বৈশ্যাম্পয়ন , একটি প্রলেতারিয়াত স্বপ্ন
পি না কি
১
সেই সকাল থেকে হাঁটছে , গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে । মাথার উপরের সূর্য এখন আকাশের মাঝখান থেকে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করল । আকাশে আলো আছে । সেই পাতলা ছায়ার মতন আলোয় , চারপাশে একটা দৃশ্য তৈরি হচ্ছে । কিছুক্ষণ খোলা ভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল । আকশের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে ; সূর্যের আয়ু আজকের দিনের মতন আর মাত্র কিছুক্ষণ । আচমকাই অন্ধকারে ঢেকে যাবে পৃথিবী। তখন আলো হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তে , নিজের অসহায়তা তাকে ঘিরে ধরবে । বৈশ্যাম্পয়ন এখন থম মেরে থাকবে । এই সময় কাঁদতে হয় , আপন জন যদি কেউ তাকে ছেড়ে চলে যায় , তার কথা ভেবে চোখ ভিজে আসে জলে ; এমন ভাবে কাঁদতে –কাঁদতে মন হাল্কা হবে । সে কষ্ট পায় । বুঝতে পারে , পৃথিবীতে আলোর দরকার , কেননা এই নিভে যাওয়ার সময় নিজেকে খুব একা মনে হয় । এখানে কেউই একা বেঁচে থাকতে চায়না।এই সময়টা , দিনের এই নিভে যাওয়া সূর্যের আলো যখন মিশতে থাকে আকাশের শিরা –উপশিরায় ঠিক তখনই , মনটা ভীষণ একা হয়ে ওঠে ।
এই পৃথিবীতে সে একা কি ? এই প্রশ্ন বৈশ্যাম্পয়ন নিজেকে আগেও করেছে । এখন সন্ধ্যা । পাখিরা ফিরছে । এই ফিরতে থাকা পাখিরা , বুক ছুঁয়ে থাকা অন্ধকারে সাঁতরে , নিজের বাসায় পৌঁছে যাবেই ! এরা অন্ধকারেও ঠিকানা ভুল করেনা । আসলে ঘর থাকলে , আপন জন থাকলে , ফিরবার তাগিদ থেকে যায় । নিজের এমন কোন তাগিদ নেই ।
বৈশ্যাম্পয়ন গুরু ব্যাসের ছায়ায় বেড়ে উঠেছে । গুরুর দীক্ষায় পালিত । আশ্রমে যজ্ঞের তাগিদে যে কাঠ জমিয়ে রাখা হয় , যাদের অনবরত নিবেদিত সেবার কোন কদর নেই , অথচ তারা ভীষণ ভাবে প্রয়োজনীয় ; ব্যাসের কাছে বৈশ্যাম্পয়নের উপস্থিতি যজ্ঞের কাঠের মতনই । নিজের জ্ঞান আর আত্মত্যাগের আগুনে দাউ –দাউ করে জ্বলছে , সেই সবের মর্যাদা সে হয়ত এই জীবনে আর পাবেনা।
আবার হাঁটতে শুরু করেছে । সে যেই জায়গায় থেমে গিয়েছিল , সেটা খুব বড় ফাঁকা সমতল ভূমি । ন্যাড়াই বলা যায় , ঘাসের দল মাথা তুলে আছে , তবে খাপছাড়া । মাঝে কিছু জায়গা উঁচু টিলা রয়েছে , তার পাশে আবার পাথরের পথ । সেই পথ আর টিলা বাদে গোটা ভূমি ধুলোয় ভরা । খুব বড় ফাঁকা মাঠটা পেরিয়ে যেতে হবে । হাতে সময় নেই । এই যে মাথার উপর আলোর শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে গেল , এখন নিজের অসহায়তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা ।
না , বৈশ্যাম্পয়নের মনে হচ্ছে মর্যাদা নয় , সে একটু ভালোবাসা চায় । এটা ঠিক মুনি বেদব্যাস নিজের পুত্র শুকদেবকে অতটা ভরসা করেন না , যতটা তার প্রিয় শিষ্য । এই কথা সকলেই জেনেছে , এক বিশ্বস্থ শিষ্য , কখনই পুত্রের স্থান নিতে পারবে না। । এই কথাটুকু যখনই ভাবছে , দু’ চোখ ভিজে গিয়েছে জলে । চোখের মনি দুটি , নিজের অজান্তেই ঝাপসা হয়ে গেল ! একে চারপাশে আলো নেই , তারউপর মনের দুর্বলতা , সব কিছু মিলিয়ে অবসন্ন দেহ , আশ্রয় খুঁজছে । সে চাইছে না আর বেশি দূর এগিয়ে যেতে ।
আজ রাতের মতন থাকবার জায়গা খুঁজতে হবে , পাথুরে এলাকা তাই সে নিজেও দুই বড় টিলার মাঝখানে কোন গুহা খুঁজছে । তাকে এখন যে কাজটা করতে হবে , খুঁজতে হবে । মাথার উপরে যে আকাশটা , দ্রুতই রাতের দিকে চলেছে ! এই খোলা জমিতে বন্য জন্তুর অভাব নেই । দস্যুও রয়েছে ; তাতে অবশ্য ভয় পায়না । তবে আসল কথা হল এখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও আর ভালো লাগছিল না। সেই ভোর হতেই আশ্রম থেকে হাঁটছে , যেতে হবে রাজর্ষি জনমেজয়ের রাজধানী । সেখানে তার কাঁধে এক বড় দায়িত্ব রয়েছে ।
একটু উঁচু –নিচু পাথুরে পথ টপকিয়ে , গুহার মুখে এসে দাঁড়ালো । বৈশ্যাম্পয়ন দুটো পাথরের মুখোমুখি ঘর্ষণে , আলো জ্বালিয়ে নিয়েছে । নিম কালো আকাশ , চারপাশের ফাঁকা জমিতে জমে থাকা অন্ধকার , দূরে ময়লার মতন স্থবির অরণ্য , মাঝে এক বছর তিরিশের যুবকের হাতে কাঠের মুখে জ্বলতে থাকা আগুন ; লেলিহান শিখায় গুহা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল । ভিতরে অনেকটাই জায়গা আছে , ময়লা , আর সবুজ রঙ হারানো বুড়ো ঘাসে ভরে গিয়েছে । ভিতরে গিয়ে বসল । অন্ধকারের বুক চিঁড়ে আলোর রেখা যেন আচমকাই প্রবেশ করল , কয়েকটি চামচিকে উড়ে গেল । আজ রাতে অন্তত এখানে ঘুমানো যাবে ।
গুহার ভিতরে বসে , প্রথমে মুখে জলের ঝাপটা দিল । ঝোলা থেকে আপেল নিয়ে কামড় দিতেই , গুরুর কথা মনে পড়ল । এখন রাত মধ্য রজনী স্পর্শ করতে কিছুটা সময় বাকি , সে গুহার দেওয়ালে দিয়ে শুয়ে পড়ল । অনেক রাত হবে , গভীর রাতে ক্লান্ত আর ক্ষিধে পেটে খাবারের আশ্বাস পৌঁছাতেই ; চোখে ঘুমের আদর নেমেছে ।
আগুনের শিখা এখন স্থির , এই সময় ঘুমিয়ে থাকা বৈশ্যাম্পয়নের নাকে পাতলা গন্ধ ভেসে আসছে । সেই গন্ধে ঘুম ভাঙল । পাশে কাঠটা পুড়তে –পুড়তে অনেক কম আলো নিয়ে এখনো জ্বলছে , সেই অপরিমিত আলোয় গুহার কোনায় একটা মূর্তি দেখতে পেল !
বৈশ্যাম্পয়ন বুঝতে পারছে না, গুহার মুখে সে বসে আছে । তার ডানদিকে আলোদণ্ড রাখা আছে । কোন পশু হবেনা । মানুষই হবে । সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে । মূর্তিটি নড়ছে । হামাগুড়ি দিয়ে আলোর কিছুটা তফাতে থামল । এই দিকেই তাকিয়ে রয়েছে ।
২
আগুনের আলোরয় মানুষটির মুখ দেখা যাচ্ছে । নিম্মাঙ্গে পশুর ছাল পড়ে আছে । মাথার চুল জট ধরা । গায়ের রঙ কালো । এই গুহায় তার উপস্থিতি , ময়লার থেকে বাড়তি কিছু নয় ।বৈশ্যাম্পয়ন দেখল , মানুষটি খুব দ্রুত নিঃশ্বাস নিয়ে চলেছে ! বুক ওঠানামা করছে । এইবার , নাকে ভেসে আসা দুর্গন্ধের রহস্য বুঝতে অসুবিধা হল না । এই মানুষটি নির্ঘাত কাঁচা মাংস খায় । নাক – মুখের ভিতর থেকে যে নিঃশ্বাস ঝরছে , সেখানেই টের পাওয়া গেল ! এখানে এই অবাঞ্ছিত মানুষটির উপস্থিতি সহ্য করতে পাচ্ছিল না। এই বনবাসী , বন্য , কূট , আর ম্লেচ্ছ জনজাতি ; যাদের সভ্য জগতে কোন স্থান নেই । এদের হত্যাই একমাত্র পথ । এরা সভ্য জগতে আসলেই , সেখানকার পরিবেশ দূষিত হবে ; এখানকার পরিবেশ এই এখন যেমন ভাবে নষ্ট হচ্ছে ।
-আপনার ঝুলিতে কিছু খাবার থাকলে দিন । খুব জ্বালা করছে পেটটা । মনে হচ্ছে ফেটে যাবে । ক্ষিধে চাপলে গোটা শরীরটা ছিঁড়ে যায় , প্রভু । দিননা । কিছু খাবার ।
-তুই কে ? চেহারা দেখে ঘেন্না লাগছে । গাঁ ঘিন ঘিন করছে । আমি বেদজ্ঞ ব্যাস মুনির শিষ্য । এত বড় সাহস , আমাকে খাবার দিতে বলছিস !
-প্রভু , মরণাপন্ন মানুষের আবার জাতে বিচার থাকে নাকি ! আমি ক্ষিধের জ্বালায় মরতে বসেছি । এখন আমি যদি বিচার করি , আপনি আমার শত্রু না মিত্র , বা আমি আপনার হাতের খাওয়া খেতে পারব কিনা ? নিজের প্রাণ তাতে বাঁচবে ?
-তোর সারা শরীরে বিষ্ঠা মেখে আছে । বিশ্রী গন্ধ ছড়াচ্ছে ।
-আমি যে তিনদিন ধরে পালিয়ে বেরিয়েছি ! আপনার এই গুহার ভিতরেই একটা ছোট্ট গুহা আছে ,পাশেই । সেখানেই আমি দু’দিন ছিলাম লুকিয়ে । এই আজ আপনাকে আগুন নিয়ে ঢুকতে , বুঝতে পারলাম এখন যদি না চাই , আর বাঁচব না। সবাই বাঁচতে চায় । আমিও চেয়েছি । দোষ কোথায় বলুন ?
বৈশ্যাম্পয়নের মনে হল , ইতর শ্রেণীর মানুষটা ভুল কিছু বলেনি । বেদে দেবতাদের অন্নসংস্থান করাই তাদের সহায়তা পাওয়ার একমাত্র পথ । তাই আশ্রম এক দীর্ঘ সময় ধরে দেবতাদের সাথে চুক্তি বদ্ধ হয়েছে। এই ইতরতার থেকে পাওয়ার কিছু নেই , তাই তার প্রাণ রক্ষার দায় নেই । এটা বৈদিক সংস্কার । তবে এর বাইরেও এটাও ঠিক প্রতিটি মানুষ নিজের জন্য লড়াই করে । সে বলল
-তুই পালিয়ে বেরাচ্ছিস কেন ? নিশ্চই কোথাও উপদ্রব করেছিস ।
-হাসালেন । আমরা দুর্বল জাতি । ক্ষত্রিয়দের সামনে মাথা তুলবার সাহস নেই । উপদ্রব ! আমাদের অত অস্ত্র বল নেই , গোষ্ঠী বদ্ধ প্রচার নেই । দেখুন কেমন ছিন্ন হয়ে পড়েছি !
- তোর এমন অবস্থার পিছনে কারণ আছে ?
-হাসালেন , রাজা জনমেজয়ের অত্যাচারে সবাই কানে হাত দিয়েছে । আপনি ব্রাক্ষ্মণ, আপনারাও শুনেছি কানে হাত রেখেছেন । তাই বলে সত্য স্বীকার করবেন না !
-মানে ?
-জনমেজয় আর তার সেনাবাহিনী নির্বিচারে সাপ মারবার পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছে । সেই অত্যাচারকে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের আড়াল দেওয়ার জন্য আপনাদের সমর্থন চেয়েছে । আপনারা দিচ্ছেন সহায়তা । আমি জানি সবাই নিজের দিকটা ভাবছে । তাই এত ভয়ঙ্কর আর নিষ্ঠুর হত্যা যজ্ঞকে উৎসবের মতন আনন্দ যজ্ঞ করে তুলছেন । সর্প হত্যা করে , আমরা যারা বনে থাকি , সাপের বিষ নিয়ে বানিজ্য করতাম , তাদের জনজাতিকে বিলুপ্ত করে দেবেন !
-এটা ঠিক রাজা জনমেজয় যজ্ঞ করছেন । আর এটাও ঠিক দুর্বলের উপর অত্যাচার , রক্ষাকর্তা ক্ষত্রিয়দের শোভা পায়না । তোরা রাজার বিরুদ্ধাচারণ করেছো । শুধু তাই নয় , রাজাকে গুপ্ত হত্যা ক্রতে চেয়েছো। তোমাদের শাস্তি পাওয়া কি অন্যায় ?
-কিসের জন্য ? এই ভূমি থেকে আমাদের উৎখাত করবেন । আমরা মেনে নেব ? এই ভূমি যতটুকু আপনাদের ততটুকুই আমাদের নয় ? অথচ আজ আমরা নিজেদের জনবসতি চখের সামনে পুড়তে দেখছি! আমাদের মেয়েদের চিৎকার , শিশুদের কান্না , এখনো আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে । আর কত ? এর পিছনে শুধুই দখলের রাজনীতি রয়েছে ।
-রাজার সাথে এই বিবাদের কারণ ?
-রাজা আমাদের কাছে শুল্ক চাইছিল । এত দিন আমরা আমাদের ভূমিতে বসবাস করতাম স্বাধীন ভাবে । একদিন আচমকাই খবর এলো , রাজাকে কর দিতে হবে । নিজেদের মায়ের মতন এই ভূমি , ওদের হাতে তুলে দিতে হবে ! জীবন থাকতেও আমরা আমাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দেব না।
-যাদের প্রতিরোধের ক্ষমতাই নেই , তারা নিজেদের ভূমি নিয়ে এত সজাগ কেন ?
-ক্ষমতা নয় , প্রতিরোধ করবার জন্য ইচ্ছা দরকার । নিজেদের জনজাতির সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা থাকা দরকার । আমাদের কাছে আমাদের সভ্যতাই সব , তাকে রক্ষা করবার জন্য নিজেদের শেষ রক্তটুকু দিয়ে লড়ে যাব । যে সর্প যজ্ঞে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্ষত্রিয়রা এসেছে , নিজেদের ক্ষমতার কথা বলছে , তাদের কাছে নতুন করে কিছু বলবার নেই ।
এত কিছু শুনবার মাঝেই , ঝুলি থেকে আপেল নিয়ে , সামনের মানুষটির দিকে ছুঁড়ে দিল । সে লুফে নিয়ে খুব দ্রুত খাচ্ছে । এই লোকটি সর্প গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত । ক্ষত্রিয়রা অরণ্য , ভূমি দখল করে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চাইছে । সর্প গোষ্ঠীভুক্ত রা তাদের পাওনা থেকে সরবে না । আসলে এই যে প্রসারিত বনজ সম্পদ , পশু সম্পদ – তা একেবারে অসুরক্ষিত অবস্থায় থাকতে পারে না। জনমেজয় আশ্রমের সহায়তা চেয়েছিল , আশ্রম সেই প্রস্তাবে সাড়া দিল । কেননা আশ্রম গুলোকেও নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখবার জন্য এই সর্প হত্যার যজ্ঞে সামিল হতে হয়েছে । কেননা ক্ষত্রিয়দের পাশে না থাকলে , সেখান থেকেও সহায়তা পাওয়া যাবে না । গুরুর কথা শুনে , সে নিজে কয়েকদিন সর্প ভূমিতে ছিল । সেখান থেকেই সে এই ম্লেচ্ছ ভাষা শিখেছে । এই ভাষাকে কখনই স্বীকৃতি দেওয়া হবে না । এরা এই দেশের অধিবাসী হলেও , আধুনিক ভারতে এদের ভূমিকা , অস্তিত্ব অতি সুকৌশলে মুছে ফেলা হবে । সেই কাজই চলছে ।
-তোদের এই অবস্থার জন্য , তোরাই দায়ি ।
কথাটা বলেই , বৈশ্যাম্পয়ন ঝুলি থেকে কলা বের করে এগিয়ে দিল । মানুষটি দ্রুত তা নিয়ে বলল
-কেন ?
-এই সমাজ উচ্চবান , উচ্চ বৃত্তির সম্প্রদায়কে সুরক্ষা প্রদান করে । তাদের স্বার্থের জন্য সমাজে সমান্তরাল ভাবে দু’ টো শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে । এরা দুজনেই প্রতারিত আর শোষিত । এই দু’ টো শ্রেণীকেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ব্যবহার করে উচ্চবৃত্তির সুরক্ষিত সম্প্রদায় । আমি আর তুই সেই দু’ টো শ্রেণী অবলম্বনকারী , যাদের উপর রাজা জনমেজয়ের ক্ষমতা নির্ভর করবে , তার হাতে ক্ষমতা আছে , ভূমি আছে আর আমাদের বুদ্ধি আর তোদের শ্রম । রাজা জনমেজয় আমাদের বুদ্ধি ভাড়া করবে , তোদের শ্রমকে দখল করবার জন্য । তোরাই সমাজের তলানিতে থাকা বর্বর ভিড় ।
-ঠিক বলেছেন । এটাই কারণ আপনার শ্রমকে খাটিয়েও আপনার গুরু তার পুত্র শুকদেবকেই আগে এই মহান কাব্য পাঠ করে শুনিয়েছেন ! আপনি শুধুই মানুষের জন্য যে মহাকাব্য , তারই স্বত্বাধিকারী হলেন ! অথচ আপনি নিজেও জানেন , দেবতাদের কাছেও আপনার কদর হওয়া উচিত ছিল । আপনিই প্রথম শ্রবণের অধিকারী ছিলেন । শুধু তাই নয় , রক্তের সম্পর্ক শ্রমের থেকেও এগিয়ে রইল । আমরা দুই সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে , আর সুবিধা নিল আমাদের মাথায় থাকা শ্রেণী ! আমরা সব কিছু জেনে –বুঝেও চুপ হয়ে আছি !
-মানে ?
আরে ! মানুষটি কোথায় ! আগুন নিভে গিয়েছে , পোড়া কাঠ ছাই হয়ে ছড়িয়ে , কালো । পিছনের পথ থেকে ব্যাটা নির্ঘাত পালিয়েছে । গুহার মুখে , ভোরের ছাপ পড়েছে । কানেতে কাকের ডাক এল ।
এতক্ষণ বৈশ্যাম্পয়ন খেয়াল করেনি , সে দেখল কথা গুলো বলেই , কিছুক্ষণ আগেই হয়ত ইতর মানুষটি অন্তর্ধান হয়েছে ! তাকে দেখতে পেল না ।
আলে গড়িয়ে যাওয়া জলের মতনই , গুহার বাইরে থেকে ভোরের আলো ক্রমশই ভিতরে এসে পড়েছে । এখন বসে থাকলে সন্ধ্যার আগে রাজা জনমেজয়ের রাজধানীতে পৌঁছাতে পারবে না।
৩
রাস্তায় নেমেই আগের রাতের দুঃস্বপ্ন , বৈশ্যাম্পয়নকে তাড়া করছিল । এখনো অব্দি যতটুকু মনে পড়ছে তা হল , আশ্রয়মুখর হয়ে সে গুহার ভিতর বসল । হাতে ছিল জ্বলন্ত কাঠ আর কমণ্ডলু । বাঁ’ কাঁধের ঝোলা থেকে সে নিজে কিছু ফল খাবে , তাই গুহার মেঝেতে বসে পড়ল । কমণ্ডলুর জল দিয়ে মুখ ধুয়েছে । ফল খেয়েছে । তারপরই চোখে তন্দ্রা ! ঘুম – ঘুম ভাব । এরপর আর কিছু মনে নেই ।
মাঝরাতেই হবে হয়ত , নাকে দুর্গন্ধের জন্য চোখ খুলে আগুনের উল্টো দিকে , সেই ইতর শ্রেণীর মানুষটা!
তারপর ?
এমনভাবে সে এসে প্রাণ ভিক্ষা চাইছিল , খাবার দিল । ইতরটি তারপর চলেও গেল ! সে গেলেও এমন অনেক কথাই বলে গিয়েছে , যা বৈশ্যাম্পয়নের মনে প্রশ্ন তুলেছে । এই মানুষটি পূর্বপরিচিত না তো ? যদি তাই হবে , তাহলে চিনতে এত অসুবিধা কেন ? আর যদি অপরিচিতই হবে , তাহলে যে মহাকাব্য এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি , জনসমক্ষে ; সেই সাহিত্যের পিছনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র টের পেয়ে গেল ! এই ব্যাপারটা ভাবতেই , শরীরের রোম খাড়া হয়ে উঠল । সে ভাবছে , যে একমাস সে ক্ষত্রিয়দের মারণ যজ্ঞের পৌরোহিত্য করেছিল , সেই দিন গুলোতে তার পরিচিত কেউ ছিল ?
এইবার খুব ভালো করে , মোলায়েম ভাবে নিজের স্মৃতিকে চাপ দিল ।
এক দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার পর , শেষ পর্যন্ত ব্যাস মুনি একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল । সে অবশেষে ভারতবর্ষের পরিচয় লিপিবদ্ধ করে ফেলেছে । যে দীর্ঘ স্ম্য ধরে ক্ষমতা দখলের লড়াই হয়েছে , শ্রেণী সংগ্রামের জন্য চলেছে সংঘর্ষ , সব কিছু নিজের চোখে দেখেছে । এই দিন গুলোয় ব্যাসের খুব কাছের বিশ্বাসযোগ্য ছিল বৈশ্যাম্পয়ন । সে নিজেই সব কিছু সংগ্রহ করেছে । এখানেই নয় ক্ষত্রিয়রা যখন দেখল অরণ্যভূমি দখলের জন্য সর্পকূলের বিনাশ আবশ্যক । ঠিক তখনই ব্যাসের সাথে তারা চুক্তিতে বসল ।
ব্যাস এমনই এক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দেব ভূমি থেকে ফিরেছে । আশ্রমে মুনির ফিরে আসায় সকলেই বেশ আনন্দিত ।
তখন মধ্যসকাল । গ্রীষ্ম ঋতুতে , খোলামেলা হাওয়ায় ভাসছে গাছের পাতা । ব্যাস মুনি প্রবেশ করলেন । সাথে দেবতাদের তরফ থেকে প্রচুর উপটৌকন । এর সাথে অনেক পিছনে , জালের ভিতর কালো পশু । ভীষণ নোংরা আর বিশ্রী গন্ধে ভরা ।
বৈশ্যাম্পয়ন বলল – গুরুদেব আপনার সাথে সমস্ত উপটৌকন তাৎপর্য বুঝতে পারলেও । এই জালে কী আছে ?
ব্যাস মুনি বলল – সাক্ষাৎ মৃত্যু । সর্পকূলের এক জন্তু বিশেষ । রাজা জনমেজয়ের কাছে একে পাঠানো হবে। যাতে তিনি বুঝতে পারেন , আমাদের এই সর্প নিধন যজ্ঞে অনুমতি আছে । আমি জানিনা , এটা মারা গিয়েছে কিনা ! আমি অরণ্যে ঘুরছিলাম , দেখি একজায়গায় এদের জটলা হতে । আমার সাথে থাকা লোকেরা আক্রমণ করে ওদের হত্যা করল । আমি ভাবলাম কয়েকটাকে ধরে এনে প্রিচ্য করাই । তোমরা তরুণ সন্ন্যাসী । সব কিছুতেই অভিজ্ঞতা থাকা দরকার । একে নিয়ে পরীক্ষা করে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি কর । তুমিতো ওদের ভাষা কয়েকদিন আগেই চর্চা করছিলে ।
-ঠিকাছে গুরুদেব ।আমি এটাকে পিছনের পরীক্ষা কক্ষে নিয়ে গিয়ে রাখছি ।
বিকেলের আলো তখন মিশছিল , অরণ্যের পাতায় –পাতায় , ঘাসেদের তুলতুলে শরীরে , পাখিদের মোলায়েম স্বপ্ন ভরা চোখে । এই সময় পৃথিবীতে ধীরে –ধীরে রং পাল্টায় , মনের সংগোপনে , জমা হয় কথা । এখনই গোধূলি সন্ধ্যার সাজে সেজেছে প্রকৃতি । খোলা সরবরের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছে ।
সূর্যাস্তের পরেই , বৈশ্যাম্পয়ন আশ্রমে ফিরে এলো । তার মনে হল , পরীক্ষা কক্ষে সেই জীবটি এখনো বেঁচে আছে ? যদি থাকে , তাহলে এটাই পর্যবেক্ষণের উত্তম মুহূর্ত ।
খুব দ্রুত কক্ষে ঢুকে , দরজা বন্ধ করে দিল । কক্ষের ভিতর জালে জড়ানো জীবটি ধুঁকছে !
-আপনি ভয় পাচ্ছেন ! আমরা সাপেদের সংরক্ষণ করি । আমরা আপনাদের কাছে পশু হলেও , আমরা মানুষ । আমাদের হত্যা করছেন নির্বিচারে , আমাদের প্রজন্ম নষ্ট করা হচ্ছে । আর আপনারা এই মৃত্যু যজ্ঞকে ধর্ম যজ্ঞ বলছেন ! ভালো , এই আপনাদের বিচার ! সভ্যতা ! বৈদিক পরম্পরা ! আমাদের অরণ্যও আমাদের কাছে থেকে কেড়ে নেবেন !
-আমি ব্যাস মুনির শিষ্য বৈশ্যাম্পয়ন ।
-আমি আপনার পরিচয় অনেক আগেই জেনেছি । আপানার সাথে দেখা করবার জন্যই গিয়েছিলাম । আপনার গুরু বিনা দোষে আমায় আর আমার অনুচরদের আক্রমণ করল । আপনি আমাদের ভাষা বুঝতে পারছেন , আমিও শিখেছি , কেননা এইরকম আশ্রম আমাদের অঞ্চলেও রয়েছে । তাই বলছি , আপনারা আমাদের কদাকার , ইতর ভাবেন । তা ভুল । আমরা সর্পকূলকে সংরক্ষণ দিয়েছি । আপনারা আমাদেরই সর্প বানিয়ে , হত্যা করছেন । সাপ আমাদের জীবিকার অঙ্গ । তাদের পোষ মানিয়ে খেলা দেখাই , আবার তাদের বিষ বিক্রি করে জীবিকা চলে । তাদের রক্ষা করতে হয় বনভারসাম্য রক্ষার জন্য । আপনারা আমাদের এই জীবনধারার সাথে একেবারেই পরিচিত নন । তাই আমাদের মেনে নিতে পারছেন না।
-তুই কী বলতে চাইছিস ?
-একটা সত্যি কথা , আপনারা এখনো লিখতে শেখেন নি । আমি এই সত্য শুনে নিয়েছি । এটাও জানি আপনারা যে মহাকাব্য রচনা করেছেন তা সংরক্ষণের জন্য , লিখতে হবে । তাই আপনার গুরু দেবতাদের শরণাপন্ন হয়েছে । তারা রাজী হয়েছে , কেননা তাদেরও প্রশস্থির দরকার , এরজন্য সাহিত্য উত্তম মাধ্যম । তারা সাহিত্যের মাধ্যমেই মানুষের মনে ভীতির সঞ্চয় করতে চায় । ভারতের সভ্যতার সাথে সাহিত্যের ধারা এমন ভাবে জড়িয়েছে , যেমন এখানকার নদী , অরণ্য । আমরা এর কদর করি । তাইতো বুঝেছি , আপনারা চক্রান্ত করে সাহিত্যই বদলে দেবেন !
-তুই এত সব গোপন কথা জেনেছিস ! বাঃ ...
-প্রভু , ব্যাস নিজের পুত্র শুকদেবকে প্রথম মহাকাব্য পড়ে শুনিয়েছে । এই কাজ তিনি অরণ্যে একান্তে থাকাকালীন করে ফেলেছেন। সেই অরণ্যে শুক আর ব্যাসের মধ্যে যখন কথা চলছিল , আমি শুনে ফেলেছিলাম । আপনাদের মহাকাব্য আমিও জানি । এই মহাকাব্যে যতটা দেবতাদের ভূমিকা রয়েছে , ততটাই ক্ষত্রিয় , ব্রাক্ষ্মণ আর আমাদের মতন বনবাসীদেরও ।অথচ পরিকল্পনা করে আমাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন ! আমাকে মুক্ত করুন । আমি আপনাকে প্রধান পুরোহিত করব ,আমরা আমাদের শ্রেণীর কথা বলব । তার নেতৃত্ব দেবেন আপনি । আসুন আমরা বন্ধু হই ।
-কেন ?
-আমরাও প্রতারিত ,আর আপনিও । আমি বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখব । কথা দিচ্ছি ।
-তুই কিছু খাবার খাবি । এই নে... আমি কাল আসব । তখনই এই নিয়ে কথা হবে ।
৪
বৈশ্যাম্পয়ন দেখল , সে এই গরমে দ্বিগুণ ঘামছে ! আসলে সে একটা হত্যা কাণ্ডের সাথে জড়িত । সেই ইতর মানুষটি , মানে যাকে সে গুহায় দেখেছিল , তার মুখ গুরুর হাতে বন্দী হয়ে আশ্রমে নিয়ে আনা ইতর সর্পকূলের ব্যাক্তিটির মতনই । নিজের হাতে তাকে ফল খাইয়ে ছিল , এই ফলে মাখানো ছিল বিষ । মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বার আগেও সে বিশ্বাস করেছিল বৈশ্যাম্পয়নের বন্ধুত্বে । শুধু তাই নয় , ফল যখন সে খাচ্ছিল , তার মুখ এক ক্ষুধা কাতর মানুষের মুখের মতনই দেখাচ্ছিল ।
এই হত্যায় দুটো কাজ হয়ে গেল । ব্রাক্ষ্মণ কখনই জীব হত্যার রক্ত হাতে মাখেনা , এই সত্যি যেমন রক্ষা পেল । তেমনই , ব্যাসের সাথে চুক্তি স্থির হল - বৈশ্যাম্পয়নের কাছে , সমাজে নিজের প্রতিষ্ঠার সুযোগ এসেছে । এর পরিবর্তে অবশ্য তাকে নিজের সাথে আপোষ করতে হবে ।
ব্যাস কথা দিয়েছিল , ষাট লক্ষ শ্লোকের মধ্যে এক লক্ষ রচিত শ্লোক প্রচারের অধিকার বৈশ্যাম্পয়নের কাছে থাকবে । সে এই শ্লোক মনুষ্যলোকে প্রচার করতে পারবে । এর বদলে সর্প কূলের প্রতি অন্যায়ের যে অধ্যায়ের কথাটা , সে জেনে গিয়েছে , তা ভুলে যেতে হবে ।
জনমেজয়ের দরবারে মহাকাব্যের প্রথম কথাকার হয়ে উঠবার লোভনীয় ঘুষটি , নিজের জাতির স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের থেকেও বেশি লোভনীয় । সে অনন্ত যুদ্ধের কষ্ট ভোগ করতে চায়না । তার চেয়ে আপোষে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ ।
বৈশ্যাম্পয়ন বুঝতে পারল , গুহায় যে ইতর মানুষটির সাথে সে মুখোমুখি হয়েছিল , সেই মুহূর্ত - আসলে একপ্রকার ভ্রমই ছিল । এখন তাকে দ্রুত রাজা জনমেজয়ের দরবারে যেতে হবে । মহাকাব্যটি পাঠ করতে পারলেই , ইতিহাস সৃষ্টি হবে ! বিবেকের অন্তর্ধান এখন খুবই জরুরি ।
বৈশ্যাম্পয়নের স্বপ্ন আজ এই গুহাতেই বন্দী হয়ে রইল । সে এতটুকু বুঝেছে , এই পৃথিবীতে সে একা নয় । তার মতন আরও অনেক শোষিত মানুষ আছে । তাদের সাথে তফাৎ এতটুকুই , তারা লড়ছে আর সে আত্মসমর্পণ করছে !
তাই কি ? এটাকে আত্মসমর্পণ না আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই বলবে ? এখন আপাতত এত কিছু ভাবতে চায়না ।
-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন