ছুটি
প্রেমা নাহা বসাক
মা, আকাশের চাঁদটা দেখ্, কেমন গোল ,কেমন সাদা ... যেন এক থালা ভরা সাদা ভাত। "- ক্লান্ত জড়ানো স্বরে কথাগুলো তার মাকে বলে মুনিয়া। মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে সে, মা আলতো আলতো ভাবে ফাটাফাটা চামড়ার আঙুলগুলো দিয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে তার, আর ওই ঘুমপাড়ানিয়া গানটা গুনগুন করে চলেছে ক্ষীণস্বরে-
সোনা ঘুমুলো পাড়া জুড়ুলো
বর্গি ইলো দেশে
বুলবুলিটো ধান খেয়েছে
খাজনা দিবো কিসে
মুনিয়ার পেটে নিদারুণ ক্ষিদের যন্ত্রনা। আজ কতো দিন হলো খাবার খায়নি সে। ... মায়ের গুনগুনানি গান চোখে ঘুম আনে। গভীর ঘুম। ঠিক যেমন ভাত খেলে ঘুম ঘুম পায় সেরকম মিঠে ঘুম আছে এই সুরটায়। একবার ঘুমোলে আর ক্ষিদে পায়না। ঢুলুঢুলু চোখ মুনিয়ার ... চোখের সামনে ভাসতে থাকে টুকরো টুকরো কিছু ছবি - গ্রামের ইস্কুলটা , মিনু ,বসির, ছুট্টন, গুড়িয়ারা, খেলছে একসাথে, ওরা পড়ছে একসাথে। স্কুলের ঘরটায় দুপুরে হাঁড়িতে ভাত চড়েছে - ফুটছে টগবগ্ টগবগ্ টগবগ্। পেটের ক্ষিদে টাও ফুটছে সাথে যেন টগবগ্ টগবগ্ টগবগ্ ......
ইস্কুলে গেলে ভাত মেলে, ওই ইঁটভাটাটায় রোদে পুড়তে ভালো লাগেনা মুনিয়ার। রোজের বাসি শুকনো রুটি আর সেদ্ধ মেটে আলু খেতে পারেনা আর। মাস্টার বলেছিল, "পড়ালেখা করলে অনেক বড়ো হবি, অনেক টাকা পয়সা হবে" রোজ ভাত পাবো, ডিমও খাবো রোজ। স্কুলটায় তো ওই একদিন ডিম দেয়। তাতে কি ... মুনিয়ার ওই ভাতই অনেক। ভাত খেতে ওর বড্ড ভালো লাগে যে।
ওই আবার, আবার পেটটা ডাকছে ... কেমনধারা মোঁচড় দিচ্ছে যেন। বারবার... উফফ্! ... আজ কি বার যেন! রোববার? না শোনিবার? ... যেন দূর থেকে ভেসে আসা এক হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুনিয়া ... ইখন তো রোজ রোববার। রোজ ছুটি। রোজ ইস্কুল বন্ধ।
এই রোববার টা মুনিয়ার কোনোদিন ভালো লাগতো না। ছুটির দিন খাওয়া জুটত না যে ভালো। মা টোর সাথে ওই ইঁটভাটাতেও যেতে হতো দুপুর রোদে। ইখন তো রোজ রোববার। রোজ ছুটি। কিন্তু ইঁটভাটায় যেতে হয়না। কাজও বন্ধ। মালিক বলেছে কাজে আসতে না, কিন্তু কবে আবার আসব তা বলেনি। .... সবই বন্ধ।
মাস্টার বলছিলো - লোকেদের কি জানি কি রোগ হচ্ছে , ছুঁলে সে ছড়ায়... মহামারী। তাই সব বন্ধ থাকবে। মাস্টারও জানেনা কতোদিন। সেই থেকে পেটও বন্ধ। ইস্কুলে ছুটির সময় মা তে আর ওতে মিলে কিসুন্দর পেটপুরে দুটো ভাত খেতো। কই আবার কবে ইস্কুল খুলবে ভাত পাবে মুনিয়া জানে না। মাস্টার কাল জানিয়ে গেছে, ইস্কুলে চাল দিয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি ... কিন্তু আসবে কিভাবে , গাড়িগুলানও যে বন্ধ। তবু আসবে বলেছে, মাস্টার মিছে কয়না। ততদিন.....আঃ মা .... যন্ত্রনায় কুঁকড়ে ওঠে মুনিয়া। মা টার দিকে তাকিয়ে দেখে মা ঘুমে কাদা। গরম নিশ্বাস পড়ছে মুনিয়ার মুখে। বেঁচে আছে তবে এখনও ।
এরপর দিন মাস্টার এলে জানতে চাইবে মুনিয়া - কি রোগ এলো রে মাস্টার? এ রোগ মানুষ মারে না কি এ রোগে খাবার না পেয়ে মানুষ মরে? ছুটি তো মুনিয়া ভালোবাসে না। ভাত ভালোবাসে, ইস্কুল ভালোবাসে, ওই পড়ালেখাটো ভালোবাসে.... এ ছুটি ভালোনা, সব বন্ধ, কাজ বন্ধ, ইস্কুল বন্ধ, পেটও বন্ধ .... ঘুম জুড়িয়ে আসে মুনিয়ার দুচোখে। একটা সুর একটানা ভাসতে থাকে কানে-
সোনা ঘুমুলো পাড়া জুড়ুলো
বর্গি ইলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দিবো কিসে।
প্রেমা নাহা বসাক
অসাধারণ লেখনী
উত্তরমুছুন