5.সমকামিতা কী একটি নিষিদ্ধ শব্দ?
-----(সায়ন্তনী বক্সী)
আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষই 'সমকামী ' বা 'সমকামিতা' শব্দটি শুনলে ঠিক যেন ভূত দেখার মতোই চমকে ওঠেন! যেন একটি নিষিদ্ধ শব্দ বা অভিধান বহির্ভূত শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। বলতে কোনো দ্বিধা নেই, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরাও সমকামীদের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষন করেন। সমকামিতা তাঁদের কাছে যেন অশ্লীলতম ঘটনা;আর সমকামী সম্পর্কে লিপ্ত নারী-পুরুষ ভিনগ্রহের কুৎসিত দর্শন জীব! সত্যি কথা বলতে কী আধুনিক যুগের মানুষ হয়েও মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণা পোষণ করে চলেছি আমরা।
হ্যাঁ আমরাই; কারণ যুবসম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে বলতে পারি আমার প্রজন্মের অনেক ছেলে-মেয়েরাই সমকামিতার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বা শব্দটির অর্থ সম্বন্ধে সঠিকভাবে অবগত নয়। বরং অনেক young starকে বলতে শুনি ইস্ কী অসভ্য! কী নোংরা সব! সুতরাং পুঁথিগত বিদ্যা যে মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটায় না সেতো বোঝাই যায় এই সমস্ত মন্তব্য থেকে। তবে সমকামের স্বরূপ জানার বা বোঝার পূর্বে 'লিঙ্গ' সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণার প্রয়োজন আছে বলে অন্তত আমি মনে করি। লিঙ্গ শব্দের আক্ষরিক অর্থ বাহ্যিকভাবে যতটা সহজ বলে মনে করা হয়, সত্যিকার ততটা সহজ না। লিঙ্গ শুধুমাত্র দেহগতই নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক আবার মনোগতও বটে। আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মানুষই ভাবেন যেকোন সুস্থ মানুষই শরীর ও মন উভয় দিক থেকেই হয় পুরুষ অথবা নারী। এর ব্যতিক্রম যদি কিছু হয় অর্থাৎ একজন পুরুষ যদি পুরুষের প্রতি এবং একজন নারী যদি একজন নারীর প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে তবে তারা মানবসমাজে হয়ে যায় নির্বাসিত।
লিখতে লিখতে বারবার নিজের কিশোরীবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী --- বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদেরই সহপাঠী দুজন ছাত্রীর মধ্যে সমকামী সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে এলো; সমস্ত স্কুলের মধ্যে রীতিমত ছি ছি রব উঠল। সত্যি কথা বলতে কী, আমি নিজেও সেই ছি ছির সাথে গলা মিলিয়ে ছি ছি করে উঠে ছিলাম। কারণ আমার নিজেরও তখন সমকামিতা বিষয়ে বিতৃষ্ণার মনোভাব ছিল। সে যাই হোক, ঘটনাটির উল্লেখের পিছনে আমার একটাই উদ্দেশ্য আর সেটা হল এই যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাভাবনার পরিবর্তন একান্তভাবেই প্রয়োজন। আমার চিন্তাজগতকে সব দৈনতা থেকে মুক্ত হতে না পারলে এই প্রবন্ধ লেখায় হাত দিতাম না। সেই কিশোরী বয়সের চিন্তাভাবনার সাথে এই যৌবনের ভাবনাচিন্তার বিস্তর ফারাক। তা বলে সমস্ত মানুষের মননে এই পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক তো হয়ে যান, কিন্তু প্রাপ্তমনস্ক হন না। পুরুষশাসিত সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার taboo গুলোকে কিছুতেই দূরে ছুড়ে দিতে পারেন না সবলে!
প্রকৃতির বিচিত্র এই সৃষ্টির খেলায় শুধু যদি পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গের অস্তিত্বই থাকত, তাহলে উভলিঙ্গের কোনো অস্তিত্বই থাকত না। উভলিঙ্গ অর্থাৎ যে শরীরে পুং ও স্ত্রী লিঙ্গের সহাবস্থান থাকে। এখন রহস্যময়ী প্রকৃতিতে ঘটা এই ঘটনাকে কি আখ্যা দেবেন রক্ষণশীল সুধীজনেরা? অশ্লীল না কুৎসিত? জগতে কামের বিভিন্ন প্রকারভেদ দেখতে পাওয়া যায়: সমকাম, বিষমকাম, উভকাম, রূপান্তরকাম, বহুকাম, সর্বকাম, নিষ্কাম। এদের কোনোটিই অপ্রাকৃতিক নয় এবং অন্যান্য কামের মতো সমকাম সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য। সমকামকে ব্যতিক্রম বলা চলে যেহেতু কম সংখ্যায় ঘটে। কিন্তু কোনোমতেই অস্বাভাবিক, কুৎসিত প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষিত করা উচিত না। প্রকৃতির অজস্র প্রজাতির মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে ভিন্নতর যৌনপ্রবৃত্তি। ভেড়া, শিম্পাজি, সিংহ, জিরাফ,হাতি, ডলফিন, পেঙ্গুইন, হাঁস ইত্যাদি প্রাণীরা বিভিন্ন সময়ে সমকামে লিপ্ত হয় বলে সমীক্ষায় জানা গেছে। মানুষের নিকটতম আত্মীয় 'Bonobo' যাদের DNA এর ৯৮% শতাংশ সাদৃশ্য রয়েছে; এরা কিন্তু প্রচন্ডরকম উভকামী বলে জানা গেছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, প্রকৃতি শুধু প্রজননের দ্বারা বংশবৃদ্ধির মন্ত্রের উপাসক না, আরও অনেক হিসেবই চলে তার দুনিয়ায়। বিবর্তনের তত্ত্ব দিয়ে বিচার করলে দেখতে পাওয়া যাবে সমকামীরা মোটেই মানব সমাজের অপ্রয়োজনীয় অংশ নয়।
সমাজে আত্মসম্মান নিয়ে মানুষের মতো বাঁচার অধিকার সব লিঙ্গের মতো সমকামীদেরও সমানভাবে থাকা উচিত। এ ব্যাপারে যারা অবিশ্বাসী, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। যারা নারী-পুরুষের কাম ব্যতীত অন্য সব কামকে প্রকৃতি বিরুদ্ধ বলে স্বঘোষিত ফতোয়া জারী করছে, সমকামীদের উপর নির্যাতন করছে তাদের জনমত নির্বিশেষে শিক্ষিত ও সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি বিষয়।
ভারতবর্ষ স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ। অপগন্ড মূর্খেরা সংখ্যায় বেশি বলেই তাদের মূর্খামি নির্বিচারে মেনে নিতে হবে কথা আমাদের গণতন্ত্রও বলে না, সংবিধানও স্বীকার করে না।সমকামীদের নিজেদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন চলছে চতুর্দিকে। ওঁরা চাইছেন নিজের লিঙ্গ নিজে নির্ণয় ও সেই নির্ণয়কে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে। নিগৃহীত না হওয়া, মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত না হওয়া, বিবাহ, যৌন সঙ্গম, সন্তান দত্তক গ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়ে নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছেন। যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এই একুশ শতকেও নারীকে নারী হয়ে জন্মানোর জন্য প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হতে হয় সেখানে সমকামীদের নিজেদের মৌলিক অধিকারের জন্য যে আরও সুদীর্ঘকাল যাবৎ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে একথা সহজেই অনুমেয়।
-----(সায়ন্তনী বক্সী)
আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষই 'সমকামী ' বা 'সমকামিতা' শব্দটি শুনলে ঠিক যেন ভূত দেখার মতোই চমকে ওঠেন! যেন একটি নিষিদ্ধ শব্দ বা অভিধান বহির্ভূত শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। বলতে কোনো দ্বিধা নেই, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরাও সমকামীদের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষন করেন। সমকামিতা তাঁদের কাছে যেন অশ্লীলতম ঘটনা;আর সমকামী সম্পর্কে লিপ্ত নারী-পুরুষ ভিনগ্রহের কুৎসিত দর্শন জীব! সত্যি কথা বলতে কী আধুনিক যুগের মানুষ হয়েও মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণা পোষণ করে চলেছি আমরা।
হ্যাঁ আমরাই; কারণ যুবসম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে বলতে পারি আমার প্রজন্মের অনেক ছেলে-মেয়েরাই সমকামিতার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বা শব্দটির অর্থ সম্বন্ধে সঠিকভাবে অবগত নয়। বরং অনেক young starকে বলতে শুনি ইস্ কী অসভ্য! কী নোংরা সব! সুতরাং পুঁথিগত বিদ্যা যে মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটায় না সেতো বোঝাই যায় এই সমস্ত মন্তব্য থেকে। তবে সমকামের স্বরূপ জানার বা বোঝার পূর্বে 'লিঙ্গ' সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণার প্রয়োজন আছে বলে অন্তত আমি মনে করি। লিঙ্গ শব্দের আক্ষরিক অর্থ বাহ্যিকভাবে যতটা সহজ বলে মনে করা হয়, সত্যিকার ততটা সহজ না। লিঙ্গ শুধুমাত্র দেহগতই নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক আবার মনোগতও বটে। আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মানুষই ভাবেন যেকোন সুস্থ মানুষই শরীর ও মন উভয় দিক থেকেই হয় পুরুষ অথবা নারী। এর ব্যতিক্রম যদি কিছু হয় অর্থাৎ একজন পুরুষ যদি পুরুষের প্রতি এবং একজন নারী যদি একজন নারীর প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে তবে তারা মানবসমাজে হয়ে যায় নির্বাসিত।
লিখতে লিখতে বারবার নিজের কিশোরীবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী --- বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদেরই সহপাঠী দুজন ছাত্রীর মধ্যে সমকামী সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে এলো; সমস্ত স্কুলের মধ্যে রীতিমত ছি ছি রব উঠল। সত্যি কথা বলতে কী, আমি নিজেও সেই ছি ছির সাথে গলা মিলিয়ে ছি ছি করে উঠে ছিলাম। কারণ আমার নিজেরও তখন সমকামিতা বিষয়ে বিতৃষ্ণার মনোভাব ছিল। সে যাই হোক, ঘটনাটির উল্লেখের পিছনে আমার একটাই উদ্দেশ্য আর সেটা হল এই যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাভাবনার পরিবর্তন একান্তভাবেই প্রয়োজন। আমার চিন্তাজগতকে সব দৈনতা থেকে মুক্ত হতে না পারলে এই প্রবন্ধ লেখায় হাত দিতাম না। সেই কিশোরী বয়সের চিন্তাভাবনার সাথে এই যৌবনের ভাবনাচিন্তার বিস্তর ফারাক। তা বলে সমস্ত মানুষের মননে এই পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক তো হয়ে যান, কিন্তু প্রাপ্তমনস্ক হন না। পুরুষশাসিত সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার taboo গুলোকে কিছুতেই দূরে ছুড়ে দিতে পারেন না সবলে!
প্রকৃতির বিচিত্র এই সৃষ্টির খেলায় শুধু যদি পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গের অস্তিত্বই থাকত, তাহলে উভলিঙ্গের কোনো অস্তিত্বই থাকত না। উভলিঙ্গ অর্থাৎ যে শরীরে পুং ও স্ত্রী লিঙ্গের সহাবস্থান থাকে। এখন রহস্যময়ী প্রকৃতিতে ঘটা এই ঘটনাকে কি আখ্যা দেবেন রক্ষণশীল সুধীজনেরা? অশ্লীল না কুৎসিত? জগতে কামের বিভিন্ন প্রকারভেদ দেখতে পাওয়া যায়: সমকাম, বিষমকাম, উভকাম, রূপান্তরকাম, বহুকাম, সর্বকাম, নিষ্কাম। এদের কোনোটিই অপ্রাকৃতিক নয় এবং অন্যান্য কামের মতো সমকাম সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য। সমকামকে ব্যতিক্রম বলা চলে যেহেতু কম সংখ্যায় ঘটে। কিন্তু কোনোমতেই অস্বাভাবিক, কুৎসিত প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষিত করা উচিত না। প্রকৃতির অজস্র প্রজাতির মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে ভিন্নতর যৌনপ্রবৃত্তি। ভেড়া, শিম্পাজি, সিংহ, জিরাফ,হাতি, ডলফিন, পেঙ্গুইন, হাঁস ইত্যাদি প্রাণীরা বিভিন্ন সময়ে সমকামে লিপ্ত হয় বলে সমীক্ষায় জানা গেছে। মানুষের নিকটতম আত্মীয় 'Bonobo' যাদের DNA এর ৯৮% শতাংশ সাদৃশ্য রয়েছে; এরা কিন্তু প্রচন্ডরকম উভকামী বলে জানা গেছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, প্রকৃতি শুধু প্রজননের দ্বারা বংশবৃদ্ধির মন্ত্রের উপাসক না, আরও অনেক হিসেবই চলে তার দুনিয়ায়। বিবর্তনের তত্ত্ব দিয়ে বিচার করলে দেখতে পাওয়া যাবে সমকামীরা মোটেই মানব সমাজের অপ্রয়োজনীয় অংশ নয়।
সমাজে আত্মসম্মান নিয়ে মানুষের মতো বাঁচার অধিকার সব লিঙ্গের মতো সমকামীদেরও সমানভাবে থাকা উচিত। এ ব্যাপারে যারা অবিশ্বাসী, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। যারা নারী-পুরুষের কাম ব্যতীত অন্য সব কামকে প্রকৃতি বিরুদ্ধ বলে স্বঘোষিত ফতোয়া জারী করছে, সমকামীদের উপর নির্যাতন করছে তাদের জনমত নির্বিশেষে শিক্ষিত ও সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি বিষয়।
ভারতবর্ষ স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ। অপগন্ড মূর্খেরা সংখ্যায় বেশি বলেই তাদের মূর্খামি নির্বিচারে মেনে নিতে হবে কথা আমাদের গণতন্ত্রও বলে না, সংবিধানও স্বীকার করে না।সমকামীদের নিজেদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন চলছে চতুর্দিকে। ওঁরা চাইছেন নিজের লিঙ্গ নিজে নির্ণয় ও সেই নির্ণয়কে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে। নিগৃহীত না হওয়া, মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত না হওয়া, বিবাহ, যৌন সঙ্গম, সন্তান দত্তক গ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়ে নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছেন। যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এই একুশ শতকেও নারীকে নারী হয়ে জন্মানোর জন্য প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হতে হয় সেখানে সমকামীদের নিজেদের মৌলিক অধিকারের জন্য যে আরও সুদীর্ঘকাল যাবৎ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে একথা সহজেই অনুমেয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন