ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭

আগ্নেয়গিরি
              ‎       সোমা দে

সেই যেদিন সোমবার সকালে অফিস যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সুলতা গলা জড়িয়ে বললে, "আজ অফিস নাই বা গেলে", হঠাৎ আগ্নেয়গিরি অনুভব করেছিলেন ভিতরে ভিতরে। সেইদিনই ঠিক করেছিলেন অমিয়, একদিন সুলতাকে ঠিক আগ্নেয়গিরি দেখতে নিয়ে যাবেন। যদি যাবেন, তাহলে যাবেন একুয়াডোরে, যেখানে জ্বলছে পৃথিবীর অন্যতম জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি কোটোপোক্সি। প্রতিদিন অমিয় ভেবেছেন, ওখানে পৌঁছে হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে বলবেন, "সুলতা, সেদিন যে আগুন জ্বালিয়েছিলে, দেখো উস্কে উস্কে আজ কি রকম লাভা। সুলতা, এই যে তোমার সামনে আমি, আমি নই, এ সব তোমারি আভা।" সরকারি চাকুরে অমিয় একটু একটু করে জমাতে শুরু করলেন খুচরো, নকশা, চিলতে উত্তেজনা, অফুরান মাতন আর বেশি বেশি করে মনখুশি। উত্তর কলকাতার ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো এতদিনে ওনাকে চিনে গেছে, আজকাল মার্কেটিং স্পৃহা নিভিয়ে ওনাকে দেখলেই সবাই কিরকম উঠি উঠি করে। সুলতার পাসপোর্ট এক্সপায়ার করবে আগামী বছরে। অমিয় এখন অবসরপ্রাপ্ত। যদিও শুধুমাত্র ওই দশটা-পাঁচটা থেকেই। বাকিটা একইরকম। বোহেমিয়ান। সুলতার শরীরটাই যা চিন্তার। আগ্নেয়গিরি প্রতিরাত্রে স্বপ্নে ফুটে উঠে, সে যে এখনো অপেক্ষায়, তা মনে করিয়ে দিয়ে যায়। জানুয়ারির একসকালে নিজের আর সুলতার পাসপোর্ট নিয়ে পৌঁছে গেলেন ট্র্যাভেল এজেন্সিতে। সব কথাবার্তা যে স্পিডে এগোচ্ছিল, অ্যাডভান্সটা দিতেই কেমন তা হঠাৎ বেড়ে চারগুণ। ফ্লাইটে মাখাসন্দেশ আর হোটেলে পাশবালিশের অনুরোধ ছিল অমিয়র। ট্র্যাভেল এজেন্সির কর্ণধার বললেন, জায়গাটা যেহেতু একুয়াডোর, কলকাতার বাহুডোরে একেবারেই নয়, তাই নাকি এরকম প্রেফারেন্সগুলোতে বাগডোর লাগাতে হবে। যাক, আসল কাজটা হলেই হলো। মিট উইথ আগ্নেয়গিরি। বাড়ি গিয়ে সুলতাকে জানানোর উত্তেজনাটা যেন ক্রমশঃ স্ফীত। সুনীলের দোকান থেকে গরমাগরম বেগুনি আর আলুর চপ নিয়ে ঢুকলেন বাড়িতে। সুলতা তখন চা বানাচ্ছিল। হাতে প্যাকেট দেখতেই বলে উঠলে , "কোথায় গিয়েছিলে, এতো দেরি হলো? আমি ফোন করতে গিয়ে দেখি ফোনটা অন্ধকার হয়ে আছে। আলোটা জ্বললে তবেতো কল করতে পারবো বলেছিলে। দেখে দিও তো। এই আবার ভাজা ভুজি নিয়ে এসেছো? চা টা খেয়ো না তাহলে। এসিডিটি হয়ে রাতের ঘুমটা যাবে তোমার। বাসু-ঠাকুরপো বলেছে, তোমার ঘুমটা দরকার। ঘুমের ওষুধ   .... " অমিয় থামিয়ে বললেন,"উফ, একটু চুপ করবে। একটু দম নিয়ে নিয়ে বলো। একসাথে এতো কথার কি আছে। আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি? এস তো, পাশে বস। বল, সব শুনছি।" সুলতা বললে,"এখন আমার বসলে চলবে না, শান্তি আসেনি। বাসনগুলো না পরিষ্কার করলে অশান্তি বাড়বে।" অমিয় বললেন,"আহা হবে হবে। এসো না একবার।একটা কথা বলার আছে তোমাকে।"সুলতা পাশে বসতেই অমিয় বলেন,"বলছি, গলা জড়িয়ে ধরতো সেই বৌভাতের পরের দিনের মতো। কি হলো হাসছো কেন? আরে পাগল তো হয়েছি আমি সেইদিনই, এবার বোধহয় উন্মাদ। হা হা আচ্ছা বলছি জানতো এই মে তে বুঝলে? মানে আমরা যাবো বুঝলে? ফাইনাল। সব বুক করে দিয়ে এসেছি" সুলতা হা করে বলেন,"একুয়াডোর? বুক করে দিলে?" অমিয় বলেন,"একদম মহারানী" সুলতা বলেন,"সত্যি তুমি পারো বটে। সব ক্যানসেল কর। তোমার হার্ট চেকআপটা আগে দরকার। তারপর সব কিছু। তুমি সত্যিই বোঝোনা।" অমিয় বলেন,"সুলতা, শোনো।"  সুলতা বলেন,"কিচ্ছু না। একদম কিচ্ছু না। ক্যানসেল কর শিগগির। কি হলো, চললে কোথায়?" অমিয় গম্ভীরভাবে চলে গেলেন অন্য ঘরে। কিছুক্ষন পর সুলতা ধীর পায়ে ঘরে পৌঁছে অমিয়র মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,"আচ্ছা শোনো, আমি পারবো? আমার যা শরীর। তোমার স্বপ্নের জায়গা দেখার ইচ্ছে আমার মধ্যেও ধীরে ধীরে চাক বেঁধেছে যে" শুনেই লাফিয়ে উঠলেন অমিয়, বলেন,"সত্যি? সত্যি যাবে? তাহলে আমাকে এরকম ভয় পাওয়ালে কেন? তুমি সত্যি সুলতা। শোনো, কাল থেকেই প্যাকিং শুরু করতে হবে। ওহ কি আনন্দই যে হচ্ছে সুলতা। হে আমার একুয়াডোর, বাড়াও তোমার বাহুডোর।হিয়ার আই কাম। বলছি শোনোনা আমার ওই হার্ট চেকআপের জমানো থেকে কিছুটা লাগবে। দেবে? মানে বাকি সব হয়ে গেছে। শুধু লোকাল ট্যুরের খরচটা.... বলছি যে চিন্তা করোনা। ছেলের প্রতিমাসের পাঠানো টাকা থেকেই পরে চেকআপের টাকাটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। যাবে না? বলো? দেখেছো সব কিরকম প্ল্যানড। কি হলো যাচ্ছো কোথায়?" সুলতা হাসতে হাসতে আস্তে আস্তে আলমারি থেকে কি একটা এনে গুঁজে দিলো অমিয়র হাতে। অমিয় বলেন,"এটাই? উফ সুলতা। বাপরে এতো জমিয়ে ফেলেছো। তুমিই আমার একুয়াডোরিয়া। মাই কুইন।"

ফেব্রুয়ারিতে হস্পিটালাইসড হলেন সুলতা। অমিয় পাগলের মতো ছুটোছুটি করে নার্সিংহোমে এডমিট করলেন সুলতাকে, একুয়াডোরের জমানো টাকা খরচ হতে থাকলো জলের মতো। অমিয় বন্ধু-ডাক্তারের সাথে দেখা করার পর জানলেন, সুলতার হার্ট বিপজ্জনক অবস্থায়। ফ্লাইট তো দূরের কথা, বাড়ির কাজকর্মেও রেস্ট্রিকশন এখন থেকে। অমিয় আরও জানলেন, সুলতা নিজের হার্টের এ অবস্থা অনেক আগে থেকেই জানেন। গতবছর থেকে যে পেসমেকারটি সুলতার হৃত্স্পন্দন নিয়মিত রাখছে, তা সুলতা ডোনেট করে দিয়েছেন সরকারিভাবে অমিয় র নামে। রহস্য চিরকালই অমিয়কে টানে। কিন্তু এতটা সামলাতে সময় লাগলো অমিয়র। অমিয় সব শুনে মুচকি হেসে সুলতার বেডের পাশে বসে পড়লেন। ভাবলেন,"আলমারি থেকে অমিয়র হার্ট চেকআপের টাকা অত সহজে বেড়োনোর পিছনে এমন সিরিয়াস কোনো রহস্য না থাকলেও চলতো।" ভোররাতে সুলতা চোখ মেলতেই অমিয় বললে,"সুলতা, সেদিন যে আগুন জ্বালিয়েছিলে, দেখো উস্কে উস্কে আজ কি রকম লাভা। সুলতা, এই যে তোমার সামনে আমি, আমি নই, এ সব তোমারি আভা।"  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন