কমলার দেশ-দর্শন
রৌদ্রাস্য চক্রবর্তী
ঘনান্ধকার স্থানটি নির্ঝঞ্ঝাট-তুল্য এবং নিরিবিলি দেখিয়া কমলাকান্ত আফিঙ্গ সেবনাবস্থায় প্রসন্ন প্রদত্ত মঙ্গলার দুগ্ধ-পূর্ণ পাত্রটি রাখিয়া উপবেশন পূর্বক কিঞ্চিৎ ঝিমাইতেছিলেন, বলিতে হইলে নির্জনে বিশ্রাম করিবার উপক্রম করিতেছিলেন। কিন্তু আফিঙ্গর নেশাবস্থাতেও তিনি যেন সুস্পষ্ট দেখিতে পাইলেন যে কোনো একটি সজীব বস্তুর স্পর্শে দুগ্ধপাত্র আন্দোলিত হইলো। ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া তিনি দক্ষিণ হস্ত দ্বারা উক্ত সজীব বস্তুটিকে চাপিয়া ধরিতে ধরিতেই বলিলেন, ‘ওহে মার্জারী, তুমি পুনরায় আসিয়াছ? সেদিন আমার ভাগের সম্পূর্ণ দুগ্ধটুকুই নিঃশেষ করিয়াছিলে। সেদিন সমাজধর্মের নিকট নতিস্বীকার করিয়া একপ্রকার নিরস্ত্র হইয়াছিলাম ঠিকই। তথাপি বারংবার তাহা সওয়া যায়না। পুনরায় অদ্য তোমায় আমি দুগ্ধ ছাড়িব না। কিছুতেই না।’
কিন্তু এমন সময় আফিঙ্গর নেশা অতিক্রম করিয়াও তাঁহার কর্ণে এক কামিনীর ক্রন্দন-স্বর প্রবেশ করিল যেন। তাহার উৎসাভিমুখে দৃষ্টিপাত করিয়া তিনি দেখিলেন এক সধবার চিহ্নযুক্ত রমণী আলুলাইত কেশে আনত-বদনে বসিয়া রোদন করিতেছে। পরনে একটি রক্তিম-পাড়যুক্ত শুভ্র বস্ত্র বিশেষ, কিন্তু তাহা মলীনতার স্পর্শযুক্ত। দুগ্ধ-পাত্র উপরিস্থিত তাহারই দক্ষিণ হস্তটি কমলাকান্ত স্বহস্তে চাপিয়া ধরিয়া আছেন। বোধকরি চুরির দায়ে ধরা পড়িয়া সলজ্জ হইয়া ক্রন্দনে রত হইয়াছে। যথারীতি কমলাকান্ত রোদনের কারণ জিজ্ঞাসিলে সে রমণী উত্তর প্রদানে বিরতই থাকে। তথাপি কমলা পরোপকারজনিত মোহাবেশেও তাহাকে দুগ্ধপাত্রের প্রতি অধিকার অর্জন হইতে বিরত রাখিলেন। বেশ কয়েকবার ক্রন্দনের কারণ জানিতে চাহিয়াও উত্তর না পাইয়া কমলাকান্ত একাকিত্বকেই রমণীর দুঃখের কারণ জ্ঞান করিয়া আপন মনেই বলিতে থাকিলেন
- কেহ একা থাকিও না। যদি অন্য কেহ তোমার প্রণয়ভাগী না হইল, তবে তোমার মনুষ্যজন্ম বৃথা।… পুষ্প আপনার জন্য ফুটে না। পরের জন্য তোমার হৃদয়-কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও।…ওহে কামিনী-পুষ্প তুমি পরের জন্য তোমার হৃদয়-কুসুমকে প্রস্ফুটিত করনা কেন?
এইবারে রমণী ক্রন্দন সম্বরণপূর্বক বলিলেন, ‘পরের জন্য ভাবিতে ভাবিতেই তো আমি যে নিঃস্ব হইলাম ঠাকুর! আমার জন্য কে ভাবে! জন্ম-লগ্ন হইতেই যে আমায় মন্দার-পর্বত করিয়া গোষ্ঠীর পর গোষ্ঠী, শক্তির পর শক্তি নিজেদের ভাবনাই, আত্ম-স্বার্থ পূরণ করিয়া চলিতেছে। কিন্তু আমি-’ বক্তব্য অসমাপ্ত রাখিয়াই সে ক্লান্তি জুড়াইয়া লইলেন কিয়ৎক্ষণ।
এমন সময় কমলাকান্ত নেশার ঘোরে যেন দেখিতে পাইলেন তাঁহার তিন দিক হইতে যথাক্রমে গেরুয়া, সাদা ও সবুজ বস্ত্র পরিহিত তিন মনুষ্য-গোষ্ঠী আসিতেছে। সকলের মুখে সেই কত বৎসর পূর্বে শ্রীযুক্ত বাবু বঙ্কিমচন্দ্র নামক জনৈক ব্যক্তি রচিত একটি অতীব জনপ্রিয় শ্লোক- ‘বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম’।
এবার কমলাকান্ত রমণীর সমস্যা সমাধান করিয়া তাহার ক্রন্দন জনিত উপদ্রব কাটাইতে তৎপর হইয়া বলিলেন, ‘নাও হে, তোমায় দেখিবার নিমিত্ত ত্যাগী, শান্তিকামী ও বীর সন্তান আসিয়াছে। এবার তুমি ক্রন্দনে বিরতি দিয়া আমার বিশ্রামে যথাসাধ্য সাহায্য করো হে বামা।’ বলিয়া কমলাকান্ত রমণীর প্রতি বিদায়-জ্ঞাপন জনিত করজোর করিলেন।
তথাপি রমণী গেরুয়া বসনের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘উহারা? উহারা আমায় মাধ্যম করিয়া নিজেরাই ক্ষমতার স্বার্থ পূরণ করিতে তৎপর যে। উহারা আমায় কি সঙ্গ দিবে!’ সবুজের দিকে নির্দেশ পূর্বক কহিলেন, ‘ইহারা ও অনুরূপ। আমায় সাক্ষী রাখিয়া নিজেরা যথেচ্ছাচার করে চলে! আর শুভ্র বেশধারী? ইহারা এতটাই শান্তিপ্রিয় যে, কাহারো কিছুতেই কোনো চিন্তা নাই। ইহারা নিজেরা উদরপূর্তি-পূর্বক গ্রাসাচ্ছাদনেই মগ্ন। নিজেদের জন্মদাত্রীর প্রতিও ইহাদের দৃষ্টি-করিবার সময় বোধ করি নাই। ইহার সকলেই যে একা। কেবলমাত্র কিছু লভ্যাংশের স্বার্থে পরস্পর প্রকাশ্যে মিত্রতা বজায় রেখে চলে। দেখিতেছ না ঠাকুর, আজ প্রভাত হইতে আমায় লইয়া কত হাঁক-ডাক, কত ভক্তি, কত উচ্চ-বক্তৃতা, সংগীত, নৃত্য হইবার পরেও আঁধার ঘনাইয়া আসার সঙ্গে সঙ্গেই এখানেই আমায় ফেলিয়া রাখিয়া উহারা ভোঁ-ভাঁ! কল্য হইতে আমার কথা ভাবিতে ইহাদের সময় কই?’
এবার কমলাকান্ত কামিনীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ যুক্ত দৃষ্টি প্রেরণ করিয়া জিজ্ঞাসিলেন, ‘তোমার প্রকৃত পরিচয় কি কামিনী?’
-আমি? আমি ভারতী।
রমণীর পরিচয় জানিয়া ইস্তক কমলাকান্ত নেশার ঝিমুনিতে বুঁদ হয়ে আফিঙ্গের কৃপা উপভোগ করিতে লাগিলেন। কিছুকাল এইরূপে অতিবাহিত হইবার পরে স্বপার্শ ও পশ্চাৎআদি চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন কিছু ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ধ্বজা বিশেষ ছিন্নবস্থায় ভূলুণ্ঠিত, তাঁহার পার্শেই একটি উল্লম্ব দণ্ডাগ্রে বৃহদাকার অনুরূপ একটি ধ্বজা বিশেষ এবং কিঞ্চিৎ দূরত্বে কোন এক প্রতিকৃতি অযত্নে পড়িয়া আছে। প্রতিকৃতিটির প্রতি প্রবলভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বার কয়েক ‘ভারতী’ শব্দটি মৃদু স্বরে আবৃত্তি করিতে করিতেই কি জানি কি মনে করিয়া কমলাকান্ত রমণীর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হইলেন।
সম্মুখে স্বয়ং দেশমাতৃকা-দর্শনের সৌভাগ্য বিষয়ে কমলাকান্ত বিশেষ আবেগবিহ্বল। ক্ষণকালের মধ্যে করজোড়ে ‘সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে, শিবে, আমার সর্বার্থসাধিকে! অসংখ্যসন্তানকুলপালিকে! ধর্ম, অর্থ, সুখ, দুঃখদায়িকে! আমার পুষ্পাঞ্জলি গ্রহণ কর।’ বলিতে বলিতে মাতৃ-চরণে প্রণত হইলেন।
এরপর দেশ-মাতৃকাকে প্রত্যয় প্রদান-পূর্বক বলিলেন, ‘যাঁহার প্রায় একশত আটত্রিশ কোটি সন্তান- তাঁহার ভাবনা কি?’
- ভাবনা নয় বাবা। ভাবনা নয়। ক্ষুধা। এই একশত আটত্রিশ কোটিই বৎসরে প্রায় বার তিনেক এমনি করিয়া কতনা পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে, টানা-হ্যাঁচড়া করে, কতনা উচ্চাদর্শের বাণী আওড়ায়! কিন্তু আত্ম-স্বার্থ মিটিলেই সমাপ্তি। আমায় যে কেউই খাইতে দেয় না, আমার হিতার্থে কাহারো বিন্দুমাত্র ভাবনা নাই! আমার প্রতি ভাবনার মুখোশে ইহারা আপনাদের ভাবনাই পূর্ণ করে। তাই এই ক্ষুধার্ত-দুঃখী মা ভাবিয়াছিল তাঁর এক সন্তানের সম্মুখে রক্ষিত এই দুগ্ধটুকু দিয়া যদি সাময়িক ক্ষুধা টুকুও নিবৃত্তি করিয়া সন্তানকে পরোপকারের পুণ্যার্জনের সুযোগ করিয়া দিই! কিন্তু বাবা, এই সন্তানটিও ব্যতিক্রম নয় দেখিলাম-’ মা কে আর বাক্যব্যায় করিবার সুযোগ না দিয়া কমলাকান্ত অবশ্য কর্তব্য বোধে
- লও মা। গ্রহণ করো। সবল হও।
বলিয়া দুগ্ধ-পাত্র দেশমাতৃকার হস্তে অর্পণ করিয়া আফিঙ্গের নেশায় কিঞ্চিৎ ঝিমাইয়া পরিলেন। পুনরায় মুখ তুলিয়া তিনি দেখিলেন কোথায় দেশ-মা! এ যে এক অস্থি-সার বিশিষ্ট অভুক্ত ও অপুষ্ট শিশু তাহার দুগ্ধ-পাত্র হস্তে দুগ্ধপান করিতেছে।
সমাপ্ত
(বঙ্কিমচন্দ্র সৃষ্ট ‘কমলাকান্ত’ চরিত্রাবলম্বনে)
২৮/৪/১৪২৭