমলাকান্ত পুনরায় বলে উঠলো-
নেতাজীর অতৃপ্ত আত্মা ফাইল ঘেঁটে ঘ করেও কিচ্ছুটি পেলো না! রাজীব কুমার পদ্মবনে না কিষাণ বাবুর দেশে খবর নেই! দেশের কালো টাকা আর সুইস ব্যাংকের টাকা মিলিয়ে কিছু পেলে প্রসন্নকে বিদেশ ঘুরতে নিয়ে যাবো কথা দিয়েছিলাম, এ জন্মে সে সাধ আর মিটলো না! গুজরাটি বেনিয়া'দের সঙ্গে এ রাজ্যের বেনিয়াদের কতটা সদ্ভাব সেটাও টের পাচ্ছি না। পোড়া কপাল! নইলে আঁতাত করে নীরব-বিজয়'দের কাছে ঠাঁই নিয়ে মজ-মস্তি করে শেষ জীবনটা কাটানোর একটা সুযোগও পেতুম? সেগুড়ে বালি,তা আর হলো কই? ছত্রধর আর চিদাম্বরম এর জেলখানার ব্যবস্থার বাস্তব পার্থক্য কি সে খবরটাও কেও দিচ্ছে না...এইসব প্রশ্ন করে কমলাকান্ত সাতসকালেই মাথাটা আমার খারাপ করে দিলো।
আমি বললাম তা সমালোচনা না করে আপনাদের মত ভালো লোকদের তো দেশের কাজে লাগা উচিত্!
ধ্যুৎ শালা বলে, দাঁত খিঁচিয়ে কমলাকান্ত বললো- আমি তো আফিম খোর আমার কথা ছাড়! যদিও আমার ক্ষমতা নাই কিন্তু বঙ্কিম চাটুজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাতে পুরোনো দু-একজন এখনো এক আধটু সম্ভ্রম করে; সেদিন মিছিমিছি দুজন ভালো লোককে হুট করে দুটো পদের অফার করলাম। কি বললো জানিস?
টিকিট নেওয়ার জন্য কত লাগছে? কত টাকা ফাঁসাতে হবে? রিটার্ন কি? আর জেতার পর অন্য দলে গেলে কত রেট উঠবে?
আমি জানি ও ভীষণ সৎ ও ভালোমানুষ তাই ভেতরের কষ্ট থেকেই বলছে; আমি ফের বললাম- ওরে ক্ষ্যাপা, ওসব ল্যাফরা নাই একজন সৎ মানুষ কে চাইছি। দু-পা চেপে ধরে বললো আপনার বাড়িতে মাহিন্দারি করবো, দয়া করে আমায় পদ থেকে নিষ্কৃতি দেন।
আছে রে, আছে! এখনো পৃথিবীতে ভালোমানুষই বেশি আছে...
সকাল সকাল মানুষ'টার একটু সেবা করতে পারলে তৃপ্তি পেতাম। কিন্তু,পোস্তর এত দাম এখন, কমলাকান্তের জন্য আফিম জোটানো আমার সাধ্যের বাইরে। ভগবান আছে!
ভাগ্যিস ঠিক সময়ে প্রসন্ন দুধ'টা নিয়ে এসেছে, আপাতত আফিম থেকে বাঁচা গেল।
প্রায়শই ভাবি, আচ্ছা! প্রসন্ন যদি না থাকতো আর মদের দোকানের মত দুধের দোকানের লাইনে যদি কমলাকান্তের মত মানুষকে জি,এস,টি,-সার্ভিস ট্যাক্স সমেত খাড়া হতে হতো...আহা বেচারা! তবে দুধের অভাবে নির্ঘাত বেঘোরে প্রাণ যেত লোকটার।
ঘঁটি সমেত দুধটা চুঁক চুঁক করে এক নিমেষে শেষ করলো কমলাকান্ত।যাক বাঁচা গেল,আপন খেয়ালে বিড়বিড় করতে করতে নিমেষে হাওয়ার মত কোথায় মিলিয়ে গেল সে।
কিন্তু এ কি হচ্ছে আমার? কমলাকান্ত আজ মাথাটাই ম্যাজিক করে কেমন যেন বিগড়ে দিয়েছে, এ সব কি ভাবছি আমি...
সত্যিই তো, গুজরাটিরা ভুজিয়া-আচারেও চালিয়ে নেবে... আমার তো শালা পান্তা ভাতে পেঁয়াজ মাস্ট। গতবার ঘরে চাষের মাল ফেলে দিলাম আর এবার কিনতেও চোখে জল ছাড়াতেও চোখে জল। পেঁয়াজ থেকে আপেল সস্তা,কিন্তু কুকুরের পেটে ঘি যদি সহ্য না হয়?তারপর বাংলাতে-হিন্দিতে সব চুল উঠে গেলে বোঝো ঠ্যালা!
একের পর এক কমিশন বসবে,স্যালারি বাড়বে,মানুষের গড় আয় বাড়বে,অথচ নীরবে সমস্ত ভোগ্যপণ্যের দাম তার থেকে অনেক গুণ করে বাড়বে। নিম্নবিত্ত- চাষি আর দিনমজুর' দের যে কি অবস্থা কমলাকান্ত সেসব হেঁসেলের খবর দিনরাত রাখে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে রাশ না টানলে আয় বৃদ্ধির কি মূল্য ভবা জানে ?
বেনিয়ারা এবার ধীরে ধীরে ব্যাঙ্ক-রেল-হাসপাতাল সব গ্রাস করবেন। লাভ হলে ওনাদের, লস হলে পাবলিক গেলো ভোগে।
"ঘরে রাখলে জ্বালা
ব্যাঙ্কে রেডি তালা,
সুযোগ পেলে
কামিয়ে নিয়ে
দেশ ছেড়ে পালা।"
ক্ষাপা খাবি কি ঝাঁজেই মরে যাবি!
আপনি কর্পোরেট লোক, কুটুম-গুষ্টিও সব মালে মালামাল। একফোনে কয়েকঘন্টায় আপনার অ্যাকাউন্ট গরম। বড় সাবসিটির ভালো লোন'টা বা বিনিপয়সায় সরকারী জমি'টা বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আপনিই পাবেন। অথবা যদি বুদ্ধি বিক্রি করা কলম বা তৈলাক্ত শিল্প'জীবি হন দু-একটা পুরস্কার বা লটারির ফ্লাট অথবা ভবিষ্যত গোছানোর মত কিছু না কিছু আপনার হকে আছেই। কিন্তু হরেণ কাকার চারকাঠা জমির দলিল এ তিরিশ হাজার পাওয়াটা যে কি ঠ্যালা সে ত্যাল যাকে মারতে হয় সেই জানে!
কে ইলেক্টেড আর কে সিলেক্টড এটা এখন অনেকের হাবভাবেই প্রকাশ পায়। দিদি কে, দাদা কে অনেককে বলার এখন অনেক মাধ্যম; কিন্তু ঘরে বড় ডাকাত আর কেশ খাচ্ছে চোর। এখন সারা দেশ জুড়ে সব সেক্টরে টার্গেট জব। থানা হোক অথবা ব্যাঙ্ক ;এত কেস চাই পুজোর আগে; ওদিকে মিউচুয়াল ফান্ড বিক্রি করো নয়তো ব্রাঞ্চ উঠে যাবে...ডাকবাবু-ব্রেনবাবু সমস্তটা এভাবেই সরকারী মোড়কে "কোম্পানি সিস্টেমে"র মধ্যে বেঁধে ফেলছে; গোদা বাংলায় "নব্য ইষ্ট ইন্ডিয়া ক্যাপচারিং।"
একটি বিষয়ে আলোকপাত না করলে কমলাকান্তের মত মানুষ কে অপমান করা হয়। প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনপ্রতিনিধি দ্বারা কৃত বৈষম্য ও দলের এবং স্বজনপোষণের এক বিস্তর দলিল চিত্রগুপ্ত ডেইলি লোড করছে...
কোনো ব্যক্তি যখন সেই দলের প্রতীকে লড়াই করে ততক্ষণ সে দলীয় প্রতিনিধি কিন্তু যখন সে জয়লাভ করে তখন তিনি জনপ্রতিনিধি। তখন তিনি দল-মত নির্বিশেষে তাঁর এলাকার সমস্ত মানুষের জনপ্রতিনিধি। আর এটাই তার রাজধর্ম। দলীয় জীবন ও সরকারী প্রতিনিধিত্ব মিশে গেলে ক্ষতিকর। একজন জনপ্রতিনিধি সেই এলাকার লোকাল গড; ঈশ্বরের কাছে কিন্তু প্রভেদ থাকে না।
গোটা দেশজুড়ে বিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিভিন্ন নির্বাচনে না লড়ে অনেকেই জনপ্রতিনিধি আছেন। তাঁদের মূলত তিনটে শ্রেণী।
প্রথম শ্রেণীতে অবশ্যই কিছু চরম ভালো বা চরম খারাপ'রা থাকেন;যাদের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে সাহস পায় না। কাউকে শ্রদ্ধায় কাউকে ভয়ে। কিন্তু যদি ভয় মেশানো শ্রদ্ধা থাকে তবে সেটা খুব ভয়ঙ্কর এবং ইমোশনাল টর্চার প্রবণ।
বাম আমলে ছাত্র ইউনিয়নের ভোটেও এরম অনেক রুটিন দেখেছি। বিপরীতে ছাতি ফোলানো অনেকেই বদ্ধ ইউনিয়ন রুমের নিদারুণ কাউন্সেলিং এ মুখ বুঝে নমিনেশন প্রত্যাহার করেছে ...অনেকটা হাগুর এপিট-ওপিট, শুধু বয়স খসে পড়ছে পাতার মত।
এ রাজ্যে জমি বিক্রি করে পার্টি করা কমিউনিস্ট'দের বিলুপ্ত করে কামিয়েনিস্ট গজানোর সময় যারা মাছ চুরি করতে শিখে ফেললো তারা কিন্তু পুকুর চুরির টেকনোলজি শিখতে পারেন নি। অবশ্য কেরালা ইংরেজি আর কম্পিউটার শিখবে আর বাংলা বর্গাদার-পাট্টা-খাস-কৃষক আন্দোলন-সাক্ষরতা ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকবে। কমরেড'দের টেকনিক্যাল হতে সময় লেগে গেল। হয়তো টেকনিক্যাল হতে পারেননি বলেই আজ পর্যন্ত কাউকে বিভিন্ন দপ্তরের নোটিশে সি,জি,ও কমপ্লেক্স দৌড়াতে হচ্ছে না।
সাতসকালে কমলাকান্ত কি ম্যাজিক যে করলো, সমস্ত কাজ ছেড়ে-ছুড়ে আকাশ পাতাল এসেই যাচ্ছে মাথার ঘরে।
যাক ছেঁদো কথা ছেড়ে এবার দ্বিতীয় শ্রেণী বলতে যে প্রাণী বোঝায় সেটা বলেই ফেলি। এদের ইয়েস ম্যান বলে, এরা সবেতেই থাকে, প্রয়োজন ফুরোলে নো ম্যানস ল্যান্ডে অপেক্ষা করে তাক বুঝে ঘর বানাবার।
সর্বশেষ তৃতীয় শ্রেণীতে যারা আছেন; তারা প্রতিপক্ষ থাকলে টিকিটের লাইনে যাবার রিস্ক নিতেন কিনা সন্দেহ আর এরা জানেন... যে কদিন আছি বাবা...গুছিয়ে নে। কমলাকান্ত থাকলে বলতো-মরার পরে শোবার জায়গাটাও তোর থাকবে না।
একটা ছোট্ট ফোঁড়া গ্যাঙরিঙ করে ফেলতে পারে যদি সঠিক সময়ে অপারেশন বা ড্রেসিং না হয়। কি বলতে কি বলছি, আচ্ছা এই কমলাকান্ত'র ভূত যে মাথা থেকে নামতেই চাইছে না।
এখন প্রায় সব পুকুর লিজ, হাইব্রিড মাছ। বাঙালি আজ যা ভাবে কাল তা দুনিয়া ভাবতো; ভেতো বাঙালি ওটস্ খাচ্ছে ওজন কমাতে, শরীরের সাথে মনের মিল না হলে বুদ্ধি ভাড়া তো করাই লাগে। অবশ্য এখানকার মাল অন্যখানে সাপ্লাই করে ডবল কামাচ্ছে না কি ফিডব্যাক কিছু উল্টোপথে এদিকের অ্যাকাউন্টেও ঢুকছে সব গোবিন্দই জানে; ও সরি! ব্রহ্মা জানে...
সবাই সবাই কে দেখছে... কিন্তু নিজেরা নিজেদের সমালোচনা করতে খুব দুর্বল ...ধর্ম এমন একটা স্পর্শকাতর জায়গা যা জীবনের বাঁচা-বাড়াকে পুষ্ট করে কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ও কূট-কৌশল নতুন মহাভারত না রচনা করে? নগর পুড়লে... দেবালয়-মসজিদ কিছুই বাদ যাবে না! যাদের পেছনে পাঁচটা স্টেনগান গার্ড থাকে না সেই বিশাল সংখ্যক মানুষ এক কঠিন সময়ের মধ্যে অস্তিত্ব আর পিঠ বাঁচাচ্ছে। বিচার করুন...নইলে অকাল বর্ষার মত অকাল পরাধীনতা দেশের মাথায় নটরাজ হয়ে নাচবেন।
ভুলে যাবেন না-
"রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়...
তাঁদের কিন্তু মৃত্যু নাই,
শহীদ সাজবে মোদের ভাই।"
রাজনীতিতে চিরস্থায়ী সত্য বলে কিছু হয় না...
একবার মন কে প্রশ্ন করে দেখবেন... আগামী দুই যুগ পর নতুন ভোটার না আসা পর্যন্ত আপনি জেতার জন্য নিরাপদ তো?
এতো ধানে ভাঙতে শিবের গীত গায়ছিলাম। যাক বাঁচা গেছে, কমলাকান্তের ভূত মাথা থেকে ঘাড় হয়ে পেট দিয়ে বায়ু হয়ে বেরিয়ে গেছে।
আসল কথাটা তো বলাই হয়নি। এবার বলি- ভাদ্র মাসে কেবু কাকার কাহিনী আজও মিস করি। ছোট্ট বেলার বাচ্চু, কালিফটকা, টু-সাউন্ড, টিকলি, পিঁয়াজি,রকেট,তুবড়ি চালের ছাউনির নীচে বারান্দার টিনের চালে আশ্বিনের রোদে শুকোতে দেওয়া আজও মিস করি। কটার'দার আলকাপে ছোঁকড়া সাজার গল্প আর ভাসানে শিখিল'দার মায়ের নাচ খুব মিস করি। এত আয়োজন তবু হয়তো শরতের অকাল বর্ষায় কারো দুগ্গা কাঁদছে কারো দুগ্গা হাঁসছে। ...তবু বিজয়ার দিনে রাগ-দুঃখ-অভিমান ভুলে আজও গোটা গ্রাম এক হয়ে যায়। এমনি করেই বেঁচে থাক সুখে থাক আমাদের দুগ্গারা। সবাইকে শারদীয়ার শুভেচ্ছা।
ভালো থাকবেন-ভালো রাখবেন-জয়গুরু।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন