ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭

   

বৈশ্যাম্পয়ন  , একটি প্রলেতারিয়াত স্বপ্ন
পি না কি
                                       

  ১
সেই সকাল থেকে হাঁটছে , গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে  । মাথার উপরের সূর্য  এখন আকাশের মাঝখান থেকে  পশ্চিমে ঢলতে শুরু করল  ।  আকাশে  আলো আছে ।  সেই পাতলা ছায়ার মতন আলোয় , চারপাশে  একটা  দৃশ্য তৈরি হচ্ছে । কিছুক্ষণ খোলা  ভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল । আকশের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে ; সূর্যের  আয়ু  আজকের দিনের মতন আর মাত্র কিছুক্ষণ । আচমকাই অন্ধকারে ঢেকে যাবে পৃথিবী।  তখন আলো হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তে  , নিজের অসহায়তা তাকে ঘিরে ধরবে ।  বৈশ্যাম্পয়ন  এখন থম মেরে থাকবে ।  এই সময় কাঁদতে হয় , আপন জন যদি কেউ তাকে ছেড়ে চলে যায় , তার কথা ভেবে চোখ ভিজে আসে জলে ; এমন ভাবে কাঁদতে –কাঁদতে মন হাল্কা হবে । সে কষ্ট পায় । বুঝতে পারে , পৃথিবীতে আলোর দরকার , কেননা এই  নিভে যাওয়ার  সময় নিজেকে খুব একা মনে হয়  ।   এখানে কেউই একা বেঁচে থাকতে চায়না।এই সময়টা , দিনের এই  নিভে যাওয়া সূর্যের  আলো যখন মিশতে থাকে আকাশের    শিরা –উপশিরায়  ঠিক তখনই  , মনটা ভীষণ একা হয়ে ওঠে ।
এই পৃথিবীতে সে একা কি ? এই প্রশ্ন বৈশ্যাম্পয়ন   নিজেকে আগেও করেছে । এখন সন্ধ্যা । পাখিরা  ফিরছে । এই ফিরতে থাকা পাখিরা ,  বুক  ছুঁয়ে থাকা অন্ধকারে সাঁতরে , নিজের বাসায় পৌঁছে যাবেই ! এরা অন্ধকারেও ঠিকানা ভুল করেনা । আসলে ঘর থাকলে , আপন জন থাকলে ,  ফিরবার তাগিদ থেকে যায় । নিজের এমন কোন তাগিদ নেই ।
 বৈশ্যাম্পয়ন  গুরু ব্যাসের ছায়ায় বেড়ে উঠেছে  । গুরুর দীক্ষায় পালিত । আশ্রমে যজ্ঞের তাগিদে যে কাঠ জমিয়ে রাখা হয় , যাদের অনবরত নিবেদিত সেবার কোন কদর নেই , অথচ তারা ভীষণ  ভাবে  প্রয়োজনীয় ; ব্যাসের কাছে বৈশ্যাম্পয়নের উপস্থিতি যজ্ঞের কাঠের মতনই । নিজের জ্ঞান  আর  আত্মত্যাগের আগুনে দাউ –দাউ করে জ্বলছে , সেই সবের মর্যাদা সে হয়ত এই জীবনে আর পাবেনা।
আবার হাঁটতে শুরু করেছে । সে  যেই জায়গায় থেমে গিয়েছিল , সেটা খুব বড় ফাঁকা সমতল ভূমি । ন্যাড়াই বলা যায় , ঘাসের দল মাথা তুলে আছে , তবে খাপছাড়া । মাঝে কিছু জায়গা উঁচু টিলা রয়েছে , তার পাশে আবার পাথরের পথ ।  সেই পথ আর টিলা বাদে গোটা ভূমি ধুলোয় ভরা । খুব বড়  ফাঁকা মাঠটা পেরিয়ে  যেতে হবে । হাতে সময় নেই । এই যে মাথার উপর আলোর শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে গেল , এখন নিজের অসহায়তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা ।
না , বৈশ্যাম্পয়নের মনে হচ্ছে মর্যাদা নয় , সে একটু ভালোবাসা চায় । এটা ঠিক মুনি বেদব্যাস নিজের পুত্র শুকদেবকে অতটা ভরসা করেন না , যতটা  তার প্রিয় শিষ্য । এই কথা সকলেই জেনেছে , এক বিশ্বস্থ   শিষ্য , কখনই পুত্রের স্থান নিতে পারবে না। । এই কথাটুকু যখনই ভাবছে , দু’ চোখ ভিজে গিয়েছে জলে । চোখের মনি দুটি , নিজের অজান্তেই ঝাপসা হয়ে গেল ! একে চারপাশে আলো নেই , তারউপর মনের দুর্বলতা , সব কিছু মিলিয়ে অবসন্ন দেহ , আশ্রয় খুঁজছে । সে চাইছে না আর  বেশি দূর এগিয়ে যেতে ।
আজ রাতের মতন থাকবার জায়গা খুঁজতে হবে ,  পাথুরে এলাকা  তাই সে নিজেও দুই বড় টিলার মাঝখানে কোন গুহা খুঁজছে  ।  তাকে এখন যে কাজটা করতে হবে , খুঁজতে হবে । মাথার উপরে যে আকাশটা , দ্রুতই রাতের দিকে চলেছে ! এই খোলা জমিতে বন্য জন্তুর অভাব নেই । দস্যুও রয়েছে ; তাতে অবশ্য ভয় পায়না । তবে আসল কথা হল এখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও আর ভালো  লাগছিল না। সেই ভোর  হতেই আশ্রম  থেকে হাঁটছে , যেতে হবে  রাজর্ষি জনমেজয়ের রাজধানী । সেখানে তার কাঁধে এক বড় দায়িত্ব রয়েছে ।
একটু উঁচু –নিচু পাথুরে পথ টপকিয়ে , গুহার মুখে এসে দাঁড়ালো । বৈশ্যাম্পয়ন দুটো পাথরের মুখোমুখি ঘর্ষণে  , আলো জ্বালিয়ে নিয়েছে । নিম কালো  আকাশ , চারপাশের  ফাঁকা জমিতে জমে থাকা অন্ধকার ,  দূরে ময়লার মতন স্থবির  অরণ্য , মাঝে এক বছর তিরিশের যুবকের হাতে  কাঠের মুখে জ্বলতে থাকা আগুন ; লেলিহান শিখায় গুহা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল । ভিতরে অনেকটাই জায়গা আছে , ময়লা , আর সবুজ রঙ হারানো  বুড়ো ঘাসে ভরে গিয়েছে । ভিতরে গিয়ে বসল । অন্ধকারের বুক চিঁড়ে  আলোর রেখা  যেন আচমকাই প্রবেশ করল , কয়েকটি চামচিকে উড়ে গেল । আজ রাতে অন্তত এখানে ঘুমানো যাবে ।

গুহার ভিতরে বসে , প্রথমে মুখে জলের ঝাপটা দিল । ঝোলা থেকে আপেল নিয়ে কামড়  দিতেই , গুরুর কথা মনে  পড়ল । এখন রাত   মধ্য  রজনী স্পর্শ করতে  কিছুটা সময় বাকি   , সে গুহার দেওয়ালে  দিয়ে শুয়ে পড়ল । অনেক রাত হবে ,  গভীর রাতে ক্লান্ত আর ক্ষিধে পেটে খাবারের আশ্বাস পৌঁছাতেই ; চোখে ঘুমের আদর  নেমেছে  ।

আগুনের শিখা এখন স্থির , এই সময় ঘুমিয়ে থাকা বৈশ্যাম্পয়নের  নাকে   পাতলা  গন্ধ ভেসে আসছে   । সেই গন্ধে  ঘুম ভাঙল । পাশে কাঠটা পুড়তে –পুড়তে  অনেক কম আলো নিয়ে এখনো জ্বলছে , সেই অপরিমিত আলোয় গুহার কোনায় একটা মূর্তি দেখতে পেল !
বৈশ্যাম্পয়ন বুঝতে পারছে না, গুহার মুখে সে বসে আছে । তার ডানদিকে আলোদণ্ড রাখা আছে ।  কোন পশু হবেনা । মানুষই হবে । সে  স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে । মূর্তিটি নড়ছে । হামাগুড়ি দিয়ে আলোর কিছুটা তফাতে থামল ।  এই দিকেই তাকিয়ে রয়েছে ।
                                                           ২
 আগুনের আলোরয় মানুষটির মুখ  দেখা যাচ্ছে  । নিম্মাঙ্গে  পশুর ছাল পড়ে আছে । মাথার চুল জট ধরা । গায়ের রঙ কালো । এই গুহায় তার উপস্থিতি , ময়লার থেকে বাড়তি কিছু নয় ।বৈশ্যাম্পয়ন দেখল , মানুষটি খুব দ্রুত নিঃশ্বাস নিয়ে চলেছে ! বুক  ওঠানামা করছে । এইবার , নাকে ভেসে আসা দুর্গন্ধের রহস্য বুঝতে অসুবিধা হল না । এই মানুষটি নির্ঘাত কাঁচা মাংস খায় । নাক – মুখের ভিতর থেকে যে  নিঃশ্বাস ঝরছে , সেখানেই  টের পাওয়া গেল ! এখানে এই অবাঞ্ছিত মানুষটির উপস্থিতি সহ্য  করতে পাচ্ছিল না। এই  বনবাসী , বন্য , কূট , আর  ম্লেচ্ছ জনজাতি ; যাদের সভ্য জগতে কোন স্থান নেই । এদের হত্যাই একমাত্র পথ । এরা সভ্য জগতে আসলেই , সেখানকার পরিবেশ দূষিত হবে ; এখানকার পরিবেশ এই এখন যেমন ভাবে নষ্ট হচ্ছে ।
-আপনার ঝুলিতে কিছু খাবার থাকলে দিন । খুব জ্বালা করছে পেটটা । মনে হচ্ছে ফেটে যাবে । ক্ষিধে চাপলে গোটা শরীরটা ছিঁড়ে যায় , প্রভু । দিননা । কিছু খাবার ।
-তুই কে ? চেহারা দেখে ঘেন্না লাগছে । গাঁ ঘিন ঘিন করছে । আমি  বেদজ্ঞ ব্যাস মুনির  শিষ্য  । এত বড় সাহস , আমাকে খাবার দিতে বলছিস !
-প্রভু , মরণাপন্ন মানুষের আবার জাতে বিচার থাকে নাকি ! আমি ক্ষিধের জ্বালায় মরতে বসেছি । এখন আমি যদি বিচার করি , আপনি আমার শত্রু না মিত্র , বা আমি আপনার হাতের খাওয়া খেতে পারব কিনা ? নিজের প্রাণ তাতে বাঁচবে ?
-তোর সারা শরীরে বিষ্ঠা মেখে আছে । বিশ্রী গন্ধ ছড়াচ্ছে ।
-আমি যে তিনদিন ধরে পালিয়ে বেরিয়েছি  ! আপনার  এই গুহার ভিতরেই একটা ছোট্ট গুহা আছে  ,পাশেই ।  সেখানেই আমি দু’দিন ছিলাম  লুকিয়ে । এই  আজ আপনাকে আগুন নিয়ে ঢুকতে , বুঝতে পারলাম এখন যদি না চাই , আর বাঁচব না। সবাই  বাঁচতে চায় । আমিও চেয়েছি । দোষ  কোথায় বলুন ?

বৈশ্যাম্পয়নের   মনে হল , ইতর শ্রেণীর  মানুষটা ভুল কিছু বলেনি ।  বেদে দেবতাদের অন্নসংস্থান করাই তাদের সহায়তা পাওয়ার একমাত্র পথ । তাই আশ্রম এক দীর্ঘ সময় ধরে  দেবতাদের সাথে চুক্তি বদ্ধ হয়েছে। এই ইতরতার থেকে পাওয়ার কিছু নেই , তাই তার প্রাণ রক্ষার দায় নেই । এটা বৈদিক সংস্কার । তবে এর বাইরেও এটাও ঠিক প্রতিটি মানুষ নিজের জন্য লড়াই করে । সে বলল
-তুই পালিয়ে বেরাচ্ছিস কেন ?  নিশ্চই  কোথাও উপদ্রব করেছিস ।
-হাসালেন । আমরা দুর্বল জাতি । ক্ষত্রিয়দের সামনে মাথা তুলবার সাহস নেই । উপদ্রব ! আমাদের অত অস্ত্র বল নেই , গোষ্ঠী বদ্ধ প্রচার নেই ।  দেখুন কেমন ছিন্ন হয়ে পড়েছি !
- তোর এমন অবস্থার পিছনে কারণ আছে ?
-হাসালেন , রাজা জনমেজয়ের অত্যাচারে সবাই কানে হাত দিয়েছে । আপনি ব্রাক্ষ্মণ, আপনারাও শুনেছি  কানে হাত রেখেছেন । তাই বলে সত্য স্বীকার করবেন না !
-মানে ?
-জনমেজয় আর তার সেনাবাহিনী নির্বিচারে সাপ মারবার পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছে । সেই অত্যাচারকে  সাংস্কৃতিক পরিচয়ের আড়াল দেওয়ার   জন্য আপনাদের সমর্থন চেয়েছে । আপনারা  দিচ্ছেন সহায়তা । আমি জানি সবাই নিজের দিকটা ভাবছে । তাই এত ভয়ঙ্কর আর নিষ্ঠুর  হত্যা যজ্ঞকে উৎসবের মতন আনন্দ যজ্ঞ করে তুলছেন । সর্প হত্যা করে , আমরা যারা  বনে থাকি , সাপের বিষ নিয়ে বানিজ্য করতাম , তাদের জনজাতিকে বিলুপ্ত করে দেবেন !
-এটা ঠিক রাজা জনমেজয় যজ্ঞ করছেন । আর এটাও ঠিক  দুর্বলের উপর অত্যাচার , রক্ষাকর্তা ক্ষত্রিয়দের  শোভা পায়না । তোরা রাজার বিরুদ্ধাচারণ   করেছো । শুধু তাই নয় , রাজাকে গুপ্ত হত্যা ক্রতে চেয়েছো। তোমাদের শাস্তি পাওয়া কি অন্যায় ?
-কিসের জন্য ? এই ভূমি থেকে আমাদের উৎখাত করবেন । আমরা মেনে নেব ? এই ভূমি যতটুকু আপনাদের ততটুকুই আমাদের নয় ? অথচ আজ আমরা নিজেদের জনবসতি চখের সামনে পুড়তে দেখছি! আমাদের  মেয়েদের চিৎকার ,   শিশুদের কান্না , এখনো আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে । আর  কত ?  এর পিছনে শুধুই  দখলের রাজনীতি রয়েছে ।
-রাজার সাথে এই বিবাদের কারণ ?
-রাজা আমাদের কাছে শুল্ক চাইছিল । এত দিন আমরা আমাদের ভূমিতে বসবাস করতাম স্বাধীন ভাবে । একদিন আচমকাই খবর এলো , রাজাকে কর দিতে হবে ।  নিজেদের মায়ের মতন এই ভূমি , ওদের হাতে তুলে দিতে হবে ! জীবন থাকতেও আমরা আমাদের স্বাধীনতা  বিসর্জন দেব না।
-যাদের প্রতিরোধের ক্ষমতাই নেই , তারা  নিজেদের ভূমি নিয়ে এত সজাগ  কেন ?
-ক্ষমতা নয় , প্রতিরোধ করবার জন্য  ইচ্ছা দরকার । নিজেদের জনজাতির সংস্কৃতির  প্রতি দায়বদ্ধতা থাকা  দরকার । আমাদের কাছে আমাদের সভ্যতাই সব , তাকে রক্ষা করবার জন্য  নিজেদের শেষ রক্তটুকু  দিয়ে লড়ে যাব  । যে সর্প যজ্ঞে  বিভিন্ন প্রান্ত থেকে  ক্ষত্রিয়রা এসেছে , নিজেদের ক্ষমতার কথা বলছে , তাদের  কাছে  নতুন করে কিছু বলবার নেই ।

এত কিছু শুনবার মাঝেই , ঝুলি থেকে আপেল নিয়ে , সামনের মানুষটির দিকে ছুঁড়ে দিল । সে  লুফে নিয়ে খুব দ্রুত খাচ্ছে । এই লোকটি সর্প গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত । ক্ষত্রিয়রা  অরণ্য , ভূমি দখল করে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চাইছে । সর্প গোষ্ঠীভুক্ত রা  তাদের পাওনা থেকে সরবে না । আসলে এই যে   প্রসারিত  বনজ সম্পদ , পশু  সম্পদ – তা একেবারে অসুরক্ষিত অবস্থায় থাকতে পারে না।  জনমেজয় আশ্রমের সহায়তা চেয়েছিল , আশ্রম সেই প্রস্তাবে সাড়া দিল । কেননা আশ্রম গুলোকেও   নিজেদের  ক্ষমতা  বজায় রাখবার জন্য  এই সর্প হত্যার যজ্ঞে সামিল হতে হয়েছে ।  কেননা ক্ষত্রিয়দের পাশে না থাকলে , সেখান থেকেও সহায়তা পাওয়া যাবে না । গুরুর কথা শুনে  , সে নিজে কয়েকদিন সর্প ভূমিতে ছিল । সেখান থেকেই সে এই ম্লেচ্ছ ভাষা  শিখেছে । এই  ভাষাকে কখনই স্বীকৃতি  দেওয়া  হবে না । এরা  এই দেশের অধিবাসী হলেও , আধুনিক ভারতে এদের ভূমিকা , অস্তিত্ব অতি সুকৌশলে মুছে ফেলা হবে । সেই কাজই চলছে ।
-তোদের এই অবস্থার জন্য , তোরাই দায়ি ।
কথাটা বলেই , বৈশ্যাম্পয়ন  ঝুলি থেকে কলা বের করে এগিয়ে দিল । মানুষটি দ্রুত তা নিয়ে বলল
-কেন ?
-এই সমাজ উচ্চবান , উচ্চ বৃত্তির সম্প্রদায়কে সুরক্ষা প্রদান করে । তাদের স্বার্থের  জন্য সমাজে সমান্তরাল ভাবে দু’ টো শ্রেণীর  সৃষ্টি হয়েছে । এরা দুজনেই প্রতারিত আর শোষিত । এই  দু’ টো শ্রেণীকেই  নিজেদের  অস্তিত্ব  রক্ষার জন্য ব্যবহার  করে উচ্চবৃত্তির সুরক্ষিত সম্প্রদায় । আমি আর তুই সেই দু’ টো  শ্রেণী    অবলম্বনকারী , যাদের উপর রাজা জনমেজয়ের ক্ষমতা নির্ভর করবে , তার হাতে ক্ষমতা  আছে , ভূমি আছে আর আমাদের বুদ্ধি আর তোদের শ্রম । রাজা জনমেজয় আমাদের বুদ্ধি ভাড়া করবে , তোদের শ্রমকে  দখল করবার জন্য । তোরাই সমাজের তলানিতে থাকা বর্বর ভিড় ।
-ঠিক বলেছেন । এটাই কারণ আপনার শ্রমকে খাটিয়েও আপনার গুরু তার পুত্র শুকদেবকেই  আগে এই মহান কাব্য  পাঠ করে শুনিয়েছেন !  আপনি শুধুই মানুষের  জন্য যে মহাকাব্য , তারই স্বত্বাধিকারী হলেন !  অথচ আপনি নিজেও জানেন , দেবতাদের কাছেও আপনার কদর হওয়া  উচিত ছিল । আপনিই প্রথম শ্রবণের  অধিকারী ছিলেন । শুধু তাই নয় , রক্তের সম্পর্ক শ্রমের থেকেও এগিয়ে রইল । আমরা দুই সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে , আর সুবিধা নিল আমাদের মাথায় থাকা  শ্রেণী ! আমরা সব কিছু জেনে –বুঝেও চুপ হয়ে আছি !
-মানে ?

আরে ! মানুষটি কোথায় ! আগুন নিভে গিয়েছে , পোড়া কাঠ  ছাই হয়ে ছড়িয়ে , কালো ।  পিছনের পথ থেকে ব্যাটা নির্ঘাত পালিয়েছে । গুহার মুখে , ভোরের ছাপ পড়েছে । কানেতে  কাকের ডাক এল ।
এতক্ষণ বৈশ্যাম্পয়ন   খেয়াল করেনি , সে দেখল  কথা গুলো বলেই  , কিছুক্ষণ আগেই হয়ত ইতর মানুষটি অন্তর্ধান হয়েছে !  তাকে দেখতে পেল না  ।
আলে গড়িয়ে যাওয়া জলের মতনই , গুহার বাইরে থেকে ভোরের আলো ক্রমশই ভিতরে এসে পড়েছে । এখন বসে থাকলে সন্ধ্যার আগে রাজা জনমেজয়ের রাজধানীতে পৌঁছাতে পারবে না।
                                                                     ৩
রাস্তায় নেমেই আগের রাতের দুঃস্বপ্ন , বৈশ্যাম্পয়নকে তাড়া করছিল । এখনো অব্দি যতটুকু মনে পড়ছে তা হল ,  আশ্রয়মুখর হয়ে সে গুহার ভিতর বসল । হাতে ছিল জ্বলন্ত কাঠ  আর কমণ্ডলু । বাঁ’ কাঁধের  ঝোলা থেকে  সে নিজে কিছু ফল খাবে , তাই গুহার মেঝেতে বসে পড়ল । কমণ্ডলুর  জল দিয়ে মুখ ধুয়েছে । ফল খেয়েছে । তারপরই চোখে তন্দ্রা ! ঘুম – ঘুম ভাব ।  এরপর আর কিছু মনে নেই ।
মাঝরাতেই হবে হয়ত , নাকে দুর্গন্ধের জন্য চোখ খুলে আগুনের উল্টো দিকে , সেই ইতর শ্রেণীর মানুষটা!
তারপর ?
এমনভাবে সে এসে প্রাণ ভিক্ষা চাইছিল , খাবার দিল ।  ইতরটি তারপর চলেও গেল ! সে গেলেও এমন অনেক  কথাই বলে গিয়েছে , যা বৈশ্যাম্পয়নের মনে প্রশ্ন তুলেছে । এই মানুষটি পূর্বপরিচিত না তো ? যদি  তাই হবে , তাহলে চিনতে এত অসুবিধা কেন ? আর যদি অপরিচিতই হবে , তাহলে যে মহাকাব্য এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি , জনসমক্ষে ; সেই সাহিত্যের পিছনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র টের পেয়ে গেল  ! এই ব্যাপারটা ভাবতেই , শরীরের রোম  খাড়া  হয়ে উঠল । সে ভাবছে , যে একমাস সে ক্ষত্রিয়দের মারণ যজ্ঞের   পৌরোহিত্য  করেছিল , সেই  দিন গুলোতে   তার পরিচিত কেউ ছিল ?
এইবার খুব ভালো করে , মোলায়েম ভাবে নিজের  স্মৃতিকে চাপ দিল ।

এক দীর্ঘ  সময়ের অপেক্ষার পর , শেষ পর্যন্ত  ব্যাস মুনি একটু স্বস্থির  নিঃশ্বাস ফেলল । সে অবশেষে  ভারতবর্ষের পরিচয় লিপিবদ্ধ করে ফেলেছে ।  যে দীর্ঘ স্ম্য ধরে ক্ষমতা দখলের লড়াই হয়েছে ,  শ্রেণী  সংগ্রামের জন্য চলেছে সংঘর্ষ , সব কিছু নিজের চোখে দেখেছে । এই দিন গুলোয় ব্যাসের খুব কাছের বিশ্বাসযোগ্য ছিল বৈশ্যাম্পয়ন । সে নিজেই সব কিছু সংগ্রহ করেছে । এখানেই নয় ক্ষত্রিয়রা যখন দেখল অরণ্যভূমি দখলের জন্য সর্পকূলের বিনাশ আবশ্যক । ঠিক তখনই ব্যাসের সাথে তারা চুক্তিতে বসল ।

ব্যাস এমনই এক  যুদ্ধ পরিস্থিতিতে  দেব ভূমি থেকে ফিরেছে । আশ্রমে মুনির ফিরে আসায় সকলেই বেশ আনন্দিত ।
তখন মধ্যসকাল । গ্রীষ্ম ঋতুতে , খোলামেলা হাওয়ায় ভাসছে গাছের পাতা । ব্যাস মুনি  প্রবেশ করলেন । সাথে দেবতাদের তরফ থেকে প্রচুর উপটৌকন  । এর সাথে অনেক পিছনে ,  জালের ভিতর কালো পশু । ভীষণ নোংরা আর বিশ্রী গন্ধে ভরা ।
বৈশ্যাম্পয়ন বলল – গুরুদেব  আপনার সাথে সমস্ত উপটৌকন  তাৎপর্য বুঝতে পারলেও । এই জালে কী আছে ?
ব্যাস মুনি বলল – সাক্ষাৎ মৃত্যু । সর্পকূলের এক জন্তু বিশেষ । রাজা জনমেজয়ের কাছে একে পাঠানো হবে। যাতে তিনি বুঝতে পারেন , আমাদের এই সর্প নিধন যজ্ঞে অনুমতি আছে । আমি জানিনা , এটা মারা গিয়েছে কিনা ! আমি অরণ্যে ঘুরছিলাম , দেখি একজায়গায় এদের জটলা হতে । আমার সাথে থাকা লোকেরা আক্রমণ করে ওদের হত্যা করল । আমি ভাবলাম কয়েকটাকে ধরে এনে প্রিচ্য করাই । তোমরা তরুণ সন্ন্যাসী । সব কিছুতেই অভিজ্ঞতা থাকা দরকার । একে নিয়ে পরীক্ষা করে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি কর । তুমিতো ওদের ভাষা কয়েকদিন আগেই চর্চা করছিলে ।
-ঠিকাছে গুরুদেব ।আমি এটাকে পিছনের পরীক্ষা কক্ষে নিয়ে গিয়ে রাখছি ।

বিকেলের আলো তখন মিশছিল , অরণ্যের পাতায় –পাতায় , ঘাসেদের তুলতুলে শরীরে , পাখিদের মোলায়েম স্বপ্ন ভরা চোখে । এই সময় পৃথিবীতে ধীরে –ধীরে রং পাল্টায় , মনের সংগোপনে  , জমা হয় কথা । এখনই গোধূলি সন্ধ্যার সাজে সেজেছে প্রকৃতি । খোলা সরবরের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছে ।
সূর্যাস্তের পরেই , বৈশ্যাম্পয়ন আশ্রমে ফিরে এলো । তার মনে হল , পরীক্ষা কক্ষে সেই জীবটি এখনো বেঁচে আছে ? যদি থাকে , তাহলে এটাই পর্যবেক্ষণের উত্তম মুহূর্ত  ।

খুব দ্রুত কক্ষে ঢুকে , দরজা বন্ধ করে দিল । কক্ষের ভিতর জালে জড়ানো জীবটি ধুঁকছে !
-আপনি ভয় পাচ্ছেন ! আমরা সাপেদের সংরক্ষণ করি । আমরা আপনাদের কাছে পশু হলেও , আমরা মানুষ । আমাদের হত্যা করছেন নির্বিচারে , আমাদের প্রজন্ম নষ্ট করা হচ্ছে । আর আপনারা এই মৃত্যু যজ্ঞকে ধর্ম যজ্ঞ বলছেন ! ভালো , এই আপনাদের বিচার ! সভ্যতা !  বৈদিক পরম্পরা ! আমাদের অরণ্যও আমাদের কাছে থেকে কেড়ে নেবেন !
-আমি ব্যাস মুনির শিষ্য  বৈশ্যাম্পয়ন ।
-আমি আপনার পরিচয় অনেক আগেই জেনেছি ।  আপানার  সাথে দেখা করবার জন্যই গিয়েছিলাম । আপনার গুরু বিনা দোষে আমায় আর আমার অনুচরদের আক্রমণ করল । আপনি আমাদের ভাষা বুঝতে পারছেন , আমিও  শিখেছি , কেননা এইরকম আশ্রম আমাদের অঞ্চলেও রয়েছে । তাই বলছি , আপনারা আমাদের কদাকার , ইতর ভাবেন । তা ভুল । আমরা সর্পকূলকে সংরক্ষণ দিয়েছি । আপনারা আমাদেরই সর্প বানিয়ে , হত্যা করছেন । সাপ আমাদের জীবিকার অঙ্গ । তাদের  পোষ মানিয়ে খেলা দেখাই , আবার তাদের বিষ বিক্রি করে জীবিকা চলে । তাদের রক্ষা করতে হয় বনভারসাম্য রক্ষার জন্য । আপনারা আমাদের এই  জীবনধারার সাথে একেবারেই পরিচিত নন । তাই আমাদের মেনে নিতে পারছেন না।
-তুই কী বলতে চাইছিস ?
-একটা সত্যি কথা , আপনারা এখনো লিখতে শেখেন নি । আমি এই সত্য  শুনে নিয়েছি  ।  এটাও জানি আপনারা যে মহাকাব্য রচনা করেছেন তা সংরক্ষণের জন্য , লিখতে হবে । তাই আপনার গুরু দেবতাদের শরণাপন্ন হয়েছে । তারা রাজী হয়েছে  , কেননা তাদেরও প্রশস্থির দরকার , এরজন্য  সাহিত্য উত্তম মাধ্যম । তারা সাহিত্যের মাধ্যমেই মানুষের মনে ভীতির সঞ্চয় করতে চায় ।  ভারতের সভ্যতার সাথে সাহিত্যের ধারা এমন ভাবে জড়িয়েছে , যেমন এখানকার নদী , অরণ্য । আমরা এর কদর করি । তাইতো বুঝেছি , আপনারা চক্রান্ত করে সাহিত্যই বদলে দেবেন !
-তুই এত সব গোপন কথা  জেনেছিস ! বাঃ ...
-প্রভু ,   ব্যাস নিজের পুত্র শুকদেবকে প্রথম মহাকাব্য পড়ে শুনিয়েছে  । এই কাজ তিনি অরণ্যে  একান্তে থাকাকালীন করে  ফেলেছেন। সেই অরণ্যে শুক আর ব্যাসের মধ্যে যখন কথা চলছিল , আমি শুনে ফেলেছিলাম । আপনাদের মহাকাব্য আমিও জানি  । এই মহাকাব্যে যতটা দেবতাদের ভূমিকা রয়েছে , ততটাই ক্ষত্রিয় , ব্রাক্ষ্মণ  আর আমাদের মতন বনবাসীদেরও ।অথচ  পরিকল্পনা করে আমাদের অস্তিত্ব  অস্বীকার করছেন ! আমাকে মুক্ত করুন   । আমি আপনাকে প্রধান পুরোহিত করব ,আমরা আমাদের শ্রেণীর  কথা  বলব ।  তার নেতৃত্ব দেবেন আপনি । আসুন আমরা বন্ধু হই ।
-কেন ?
-আমরাও প্রতারিত ,আর আপনিও । আমি বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখব । কথা দিচ্ছি ।
-তুই কিছু খাবার খাবি । এই নে... আমি কাল আসব । তখনই এই নিয়ে কথা হবে ।
                                                            ৪

বৈশ্যাম্পয়ন দেখল , সে এই গরমে দ্বিগুণ ঘামছে !  আসলে সে একটা হত্যা কাণ্ডের সাথে জড়িত । সেই ইতর মানুষটি , মানে যাকে সে গুহায় দেখেছিল , তার মুখ  গুরুর  হাতে বন্দী হয়ে আশ্রমে নিয়ে আনা  ইতর সর্পকূলের ব্যাক্তিটির মতনই  । নিজের হাতে তাকে ফল খাইয়ে ছিল , এই ফলে মাখানো  ছিল বিষ ।  মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বার   আগেও সে বিশ্বাস করেছিল  বৈশ্যাম্পয়নের বন্ধুত্বে ।   শুধু তাই নয় , ফল যখন সে খাচ্ছিল , তার মুখ এক ক্ষুধা কাতর মানুষের মুখের  মতনই দেখাচ্ছিল ।
এই হত্যায় দুটো কাজ হয়ে গেল  । ব্রাক্ষ্মণ কখনই জীব হত্যার রক্ত হাতে মাখেনা , এই সত্যি যেমন রক্ষা পেল । তেমনই , ব্যাসের সাথে চুক্তি  স্থির হল - বৈশ্যাম্পয়নের  কাছে , সমাজে  নিজের প্রতিষ্ঠার  সুযোগ এসেছে  । এর পরিবর্তে অবশ্য তাকে নিজের সাথে আপোষ  করতে হবে ।

ব্যাস  কথা দিয়েছিল , ষাট লক্ষ শ্লোকের মধ্যে এক লক্ষ  রচিত  শ্লোক   প্রচারের অধিকার বৈশ্যাম্পয়নের  কাছে থাকবে । সে এই শ্লোক  মনুষ্যলোকে প্রচার করতে পারবে । এর বদলে সর্প কূলের  প্রতি অন্যায়ের যে অধ্যায়ের কথাটা , সে জেনে গিয়েছে , তা ভুলে যেতে হবে ।
জনমেজয়ের দরবারে মহাকাব্যের  প্রথম  কথাকার হয়ে উঠবার  লোভনীয় ঘুষটি , নিজের জাতির স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের থেকেও বেশি লোভনীয়  । সে অনন্ত যুদ্ধের কষ্ট ভোগ করতে চায়না । তার চেয়ে আপোষে  নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ ।
বৈশ্যাম্পয়ন বুঝতে পারল , গুহায় যে ইতর মানুষটির সাথে সে মুখোমুখি হয়েছিল , সেই মুহূর্ত  - আসলে একপ্রকার ভ্রমই  ছিল । এখন তাকে দ্রুত রাজা জনমেজয়ের দরবারে যেতে হবে । মহাকাব্যটি পাঠ করতে পারলেই ,  ইতিহাস  সৃষ্টি হবে ! বিবেকের অন্তর্ধান এখন খুবই জরুরি ।

  বৈশ্যাম্পয়নের  স্বপ্ন আজ এই গুহাতেই  বন্দী হয়ে রইল । সে এতটুকু বুঝেছে , এই পৃথিবীতে  সে একা  নয় । তার মতন আরও অনেক শোষিত মানুষ আছে । তাদের সাথে তফাৎ এতটুকুই , তারা লড়ছে আর  সে আত্মসমর্পণ করছে !
তাই কি ? এটাকে আত্মসমর্পণ না আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই বলবে ? এখন আপাতত এত কিছু ভাবতে চায়না ।




-














































কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন