গল্প
মনের ওপারে
____________
অনিকেতের আজ জন্মদিন। সকাল থেকেই ঘরে উৎসবের মেজাজ। মন্দিরে পুজো দিয়ে এসেই মা পায়েস বসিয়ে দিয়েছেন। বৌ সুচরিতা তো ওর পছন্দের রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আর ওর সাত বছরের মেয়ে তুতান বাবাইয়ের জন্য নিজের হাতে বার্থডে কার্ড বানাচ্ছে। এবছর ওর আটত্রিশ বছরের জন্মদিন। বাবা বেঁচে থাকতে এই দিনটাই ওর বাবা-মা ওকে একটু ছোট্ট করে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। ওর পছন্দের খাবার আর উপহার কিনে দিতেন। তারপর বাবার চলে যাওয়া, ওর চাকরি, বিয়ে... কেটে গেছে অনেক গুলো বছর।
বাবার মৃত্যুর পর থেকে তাই এইদিনটা ও ঘরেই থাকে। সবার সাথে একসঙ্গে সময় কাটায়।
সুচরিতা খুব ভালো মেয়ে। স্বামী, শাশুড়ি, মেয়ে, সংসারের খুটিনাটি নিয়েই দিব্যি হেসে খেলে থাকে। সবাইকে খুব যত্নে রাখে। আজও ভোর থেকে উঠে অনিকেতের প্রিয় রান্না নিয়ে মেতেছে। খুব ভালোবাসে ওরা দুজন দুজনকেই।
অনিকেতের নিজেকে খুব সুখী মনে হয়। ঈশ্বরকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয় এতো ভালো একটি পরিবারের জন্য। কিন্তু তবুও আজ ওর মনের কোণে কোথাও যেন বিষন্নতার মেঘ জমে আছে।
সকালে ব্রেকফাস্ট করেই নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তায় ভরে গেছে। একে একে সব্বাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে হঠাৎই মনটা খুব বেশি খারাপ হয়ে গেল।
আজ খুব মনে পড়ছে মেঘনার কথা। বছর তিনেক আগে ফেসবুকে অনেক গুলো মিউচুয়াল ফ্রেণ্ড দেখেই রিকোয়েস্ট সেণ্ড করেছিল অনিকেত। কয়েকদিন পর রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্টেড হলেও বেশ কিছুদিন কেউই কারোর সাথেই কোনোভাবে যোগাযোগ করে নি। অনিকেতই প্রথম মেসেজ করে মেঘনাকে। কিছুদিনের টুকটাক কথাবার্তার পর দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেঘনা খুব সাধাসিধে, বছর তেত্রিশের গৃহবধূ। স্বামী, মেয়েকে নিয়ে ওর সংসার। অনিকেত আর মেঘনা সমবয়সী। ওদের দুজনেরই সাংসারিক কথা থেকে শুরু করে পৃথিবীর সমস্ত বিষয়েই আলোচনা হত। ওরা আলাদা আলাদা শহরের বাসিন্দা। তবুও কি করে যে ওরা ভার্চুয়ালি খুব ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে, সেই প্রশ্নের উত্তর ওরাও দিতে পারবে না।
ওরা হোয়াটসঅ্যাপেও কথা বলে। নিয়মিত কথা বলাটা ওদের অভ্যাসের মধ্যে পড়ে এখন। তবে সেই অভ্যাসটা কখনোই বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করে নি।
এভাবেই বছর দুই কাটার পর, বছর খানেক আগে অনিকেতের একদিন হঠাৎই মনে হল, ওরা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠছে। নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত মেঘনাকে কথাটা ও বলেই ফেলল।
মেঘনা খুব অবাক হয়ে বলেছিল------"একজন বিবাহিত পুরুষ, আর বিবাহিতা মহিলা কি একে অপরের বন্ধু হতে পারে না? আমি তো আমার কলেজের বন্ধুদের সাথেও কথা বলি, খোঁজ খবর নিই, কই আমার তো এতে খারাপ কিছু মনে হয় না। হ্যাঁ আমি অস্বীকার করছি না, তোমার সাথে একদিন কথা না হলে আমার কেমন খারাপ লাগে। তার মানেই তো এই না, আমাদের সম্পর্কটা খারাপ বা আমরা আমাদের পরিবারের প্রতি অবহেলা করছি। সবার জন্য সব কর্তব্য পালন করে, আমরা সারাদিনে একটু কথা বলে যদি মনে শান্তি পাই, এতে অন্যায়টা কোথায়? এটাকে কি তুমি পরকীয়া বলবে?"
অনেকক্ষণ পর অনিকেত রিপ্লাই করেছিল------"বি প্রাকটিক্যাল মেঘনা। কি হবে এই ভার্চুয়াল সম্পর্কটা রেখে। আমার মনে হয় এটা থেকে বেরিয়ে গেলেই সবার ভালো হবে। আমি আমার ফ্যামিলি নিয়ে আর তুমিও তোমার ফ্যামিলি নিয়ে খুব ভালো থাকবে দেখো।"
মেঘনা বলেছিল------"জানি অনিকেত সবাই ভালো থাকবে। কিন্তু দেখো, সবাইকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজেদের ভালো থাকা হবে না।
এটাও জানি, আমাদের মধ্যে কোনো চাওয়া-পাওয়া, লাভ-ক্ষতি নেই। এমনকি আমাদের খারাপ সময়েও শুধুমাত্র মেসেজে খোঁজটুকু নেওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তবুও কি মনে হয় না... We are essential for each other without any reason?"
বিরক্ত হয়ে অনিকেত বলেছিল------ "তোমার মতো কল্পনায় ডুবে থাকলে তো চলবে না আমার। তোমার ওই জ্ঞানের কথাও আর শুনতে ভালো লাগে না।"
এরপর ছাড়া ছাড়া ভাবে কেটেছিল আরও কিছুদিন। মেঘনা উপলব্ধি করে অনিকেত এখন এড়িয়ে চলে ওকে। তাই একদিন নিজে থেকেই বলল, তুমি যখন বলছ, সম্পর্কটা না রাখাই ভালো, তাই হোক তবে। আজ থেকে দুজনেই দুজনকে সব জায়গা থেকে ব্লক করো। চাইলেও যেন আর না ফিরতে পারি কেউ।"
আর কথা বাড়ায় নি অনিকেত। সঙ্গে সঙ্গে ব্লক করেছিল সব জায়গা থেকে। মনে হয়েছিল বুক থেকে একটা পাথর সরে গেল। নিজেকে বেশি বেশি করে ডুবিয়ে দিয়েছিল কাজ আর পরিবারের মধ্যে। তবুও কোন কোন সময় মনটা যে মোচড় দিত না তা নয়।
আজও সকাল থেকে বারবারই মনে হয়েছে মেঘনার কথা। গতবারও ওর জন্মদিনে কম ছেলেমানুষি করে নি মেয়েটা। সকালে ফোন সুইচড অন করতেই টুং টুং করে একসাথে মেইল, এস এম এস, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ সব জায়গা থেকে মেঘনার কাছ থেকে আসা বার্থডে উইশের নোটিশ। এই ছেলেমানুষি দেখে অজান্তেই ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি ফুটেছিল অনিকেতের। আজ কথাটা মনে করে অজান্তেই চোখ ভিজে গেল ওর।
মনে পড়ল মেঘনার কথাগুলো-----"সবাইকে ভালো রাখতে গিয়ে, নিজেদের ভালো থাকা হবে না।"
" We are essential for each other without any reason."
বুকে কেমন যেন চাপ লাগলো ওর। ভাবল----"সত্যিই যদি ওকে সারাজীবন আমার কাছেই রাখতাম হয়তো সবার সঙ্গে আমরাও ভালো থাকতাম!"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আবারো উঠে পড়ে, নিজেকে মিশিয়ে দিল সংসার সমুদ্রে।
__________________
পাপিয়া মণ্ডল
মনের ওপারে
____________
অনিকেতের আজ জন্মদিন। সকাল থেকেই ঘরে উৎসবের মেজাজ। মন্দিরে পুজো দিয়ে এসেই মা পায়েস বসিয়ে দিয়েছেন। বৌ সুচরিতা তো ওর পছন্দের রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আর ওর সাত বছরের মেয়ে তুতান বাবাইয়ের জন্য নিজের হাতে বার্থডে কার্ড বানাচ্ছে। এবছর ওর আটত্রিশ বছরের জন্মদিন। বাবা বেঁচে থাকতে এই দিনটাই ওর বাবা-মা ওকে একটু ছোট্ট করে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। ওর পছন্দের খাবার আর উপহার কিনে দিতেন। তারপর বাবার চলে যাওয়া, ওর চাকরি, বিয়ে... কেটে গেছে অনেক গুলো বছর।
বাবার মৃত্যুর পর থেকে তাই এইদিনটা ও ঘরেই থাকে। সবার সাথে একসঙ্গে সময় কাটায়।
সুচরিতা খুব ভালো মেয়ে। স্বামী, শাশুড়ি, মেয়ে, সংসারের খুটিনাটি নিয়েই দিব্যি হেসে খেলে থাকে। সবাইকে খুব যত্নে রাখে। আজও ভোর থেকে উঠে অনিকেতের প্রিয় রান্না নিয়ে মেতেছে। খুব ভালোবাসে ওরা দুজন দুজনকেই।
অনিকেতের নিজেকে খুব সুখী মনে হয়। ঈশ্বরকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয় এতো ভালো একটি পরিবারের জন্য। কিন্তু তবুও আজ ওর মনের কোণে কোথাও যেন বিষন্নতার মেঘ জমে আছে।
সকালে ব্রেকফাস্ট করেই নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তায় ভরে গেছে। একে একে সব্বাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে হঠাৎই মনটা খুব বেশি খারাপ হয়ে গেল।
আজ খুব মনে পড়ছে মেঘনার কথা। বছর তিনেক আগে ফেসবুকে অনেক গুলো মিউচুয়াল ফ্রেণ্ড দেখেই রিকোয়েস্ট সেণ্ড করেছিল অনিকেত। কয়েকদিন পর রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্টেড হলেও বেশ কিছুদিন কেউই কারোর সাথেই কোনোভাবে যোগাযোগ করে নি। অনিকেতই প্রথম মেসেজ করে মেঘনাকে। কিছুদিনের টুকটাক কথাবার্তার পর দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেঘনা খুব সাধাসিধে, বছর তেত্রিশের গৃহবধূ। স্বামী, মেয়েকে নিয়ে ওর সংসার। অনিকেত আর মেঘনা সমবয়সী। ওদের দুজনেরই সাংসারিক কথা থেকে শুরু করে পৃথিবীর সমস্ত বিষয়েই আলোচনা হত। ওরা আলাদা আলাদা শহরের বাসিন্দা। তবুও কি করে যে ওরা ভার্চুয়ালি খুব ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে, সেই প্রশ্নের উত্তর ওরাও দিতে পারবে না।
ওরা হোয়াটসঅ্যাপেও কথা বলে। নিয়মিত কথা বলাটা ওদের অভ্যাসের মধ্যে পড়ে এখন। তবে সেই অভ্যাসটা কখনোই বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করে নি।
এভাবেই বছর দুই কাটার পর, বছর খানেক আগে অনিকেতের একদিন হঠাৎই মনে হল, ওরা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠছে। নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত মেঘনাকে কথাটা ও বলেই ফেলল।
মেঘনা খুব অবাক হয়ে বলেছিল------"একজন বিবাহিত পুরুষ, আর বিবাহিতা মহিলা কি একে অপরের বন্ধু হতে পারে না? আমি তো আমার কলেজের বন্ধুদের সাথেও কথা বলি, খোঁজ খবর নিই, কই আমার তো এতে খারাপ কিছু মনে হয় না। হ্যাঁ আমি অস্বীকার করছি না, তোমার সাথে একদিন কথা না হলে আমার কেমন খারাপ লাগে। তার মানেই তো এই না, আমাদের সম্পর্কটা খারাপ বা আমরা আমাদের পরিবারের প্রতি অবহেলা করছি। সবার জন্য সব কর্তব্য পালন করে, আমরা সারাদিনে একটু কথা বলে যদি মনে শান্তি পাই, এতে অন্যায়টা কোথায়? এটাকে কি তুমি পরকীয়া বলবে?"
অনেকক্ষণ পর অনিকেত রিপ্লাই করেছিল------"বি প্রাকটিক্যাল মেঘনা। কি হবে এই ভার্চুয়াল সম্পর্কটা রেখে। আমার মনে হয় এটা থেকে বেরিয়ে গেলেই সবার ভালো হবে। আমি আমার ফ্যামিলি নিয়ে আর তুমিও তোমার ফ্যামিলি নিয়ে খুব ভালো থাকবে দেখো।"
মেঘনা বলেছিল------"জানি অনিকেত সবাই ভালো থাকবে। কিন্তু দেখো, সবাইকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজেদের ভালো থাকা হবে না।
এটাও জানি, আমাদের মধ্যে কোনো চাওয়া-পাওয়া, লাভ-ক্ষতি নেই। এমনকি আমাদের খারাপ সময়েও শুধুমাত্র মেসেজে খোঁজটুকু নেওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তবুও কি মনে হয় না... We are essential for each other without any reason?"
বিরক্ত হয়ে অনিকেত বলেছিল------ "তোমার মতো কল্পনায় ডুবে থাকলে তো চলবে না আমার। তোমার ওই জ্ঞানের কথাও আর শুনতে ভালো লাগে না।"
এরপর ছাড়া ছাড়া ভাবে কেটেছিল আরও কিছুদিন। মেঘনা উপলব্ধি করে অনিকেত এখন এড়িয়ে চলে ওকে। তাই একদিন নিজে থেকেই বলল, তুমি যখন বলছ, সম্পর্কটা না রাখাই ভালো, তাই হোক তবে। আজ থেকে দুজনেই দুজনকে সব জায়গা থেকে ব্লক করো। চাইলেও যেন আর না ফিরতে পারি কেউ।"
আর কথা বাড়ায় নি অনিকেত। সঙ্গে সঙ্গে ব্লক করেছিল সব জায়গা থেকে। মনে হয়েছিল বুক থেকে একটা পাথর সরে গেল। নিজেকে বেশি বেশি করে ডুবিয়ে দিয়েছিল কাজ আর পরিবারের মধ্যে। তবুও কোন কোন সময় মনটা যে মোচড় দিত না তা নয়।
আজও সকাল থেকে বারবারই মনে হয়েছে মেঘনার কথা। গতবারও ওর জন্মদিনে কম ছেলেমানুষি করে নি মেয়েটা। সকালে ফোন সুইচড অন করতেই টুং টুং করে একসাথে মেইল, এস এম এস, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ সব জায়গা থেকে মেঘনার কাছ থেকে আসা বার্থডে উইশের নোটিশ। এই ছেলেমানুষি দেখে অজান্তেই ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি ফুটেছিল অনিকেতের। আজ কথাটা মনে করে অজান্তেই চোখ ভিজে গেল ওর।
মনে পড়ল মেঘনার কথাগুলো-----"সবাইকে ভালো রাখতে গিয়ে, নিজেদের ভালো থাকা হবে না।"
" We are essential for each other without any reason."
বুকে কেমন যেন চাপ লাগলো ওর। ভাবল----"সত্যিই যদি ওকে সারাজীবন আমার কাছেই রাখতাম হয়তো সবার সঙ্গে আমরাও ভালো থাকতাম!"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আবারো উঠে পড়ে, নিজেকে মিশিয়ে দিল সংসার সমুদ্রে।
__________________
পাপিয়া মণ্ডল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন