ফড়িং পোষার আনন্দ
মোশাররফ মাহমুদ
বাংলাদেশ ,ঢাকা
অনেকদিন আগের কথা । মাত্র মাদরাসা বন্ধ হয়েছে । ছাত্রবন্ধুরা সবাই যে যার বাড়িতে চলে যাচ্ছে । আমিও বাড়ির পথ ধরলাম । কিন্তু সেই ছোট বয়সেও বাড়িতে যেতে আমার মোটেও ভালো লাগত না । একা একা থাকতে হয় । পাড়ার ছেলেরা সারাদিন নিজেদের মতো করে ব্যস্ত থাকে । খেলাধুলায় মেতে থাকে । তাদের সঙ্গে আমি কখনো মিশতে পারতাম না, খেলতে ইচ্ছে হত না । আবার একা থাকতেও ভালো লাগত না ।
বাড়ির পূবপাশে আমাদের বিভিন্ন সবজি চাষ করা হত । আমি একাকী সেখানে হেঁটে বেড়াতাম । আনমনা হয়ে হাঁটতাম । মনে কোনো উচ্ছ্বাস কিংবা আনন্দ থাকত না । শুধু দিন গুণতাম- কবে মাদরাসা খোলা হবে!
একদিন বিকেলের কথা । সবজি ক্ষেতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটি ফড়িং দেখলাম । সবুজ ঘাসফড়িং।
অনেক ছোট । দেখতে অনেক সুন্দর আর চমৎকার তার রূপ । নিপুণ কারুকার্যের অপূর্ব সৃষ্ট । আমি তার সামনে হাত বাড়িয়ে ধরলাম । কিন্তু ফড়িংছানাটি বোধহয় একটু ভয় পেয়েছে । আমি বুঝতে পেরেছি । কারণ মৃত্যুকে যে সবাই ভয় পায়! এই ঘাসফড়িংও ভয় পেয়েছে । হয়ত ভেবেছে আমি তাকে মেরে ফেলব । মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত । আবার এই বৃহত মানবসম্প্রদায়ের কিছু মানুষকে ইঙ্গিত করেই তো বলা হয়েছে, "উলাইকা কাল আনআম, বাল হুম আযাল"!
আমি ঘাসফড়িংটিকে আদর করে দুহাতের মুষ্টিতে ভরে নিলাম । সে ভয়ে কাঁপছে । তিরতির করে কাঁপছে তার ডানা । আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম, 'ভয় পেয়ো না ফড়িংছানা । আমি তোমার যত্ন নিব, কষ্ট দিব না । তুমি আমার কাছে থাকবে । আমি তোমাকে রোদে পুড়তে দেব না, বৃষ্টিতে ভিজতে দেব না । যত্ন করে খাওয়াব, উপোষ রাখব না ।
মানুষ শখের পোষা প্রাণীদের একটা নাম দেয় । আমি আমার ঘাসফড়িঙের নাম দিলাম 'তিন্নু' । তিন্নু নামের অর্থ কী, আমি জানি না । কিন্তু ফড়িংছানাটিকে আমার তিন্নু নামে ডকতে ভীষণ ভালো লাগত । তাকে আঙুলের মাথায় বসিয়ে সারাদিন বাড়ি বাগান আর রস্তায় ঘুরে বেড়াতাম । আমি ছোট তাই কেউ কিছু বলত না । বাড়িতে আমার নিঃসঙ্গতাটা দূর করে দিয়েছে আমার আদরের এই ছোট্ট ঘাসফড়িং তিন্নু । আমি প্রতিদিন মাছি মেরে মেরে তাকে খেতে দিই ।
দেখতে দেখতে ছুটির সাতদিন শেষ হয়ে গেলো । এই সাতদিন সময়ে তিন্নুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গভীর হয়ে গেছে । তার প্রতি আমার ছোট্ট মনে মায়া জমে গেছে । আমি মাদরাসায় চলে গেলে তাকে যত্ন করবে কে? তার বাবা মার কাছে ছেড়ে দিয়ে এলে ভালো হয় । কিন্তু তাদের খুঁজে পাই কোথায়!
আমার সেই ছোট্ট বয়সে একটা দারুণ আইডিয়া এলো মাথায় । বুদ্ধি করলাম- আমি তিন্নুকে মাদরাসায় নিয়ে যাবো । সেখানে সে আমার চোখে চোখে থাকবে । ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তাকে নিয়ে আনন্দ করবো । মাছি মেরে মেরে খাওয়াবো । সে আরো বড় হবে । মাদরাসার ছাত্ররা তাকে নিয়ে আনন্দ করবে। আনেক মজা হবে।
আমি একটা কৌটায় ভরে তিন্নুকে মাদরাসায় নিয়ে এলাম । প্রতিদিন মাছি মেরে মেরে টাংকের ভিতরে রেখে তাকে খাওয়াই । আমার টাংকটাই তার বাড়ি । সে ওখানে নিরাপদে থাকে । ক্লাসের ছুটির ফাঁকে ফাঁকে তাকে নিয়ে আনন্দ করি । আমার সাথে ছাত্রবন্ধুরাও আনন্দ করে । আমরা সারা বিকেল তিন্নুকে নিয়ে আনন্দে মেতে থাকি । মাছি মেরে খাওয়াই ।
আবুজ সুন্দর ঘাসফড়িং তিন্নুকে টাঙ্কের ভিতরে রাখতে হয় । জানি তার কষ্ট হয় । কিন্তু এছাড়া উপায় নেই । মাদরাসায় যে ফড়িং পোষার ব্যবস্থা নেই!
প্রায় একমাস তিন্নুকে নিয়ে আনন্দ করেছি । আঙুলে বসিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি । আমার ছাত্রবন্ধুরাও আনন্দে মেতে ছিলো । মানুষ হাঁস পালে মুরগি পালে, ময়না শালিক কবুতর পোষে । কিন্তু ঘাসফড়িং পুষতে শোনা যায় না । আমি পুষেছি । অথচ এর আগে কখনো কোনো পশু পাখি পুষিনি । আমার শিশুমনকে দারুণভাবে আন্দোলিত করেছে সবুজ ফড়িং তিন্নু ।
একদিন এক হুযুর বিষয়টি জানতে পারলেন । আমরা অনেক ভয় পেয়ে যাই । না জানি আমাদের পিটুনি খেতে হয়! কিন্তু না,হুযুর বেশিকিছু বললেন না । সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন- আমরা মানুষ যেমন আল্লাহর সৃষ্টি, এই ছোট্ট ঘাসফড়িংও তার সৃষ্টি । তোমাদেরকে যদি কেউ তোমাদের আব্বু আম্মুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আটকে রাখে, তোমাদের ভালো লাগবে?
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম- জ্বি না!
তা হলে ঘাসফড়িংটাকে যে বন্দি করে রেখেছো, সে কষ্ট পাচ্ছে না!?
আমরা বললাম, জ্বি হুযুর, পাচ্ছে ।
তা হলে তাকে ছেড়ে দাও । সে তার আব্বু আম্মুর কাছে চলে যাক । শুধু শুধু একটি দুর্বল প্রাণীকে বন্দী করে রেখো না । তোমাদের অনেক বড় হতে হবে, এসবের পেছনে সময় নষ্ট করো না । যাও, তাকে ছেড়ে দাও!
তিন্নুকে দূরে সরিয়ে দিতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো । তবু ছেড়ে দিলাম । সে লম্বা পা দুটো ঝাঁকিয়ে লাফিয়ে চলে গেলো । আর কখনো খুঁজতে যাইনি । আমার মন খারাপ দেখে এক বন্ধু তিন্নুকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি । আর কোনোদিন পাবেও না । যেমন আর পাবো না সেই শৈশবকে ।
মোশাররফ মাহমুদ
বাংলাদেশ ,ঢাকা
অনেকদিন আগের কথা । মাত্র মাদরাসা বন্ধ হয়েছে । ছাত্রবন্ধুরা সবাই যে যার বাড়িতে চলে যাচ্ছে । আমিও বাড়ির পথ ধরলাম । কিন্তু সেই ছোট বয়সেও বাড়িতে যেতে আমার মোটেও ভালো লাগত না । একা একা থাকতে হয় । পাড়ার ছেলেরা সারাদিন নিজেদের মতো করে ব্যস্ত থাকে । খেলাধুলায় মেতে থাকে । তাদের সঙ্গে আমি কখনো মিশতে পারতাম না, খেলতে ইচ্ছে হত না । আবার একা থাকতেও ভালো লাগত না ।
বাড়ির পূবপাশে আমাদের বিভিন্ন সবজি চাষ করা হত । আমি একাকী সেখানে হেঁটে বেড়াতাম । আনমনা হয়ে হাঁটতাম । মনে কোনো উচ্ছ্বাস কিংবা আনন্দ থাকত না । শুধু দিন গুণতাম- কবে মাদরাসা খোলা হবে!
একদিন বিকেলের কথা । সবজি ক্ষেতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটি ফড়িং দেখলাম । সবুজ ঘাসফড়িং।
অনেক ছোট । দেখতে অনেক সুন্দর আর চমৎকার তার রূপ । নিপুণ কারুকার্যের অপূর্ব সৃষ্ট । আমি তার সামনে হাত বাড়িয়ে ধরলাম । কিন্তু ফড়িংছানাটি বোধহয় একটু ভয় পেয়েছে । আমি বুঝতে পেরেছি । কারণ মৃত্যুকে যে সবাই ভয় পায়! এই ঘাসফড়িংও ভয় পেয়েছে । হয়ত ভেবেছে আমি তাকে মেরে ফেলব । মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত । আবার এই বৃহত মানবসম্প্রদায়ের কিছু মানুষকে ইঙ্গিত করেই তো বলা হয়েছে, "উলাইকা কাল আনআম, বাল হুম আযাল"!
আমি ঘাসফড়িংটিকে আদর করে দুহাতের মুষ্টিতে ভরে নিলাম । সে ভয়ে কাঁপছে । তিরতির করে কাঁপছে তার ডানা । আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম, 'ভয় পেয়ো না ফড়িংছানা । আমি তোমার যত্ন নিব, কষ্ট দিব না । তুমি আমার কাছে থাকবে । আমি তোমাকে রোদে পুড়তে দেব না, বৃষ্টিতে ভিজতে দেব না । যত্ন করে খাওয়াব, উপোষ রাখব না ।
মানুষ শখের পোষা প্রাণীদের একটা নাম দেয় । আমি আমার ঘাসফড়িঙের নাম দিলাম 'তিন্নু' । তিন্নু নামের অর্থ কী, আমি জানি না । কিন্তু ফড়িংছানাটিকে আমার তিন্নু নামে ডকতে ভীষণ ভালো লাগত । তাকে আঙুলের মাথায় বসিয়ে সারাদিন বাড়ি বাগান আর রস্তায় ঘুরে বেড়াতাম । আমি ছোট তাই কেউ কিছু বলত না । বাড়িতে আমার নিঃসঙ্গতাটা দূর করে দিয়েছে আমার আদরের এই ছোট্ট ঘাসফড়িং তিন্নু । আমি প্রতিদিন মাছি মেরে মেরে তাকে খেতে দিই ।
দেখতে দেখতে ছুটির সাতদিন শেষ হয়ে গেলো । এই সাতদিন সময়ে তিন্নুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গভীর হয়ে গেছে । তার প্রতি আমার ছোট্ট মনে মায়া জমে গেছে । আমি মাদরাসায় চলে গেলে তাকে যত্ন করবে কে? তার বাবা মার কাছে ছেড়ে দিয়ে এলে ভালো হয় । কিন্তু তাদের খুঁজে পাই কোথায়!
আমার সেই ছোট্ট বয়সে একটা দারুণ আইডিয়া এলো মাথায় । বুদ্ধি করলাম- আমি তিন্নুকে মাদরাসায় নিয়ে যাবো । সেখানে সে আমার চোখে চোখে থাকবে । ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তাকে নিয়ে আনন্দ করবো । মাছি মেরে মেরে খাওয়াবো । সে আরো বড় হবে । মাদরাসার ছাত্ররা তাকে নিয়ে আনন্দ করবে। আনেক মজা হবে।
আমি একটা কৌটায় ভরে তিন্নুকে মাদরাসায় নিয়ে এলাম । প্রতিদিন মাছি মেরে মেরে টাংকের ভিতরে রেখে তাকে খাওয়াই । আমার টাংকটাই তার বাড়ি । সে ওখানে নিরাপদে থাকে । ক্লাসের ছুটির ফাঁকে ফাঁকে তাকে নিয়ে আনন্দ করি । আমার সাথে ছাত্রবন্ধুরাও আনন্দ করে । আমরা সারা বিকেল তিন্নুকে নিয়ে আনন্দে মেতে থাকি । মাছি মেরে খাওয়াই ।
আবুজ সুন্দর ঘাসফড়িং তিন্নুকে টাঙ্কের ভিতরে রাখতে হয় । জানি তার কষ্ট হয় । কিন্তু এছাড়া উপায় নেই । মাদরাসায় যে ফড়িং পোষার ব্যবস্থা নেই!
প্রায় একমাস তিন্নুকে নিয়ে আনন্দ করেছি । আঙুলে বসিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি । আমার ছাত্রবন্ধুরাও আনন্দে মেতে ছিলো । মানুষ হাঁস পালে মুরগি পালে, ময়না শালিক কবুতর পোষে । কিন্তু ঘাসফড়িং পুষতে শোনা যায় না । আমি পুষেছি । অথচ এর আগে কখনো কোনো পশু পাখি পুষিনি । আমার শিশুমনকে দারুণভাবে আন্দোলিত করেছে সবুজ ফড়িং তিন্নু ।
একদিন এক হুযুর বিষয়টি জানতে পারলেন । আমরা অনেক ভয় পেয়ে যাই । না জানি আমাদের পিটুনি খেতে হয়! কিন্তু না,হুযুর বেশিকিছু বললেন না । সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন- আমরা মানুষ যেমন আল্লাহর সৃষ্টি, এই ছোট্ট ঘাসফড়িংও তার সৃষ্টি । তোমাদেরকে যদি কেউ তোমাদের আব্বু আম্মুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আটকে রাখে, তোমাদের ভালো লাগবে?
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম- জ্বি না!
তা হলে ঘাসফড়িংটাকে যে বন্দি করে রেখেছো, সে কষ্ট পাচ্ছে না!?
আমরা বললাম, জ্বি হুযুর, পাচ্ছে ।
তা হলে তাকে ছেড়ে দাও । সে তার আব্বু আম্মুর কাছে চলে যাক । শুধু শুধু একটি দুর্বল প্রাণীকে বন্দী করে রেখো না । তোমাদের অনেক বড় হতে হবে, এসবের পেছনে সময় নষ্ট করো না । যাও, তাকে ছেড়ে দাও!
তিন্নুকে দূরে সরিয়ে দিতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো । তবু ছেড়ে দিলাম । সে লম্বা পা দুটো ঝাঁকিয়ে লাফিয়ে চলে গেলো । আর কখনো খুঁজতে যাইনি । আমার মন খারাপ দেখে এক বন্ধু তিন্নুকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি । আর কোনোদিন পাবেও না । যেমন আর পাবো না সেই শৈশবকে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন