অনুরাগী
কলমেঃ- অরিত্র কাঞ্জিলাল
কাকতালীয় বা co-incidence মানে, এমন কোন ঘটনা যা আকস্মিক ও সমসাময়িক, এবং তার সাথে অন্য কোনো ঘটনার আশ্চর্য সাদৃশ্য। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, এরম অনেক ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে নাজেহাল হতে হয়, এবং হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে, সেই ঘটনাকে কাকতালীয় বলে অভিহিত করতে ভুলি না আমরা। তাই যখন প্রণব বাবু সকালে বাজার করে ফেরার পথে, পঞ্চার চায়ের দোকানের সামনে লোকটাকে দেখে ফেললেন রেললাইনের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানতে, একটু ছেলেমানুষী উত্তেজনা অনুভব করলেও, নেহাত ই চোখের ভুল ভেবে পা চালিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
চায়ের দোকান থেকে প্রণব বাবুর বাড়ি প্রায় ৭ মিনিট হাঁটাপথ। রিক্সা নেওয়ার অভ্যাস নেই, এই ৬৪ বছর বয়সেও দিব্যি হেঁটে বাজার করেন, দিনে দুবার করে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে গিয়ে টবে লাগানো গাছের পরিচর্যা করেন, এমন কি রোজ বিকেলে, দক্ষিণের রাস্তার ওপারে যে মজে যাওয়া পুকুর টা আছে, তার পাশ দিয়ে প্রায় চল্লিশ মিনিট ইভিনিং ওয়াক, প্রণব বাবুর বার্ধক্য কে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে দেয়নি। স্ত্রী গত হয়েছেন বছর চারেক আগে, ছেলে পরিবার সমেত কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরুতে থাকে। বছরে নিয়ম করে দুবার বাড়ি আসেন, দায়িত্ববান ছেলে। বাবার জন্য একজন সবসময়ের চাকর রেখেছেন গত বছর থেকে, সে ই রান্নাবান্না করে।
বাড়ি ঢুকে, বাজারের থলি টা রান্নাঘরের দরজার সামনে নামিয়ে দিয়ে হাঁক পারলেন প্রণব বাবু, " রাখাল, এক কাপ চা দে তো। আর আজকে চিংড়ি এনেছি, দুপুরে এঁচোর চিংড়ি করবি।" এই বলে, ড্রয়িং রুমে ঢুকে, সোফাতে গা এলিয়ে দিলেন। সকালের আনন্দবাজার টা টেবিলের ওপর রাখা। হাতে তুলে নিয়ে, পাতা উল্টাতে গিয়ে, ৪ নম্বর পাতার বা দিকে নিচের দিকে একটা ছোট্ট হেডলাইন চোখে পড়ল, " কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে চাঁদের হাট, আজই যোগ দিলেন বলিউডের প্রবীণ শিল্পীরা"। খবরটা আরো পড়লেন প্রণব বাবু, "আজই কর্তৃপক্ষের নিমন্ত্রণে, কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিতে মুম্বই থেকে এলেন মিস মালা, অনুপম শাহ, রমেশ খান্না সহ আরও অনেক বর্ষীয়ান অভিনেতা ও অভিনেত্রী।" চোখটা বিস্ময়ে কপালে উঠল। পঞ্চার চায়ের দোকানের সামনে দেখলেন তো আসার সময়, সেই মাথা ভরা চুল, সেই সোনালী ফ্রেমের চশমা, সেই কোমরে হাত রেখে চিরসবুজ দাঁড়ানোর ভঙ্গি। রমেশ খান্না কলকাতায় এসেছেন আজকে, আর আজকেই তিনি দেখছেন ওনাকে, পঞ্চার চায়ের দোকানের সামনে, রেল লাইন দেখতে দেখতে সিগারেট খেতে! এ যে কাকতালীয় ব্যাপার!
রমেশ খান্নার চলচ্চিত্র "চাঁদ মেরা দিল" দেখতে একসময় কলেজ কেটে পাঁচিল টপকেছেন প্রণব বাবু। প্রথম দৃশ্যেই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন, শেষ সিনে যখন ভিলেন কে পিটিয়ে পাটকেল করে দিচ্ছেন রমেশ খান্না, তখন থেকেই ফ্যান। তারপর থেকে, জামার রং, প্যান্টের সেলাই, জুতোর পালিশ, লম্বা চুলের টেরি, সব কিছুতেই অনুপ্রেরিত হয়েছেন প্রণব বাবু। পেপার কাটিং, পোস্টার জোগাড় থেকে শুরু করে গানের কথা, এমনকি ফিল্ম ম্যাগাজিন ঘেঁটে রমেশ খান্নার নাড়ি নক্ষত্র অবধি মুখস্ত করে ফেলেছেন তিনি। যৌবন কাল অবধি নিজেকে একদম টানটান রেখেছিলেন, শুধু রমেশ খান্নার মত স্বাস্থ্য ও ফ্যাশন করবেন বলে। কিন্তু, বিধি বাম, প্রণব বাবুর ঘাড় অবধি লম্বা চুল, চল্লিশ পেরোনোর আগেই পালিশ করা মার্বেলের মত চকচকে হয়ে গেল। যারা, প্রণব বাবুর এই অনুপ্রেরনার ব্যাপারে জানতেন, তারা সামনে চুক চুক করে সমবেদনা জানালেও, আড়ালে মুখ টিপে হাসতে শুরু করল। প্রণব বাবুর প্রতি সহানভূতিশীল হয়েই বোধ হয় ভগবান, রমেশ খান্নার পর পর ১১ খানা ছবি ফ্লপ করে দিলেন, এবং চলচ্চিত্র জগৎ ও বেশি দেরি না করে নায়কের আসন থেকে তাকে নামিয়েও দিল। প্রণব বাবুও সিনেমা দেখা এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছেন তারপর।
সেই রমেশ খান্না! তাও কিনা পাতিপুকুর স্টেশনের ধারে সিগারেট টানছেন, অথচ কেউ তাকে চিনছে না! কেউ সেলফি বা নিদেনপক্ষে অটোগ্রাফের জন্য ঝুলোঝুলি করছে না। এটা কি তবে প্রণব বাবুর মনের ভুল? নাকি, রমেশ খান্না কে আজকাল আর কেউ চেনেই না? মনে মনে হিসেব করলেন প্রণব বাবু, তার নিজের বয়স ৬৪ মানে, রমেশ খান্না ৭০, তার নিজের থেকে ৬ বছর বড়। ভদ্রলোকের শেষ হিট সিনেমা বেরিয়েছিল ১৯৯২ তে, আর তার চার বছরের মধ্যেই ১৯৯৬ সালে পাততাড়ি গুটিয়েছেন শেষবারের মত। তাও ২৪ বছর হল। এই ২৪ বছরে, খবরের কাগজ বা মিডিয়া উন্নতি করলেও, রমেশ খান্না থেকে গেছেন অন্তরালে। তাই আজকে খবরের কাগজে ওরম ছোট একটা সংবাদ নিছক আকস্মিক ই, এবং চোখে না পড়ার মতই। আর যদিও বা চোখে পড়ে, সেটাকে উপেক্ষা করবে শতকরা নব্বই ভাগ বাঙালি।
মনস্থির করে ফেললেন প্রণব বাবু, ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে। আর কেউ চিনুক বা না চিনুক, তিনি যে একসময় রমেশ খান্নার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, এবং মনে প্রাণে চেয়েছেন কাকতালীয় ভাবেই একবার যদি দেখা হয়ে যায়, আজ সেই পুরনো ছেলেমানুষী ইচ্ছাপূরণ করার একটা সুযোগ এসেছে। পঞ্চার চায়ের দোকানের সামনের লোকটা হয়তো রমেশ খান্না নন, তা বলে খোঁজ নিতে দোষ কি? আর ভাগ্যক্রমে যদি তিনিই হন প্রণব বাবুর সেই পুরনো অনুপ্রেরণা, তাহলে অবশ্যই কোনভাবে ঠিকানা জোগাড় করে একটা সেলফি তুলবেন তিনি। যে গুটিকয়েক বন্ধু বান্ধব আছেন, তাদের দেখাবেন।
বিকেলের দিকে বেরিয়ে পঞ্চার দোকানে গিয়ে বসলেন প্রণব বাবু, এমনিতে তিনি রাস্তাঘাটে চা বিশেষ খান না, তবুও দুধ চিনি ছাড়া লিকার আর একটা খাস্তা বিস্কুট বললেন। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, "হ্যাঁরে পঞ্চা, আজকে সকালে এক বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখলাম এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে, চিনিস লোকটাকে?" পঞ্চা ঘাড় তুলে একবার প্রণব বাবুকে দেখে হেসে বলল, " সারাদিন কত লোক আসে কাকু, অত কি মনে থাকে?" দমে না গিয়ে প্রণব বাবু আবার প্রশ্ন করলেন, "সিগারেট খাচ্ছিল লোকটা, এই আমার মতই লম্বা, মাথা ভর্তি চুল, পায়জামা পাঞ্জাবি পড়া ছিল, মনে করতে পারছিস?" পঞ্চা মাথা চুলকে টুলকে মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলল, "কিছু হয়েছে নাকি কাকু? লোকটা কে? চোর টোর নাকি?" প্রণব বাবু হো হো করে হেসে উঠলেন, কি যে বলে ছোকরা! তারপর ভাবলেন, পঞ্চা সেদিনের বাচ্চা ছেলে, ও আর কি করে চিনবে রমেশ খান্না কে। এসব ভাবার মধ্যেই, হঠাৎ মনে পড়ে গেল কথাটা প্রণব বাবুর, কোন এক পুরনো ফিল্ম ম্যাগাজিনে এক ইন্টারভিউ গোছের লেখাতে পড়েছিলেন। পঞ্চা কে ডেকে বললেন, "মনে কর তো, আজকে সকালে কোন ভদ্রলোক এসে বেনসন হেজেস এর সিগারেট চেয়েছিল কি না?" এবারে চোখ মুখে একটা হাসি খেলে গেল পঞ্চার, বলল, "হ্যাঁ, চাইল তো। আমার দোকানে রাখি না বলাতে, কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে, পাঁচ মিনিট পর এসে একটা চারমিনার ধরিয়ে নিল।" প্রণব বাবুর উৎসাহ বেড়ে গেল, তিনি যে ঠিকই দেখেছেন, এই বিশ্বাস টা বদ্ধমূল হতে শুরু করল। সঙ্গে আপসোস ও হতে লাগল, যে সকাল বেলাই সাত পাঁচ না ভেবে আলাপ করে নেওয়া উচিত ছিল।
-"ভদ্রলোক কোনদিকে গেলেন দেখেছিলি?"
পঞ্চা এবারে একটু অবাক হয়ে বলল, "হ্যাঁ, ওই তো সিগারেট টা খেলেন, টাকা দিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে চলে গেলেন বেলগাছিয়ার দিকে। কি হয়েছে কাকু? কে লোকটা?"
উঠে পড়লেন প্রণব বাবু, চা বিস্কুটের দাম মিটিয়ে, বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ছেলে কে একটা ফোন করেন।
-"হ্যালো বাবান, শোন না, তোর এক বন্ধু আছে না, টালিগঞ্জ পাড়ায়?"
-"হ্যাঁ, কৌশিক আছে, প্রোডাকশন দেখে। তোমার হঠাৎ টালিগঞ্জ পাড়ার বন্ধুর দরকার কেন?"
-"আরে, আমাদের সময়ের এক হিরো, রমেশ খান্না, তিনি এবারে এসেছেন ফিল্ম ফেস্টভ্যালে। একটু দেখ না, যদি কোন পাস টাস থাকে।"
-"ও! দাঁড়াও, ফোন করে দেখি, পাস জোগাড় হয়ে যাবে, তোমার ফোন নম্বর টা ওকে দিয়ে দিচ্ছি, তোমায় ফোন করে নেবে।"
মনে মনে বেশ একটা উত্তেজনা অনুভব করছেন। বাবানের বন্ধু কৌশিক ফোন করলে একটু যেন তেন প্রকারে খোঁজ নিতে হবে যে বর্ষীয়ান অভিনেতারা কোথায় উঠেছেন। এই পাতিপুকুরে এসে যখন সিগারেট খেয়ে গেছেন, তখন নিশ্চই কাছাকাছি কোথাও ই আছেন। দেখা হলে কিভাবে হাত মেলাবেন, কিভাবে সেলফি তুলবেন ভাবতে ভাবতে বাড়ি পৌঁছলেন প্রণব বাবু।
কৌশিকের ফোন এল রাত ৯:৩০ টা নাগাদ। প্রণব বাবু, তখন রাখালের হাতে বানানো তার প্রিয় এঁচোর চিংরি স্যোৎসাহে খাচ্ছেন। ফোনটা আসতে দেখে ধড়মড় করে উঠে ধরলেন। উল্টোদিকে গলা শোনা গেল, "হ্যালো, মেসোমশাই। কৌশিক বলছি, আপনার জন্য পাসের ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। আপনি কি কাল একবার সল্টলেক সেক্টর ওয়ানে, রূপসী বাংলা হোটেলে আসতে পারবেন? আসলে, আমিই আসতাম আপনার বাড়িতে, কিন্তু এই ডামাডোলে...। " প্রণব বাবু তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, "আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি চলে আসব, তুমি বাবা ওখানেই থাকবে তো?"
-"হ্যাঁ কাকু, আসলে অনেক প্রবীণ অভিনেতা অভিনেত্রী এসেছেন এবার, তাদের নিয়েই একটা ইন্টারভিউ হবে, সেটা কালকেই আছে। চলে আসুন, রমেশ খান্নার ফ্যান তো আপনি, বাবান বলেছে আমায়। দেখা করিয়ে দেব।"
ফোন টা কেটে, বেডরুমে গিয়ে বসলেন প্রণব বাবু। একটা যৌবনের উত্তেজনা অনুভব করছেন। মনে হচ্ছে, এক ধাক্কায় বয়স টা চলে গেছে ৩০ বছর আগে। পুরনো আলমারি টা খুলে, ওপরের তাক থেকে একটা ছোট ব্রিফকেস বার করলেন। ব্রিফকেস খুলে বের করে আনলেন, বেশ কিছু পেপার কাটিং। সমুদ্রতটে রমেশ খান্না, চোখে সানগ্লাস, বেল বটম প্যান্ট আর রঙচঙে শার্ট। মাথা ভরে আছে ঢেউ খেলানো চুলে। নিজের পুরনো কিছু ছবিও দেখলেন। মনে মনেই হাসলেন। চল্লিশের আগে অবধি, প্রণব বাবু যাকে বলে খটখটে জোয়ান, তারপরই...। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিজের চকচকে মাথায় হাত বোলালেন তিনি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলেন কিছুক্ষন। মাথায় একরাশ ঢেউ খেলানো চুল কল্পনা করার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। আসলে বিগত ২৪ বছর ধরে নিজেকে এরকম ই দেখতে দেখতে, সেই জোয়ান বয়সের প্রণব সামন্ত কে একপ্রকার ভুলেই গেছেন।
পরের দিন, কৌশিক ঠিক যেই সময়ে বলেছিল, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে বেরিয়ে পারলেন প্রণব বাবু। আজ তিনি পড়েছেন একটি সুন্দর বাটিকের পাঞ্জাবী ও পায়জামা। বেরোনোর মুখে ঘড়ি, মোবাইল, ওয়ালেট সব দেখে নিলেন একবার। আজকে তিনি প্রথমবার নিজের সেই কলেজ জীবনের আইডলের সাথে দেখা করার সুযোগ পাবেন। ট্যাক্সি ধরে চলে গেলেন সল্টলেক সেক্টর ওয়ান, রূপসী বাংলা হোটেল। গাড়ি থেকে নেমে, ভাড়াটা মিটিয়ে কৌশিক কে ফোন করলেন প্রণব বাবু, "হ্যালো কৌশিক, আমি এসে গিয়েছি বাবা। রিসেপশন এর সামনে বসে আছি।" কৌশিক জানাল সে ১০ মিনিটের মধ্যে আসছে। প্রণব বাবু শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রিসেপশনে, একটা সোফাতে বসে চারিদিক দেখতে লাগলেন। আর ব্যাপারটা চোখে পড়তেই, শরীরে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল।
রিসেপশনের দরজা দিয়ে হোটেলে ঢুকছেন, আর কেউ নই, স্বয়ং রমেশ খান্না! সেই সুস্বাস্থ্য, সেই সোনালী ফ্রেমের চশমা, সেই ঢেউ খেলানো কাঁচাপাকা চুল, একাত্তর বছর বয়সেও কি ব্যক্তিত্ব! কালকে এনাকেই তো দেখেছেন পঞ্চার চায়ের দোকানের সামনে! "কেন যে সিনেমা করা ছেড়ে দিলেন তিনি?" মনে মনে আপসোস করলেন প্রণব বাবু। কিন্তু, এখন আর আগের বারের মত সুযোগ ছাড়বেন না ঠিক করেই সোফা থেকে উঠে রমেশ খান্নার দিকে এগিয়ে গেলেন প্রণব বাবু। রমেশ খান্না কিছু বোঝার আগেই, আবেগের বশে, ধাই করে একটা প্রণাম ঠুকে বসলেন। রমেশ খান্না, কিছু বুঝে ওঠার আগেই, গড়গড় করে ভাঙা হিন্দি ও বাংলা মিশিয়ে বলতে শুরু করলেন যে প্রণব বাবু কত বড় ফ্যান, বারদুয়েক তো হাতটা করমর্দনের ভঙ্গিতে ধরে ঝাঁকিয়ে ও দিলেন। রমেশ খান্না, অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও, নিজেকে সামলে নিলেন, এবং কোন কথা না বলে প্রণব বাবুর কথা শুনে যেতে লাগলেন ও মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।
হঠাৎ, পেছন থেকে কাঁধে টোকা পড়ল। ঘুরে দেখেন কৌশিক।
-"কাকু, এই নিন আপনার ছেলেবেলার অনুপ্রেরণা, রমেশ খান্না।" বলে কৌশিক নিজের পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোকের দিকে ইঙ্গিত করলেন। এই প্রবীণ ভদ্রলোক, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ঠিকই, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা ও আছে, চামড়া সামান্য ঝুলে গেলেও, এখনও সুপুরুষ। কিন্তু, এ কি! ভদ্রলোকের তো মাথায় চকচক করছে তারই মত একটি টাক! ভিরমি খেলেন প্রণব বাবু, তাহলে এতক্ষন কার সাথে কথা বলছিলেন! চমক ভাঙার আগেই, প্রণব বাবুর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই সুপুরুষ, মাথা ভরা লম্বা চুল ওয়ালা ভদ্রলোক, এগিয়ে এসে কৌশিকের পাশে দাঁড়ানো প্রবীণ কে, গদগদ হয়ে প্রণাম করে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বললেন, "অধমের নাম কানাইলাল সাঁপুই, স্টেজে যাত্রা করতাম। পুরুলিয়া, আসানসোল এসব জায়গায় একসময় আপনার সঙ্গে মুখ ও চেহারার সাদৃশ্য আছে বলে, আপনার নকল করে অভিনয় করে নাম করেছিলাম বেশ। আপনি আপনার গুরু তুল্য।"
প্রণব বাবুর হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ টা বন্ধ হতে বেশ কিছুক্ষন সময় লেগেছিল। দেখা সাক্ষাতের পর্বে অপ্রস্তুত হওয়ার পরেও, রমেশ খান্না তার সাথে সেলফি তুলতে কোনরকম আপত্তি করেন নি, এমনকি গোটা চারেক কথাও বলেছেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ট্যাক্সিতে বসে মনে মনে হাসলেন প্রণব বাবু। এত কাকতালীয় ঘটনা ঘটে গেল আজকে, কিন্তু অনুপ্রেরণা আর অনুপ্রেরিত র এই যোগাযোগ বোধহয় কোন সমীকরনের মধ্যে আসে না। তার কানে তখনও বাজছে তার করা প্রশ্নে রমেশ খান্নার কৌতুক মেশানো উত্তর, " আসলে ১৯৯৬ থেকেই আমার চুল পড়ে টাক হয়ে গেল বুঝলেন, তাই আর রুপোলি পর্দায় আসতে ইচ্ছে হল না। অবসরই নিয়ে নিলাম।"