ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০২০

গল্প - অর্পণ বসাক

বিসর্জন
অর্পণ বসাক

দুর্গা আমার পাশের বাড়ির রথীন কাকার মেয়ে।আমার মা ওকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসত।দুর্গাও মাকে বেশ খাতির করত মাসি মাসি করে। ছোট থেকেই একটা উরণচন্ডী মেয়ে ছিল দুর্গা।তবে ওর মনটা বেশ ভালো।পড়াশুনায় কিন্তু দুর্গা বরাবরই স্যার ম্যামদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এবারে কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটির দরজায় পা রেখেছে আমাদের দুর্গা।ও নিজের খরচ নিজেই চালাত।টিউশনি পড়িয়েই নিজের কলেজের ফিস,ভাইয়ের বই কেনা,মায়ের ঔষধ চালাত।বাড়তি টাকাটা জমিয়ে বস্তির ছেলেমেয়েগুলোকে ও রোজ চকলেট দিত,আবার কারো জামা ছিড়ে গেলে জামা।লক ডাউনের আগে দুর্গার জীবনটা ছিলো ঠিক একটা হলুদ ফিঙের মতো,গোটা আকাশ যেন ওর একার।একাই দাপিয়ে বেড়ায়।ডানা ঝাপটায়।নীল আকাশের বুকে যেন তুলি দিয়ে রূপকথার স্বপ্ন লেখে।

       কিন্তু পৃথিবী জুড়ে মহামারী নেমে এলে শুরু হয় লক ডাউন।লক ডাউন যেন হলুদ ফিঙের মতো দূর্গার পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে দিলো।দুর্গার ইউনিভার্সিটির ক্লাস এখন অনলাইনে হয়।কিন্তু নেটপ্যাক সেটা ভরতে পয়সার দরকার।নেটপ্যাক ছাড়া দুর্গা ক্লাস করবে কি করে?এদিকে সোশ্যাল ডিস্টেন্স  মানতে গিয়ে দুর্গার টিউশনিও গত দু মাস ধরে বন্ধ।হাতে পয়সা নেই।যাদের কাছে বেতন পাবে তারাও হয়ত তার মতোই ,কিংবা কেউ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে এসব ভেবে দুর্গা আর বেতন চাইতে পারে নি।অগত্যা বাবার কাছে এই প্রথমবার দুর্গাকে হাত পাততে হলো।ভরা হলো নেটপ্যাক।অভ্যস্ত না হলেও এক এক করে মানিয়েও নিতে পেরেছিলো অনলাইন ক্লাসগুলো।

   একে করোনার ছায়ায় এঁটে উঠতে না পেরে ভয়ানক অশান্তি, তার ওপর যেন আম্পান দুর্গাদের পরিবারকে যেন পঙ্গু করে দিলো।দূর্গার বাবা রথীন কাকার সব ধান আম্পানে নষ্ট করে দিলো।একে বারে যাকে বলে পাকা ধানে মই।গোটা বছর খাবে কি দুশ্চিন্তায় ঘুম নেই দুর্গাদের।তারপর আরাক অশান্তি মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। ইউনিভার্সিটি নোটিশ জারি করেছে দ্বিতীয় সেমিস্টারে ভর্তির ফিস জমা দিতে হবে খুব শিগগিরই।এই দুঃসময়ে এত টাকা পাবে কোথায়?দুর্গা আর ভর্তির কথা বাবা কে জানায় নি, কারন একে সব ধান ডুবে যাওয়ার বাবা দুশ্চিন্তায় ভুগছে তার ওপরে ভর্তি এত গুলো টাকা কোথায় পাবে বাবা। এই অসময়ে বাবার থেকে তাই টাকা চাওয়াটা আর হলো না দূর্গার।

         কোনোদিন কারো কাছে দুর্গা মাথা নোয়াই নি।এই কটা টাকার কথা কি স্যারদের বলবে?না থাক।স্যারদের বললে মধ্যবিত্ত  বাবার সম্মানে লাগবে।বললে বাবা যে ছোট হয়ে যাবে।তাই আর বলা হয়ে ওঠেনি দূর্গার।

           দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা দুর্গার আকাশে যেন কালো অন্ধকার মেঘে ঢেকে দিলো।কোনো দিন হারতে না শেখা মেয়েটা এই যুদ্ধ জিতবে কি করে?দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছিলো না দূর্গার।

     দুর্গা হেরে যেতে ভয় পায়।দুপুরে খাবার পর সবাই যখন ভাত ঘুম দিয়েছে তখন দুর্গা আলমারী থেকে কলেজের প্রথম হয়ে পাওয়া গোল্ড মেডেল টা নেড়েছেড়ে দেখছিল।

     দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে।আকাশে সন্ধাতারা জ্বলজ্বল করছে। দূর্গার মা দুর্গাকে ডাকছে ।কিন্তু দুর্গা কোনো উত্তর দিচ্ছে না।দরজাও খুলছে না।বোধয় একটু বেশিই ঘুমিয়ে গেছে।অনেক্ষন ডেকে না পেয়ে জানালার প্লালা দিয়ে দূর্গার মায়ের চোখ ঘরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে ছিল।দূর্গার বাবা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে দরজায় ধাক্কা মেরে দরজাটা ভেঙে ফেলে।ঘরে গিয়ে দেখল লাল পাড় একটা সাদা শাড়ি পরে আছে দুর্গা। একহাতে সেই গোল্ড মেডেল।পায়ের কাছে প্রত্যেকটা পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার মার্কশিট।অন্যহাতে একটা ছোট্ট চিরকুট তাতে লেখা "শিক্ষা কারো মৌলিক অধিকার নয়!"  আর গলায় ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে ফাঁস।

           হেরে যাওয়ার ভয়ে দুর্গা যেন পালিয়ে বাঁচল।ঠিক যেমন কুমোরটুলিতে বোধনের আগেই আম্পানের বৃষ্টিতে বিসর্জন হলো মাটির দূর্গার তেমনই।যেখানে অকাল বোধনের কথা ছিলো থেকে অকাল বিসর্জন হলো।

    পরদিন সকালের পেপারে দূর্গার ছবি দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা, "লকডাউনে ভর্তির ফিস জোগাড় করতে না পেরে আত্মঘাতী এক ছাত্রী।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন