ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৮

                              দীপশিখা----

----------------------------------------------------------------

দীপের মন ভাল নেই। বাড়ী ঢুকতেই বাবার চীৎকার কানে এল।মায়ের ফোঁপানি, আবার তাকে নিয়ে ঝামেলা। বাবা বলছে--

তোমার ঐ নেকু সখী পনা ছাড়তে বল ছেলেকে। দু চোক্ষের বিষ। তার দুই দিদি, ১ জনের বিয়ে হয়ে স্বামী নিয়ে বিদেশে, আর মেজদি ইউনিভার্সিটি তে রিসার্চ করে। দীপ ও কলেজে পড়ে, এবার ফাইনাল ইয়ার। আসলে তার চেহারাটাই সমস্যার কারন। মাঝারি লম্বা, ফর্সা,মুখ খানা লাবন্যে ঢলঢল একটু মেয়লি গোছের। সে স্বভাবেও মেয়েদের মত নরম। সে ভেবে পায় না এই চেহারার জন্যে তো সে দায়ী নয়। তবু সবাই তাকে নিয়ে হাসি মশকরা করে। বাবা দিদি রোজ মা কে কথা শোনায়। সে মায়ের মত  মুখ পেয়েছে, বড়দি সুশ্রী,আর মেজদি বাবার মত চোয়াড়ে কঠিন দেখতে। বাবার মেজাজ সারাক্ষন সপ্তমে চড়ে থাকে। মা শান্ত শ্রীময়ী। মুখ বুজে সব সহ্য করে। ছোট থেকেই দীপের মেয়েদের মত সাজগোজ করতে ভাল লাগে। মায়ের ড্রেসিং টেবিলে রুজ লিপস্টিক মাখতো, মায়ের শাড়ি পরতো নিজের শার্টের সাথে। পাড়ার ফাংশনে, কলেজের অনুষ্ঠানে সে নারী চরিত্রে অভিনয় করত। পাড়ার বোস কাকু তাকে হাতে ধরে পারফেকশন শিখিয়েছেন। মা আর বোস কাকু ছাড়া আর কারুর স্নেহ জোটেনি তার কপালে। সে লুকিয়ে নাচের স্কুলেও ভর্ওি হয়েছে। মা লুকিয়ে তার খরচ দেন। বাবা জানলে বিশাল ঝড় উঠবে। তার খুব ইচ্ছে একজন ধ্রুপদী নৃত্য শিল্পী হবে। দেশ - বিদেশের মঞ্চে পারফর্ম করবে। যখন পুরোপুরি নিজে দাঁড়িয়ে যাবে তখন মাকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রাখবে।কলেজে তার বান্ধবীর সংখ্যা বেশি। আর ছেলের দল তাকে নিয়ে মজা করে, বিরক্ত করে। শুধু একজন বাদে। সে হল অনিরুদ্ধ।  তাকে দীপ ভীষন ভালবাসে। সে কোনদিন কলেজে না হলে তার বুক খাঁ খাঁ করে। সে যত্ন করে নোটস তুলে রাখে। কারন অনি সায়েন্সের স্টুডেন্ট হলেও ইংরেজী বিষয় টা তাদের এক। তাই সারাদিনে ঐ সময়টাতেই তাদের দেখা হয়। অনি তার সাথে ভাল ব্যবহারই করে, কিন্তু একটু ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করলেই বিরক্ত হয়। তবু দীপের তার প্রতি মোহ যায় না। এদিকে ১ দিন একটা ঘটনা ঘটল। কলেজের কয়েকটা ছেলে তাকে প্রায়ই টানাটানি করত। জোর করে চুমু খাবার চেষ্টা, গায়ে হাত বুলনো এসব। সে হাতজোড় করে নিষ্কৃতি চেযেছে কিন্তু ওরা তাতে কান দেয় নি। একদিন ক্লাস ছুটির পর লাইব্রেরিতে পড়াশুনার জন্যে গিয়েছিল। পড়তে পড়তে কখন কলেজ ফাঁকা হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। করিডরে ঐ ছেলেদের ২ জন তাকে টেনে নিয়ে যায় ছাদে। তারপর শ্লীলতা হানি করে। কোনরকমে ছাড়িয়ে  পালায়। ছেলেগুলো শাসায় কাউকে বললে মেরে ফেলবে। তাও সে সাহস করে প্রিন্সিপালের কাছে কমপ্লেন করেছিল। উনি অবিশ্বাসি চোখে তাকিয়ে শুনলেন। কিন্তু প্রমান দিতে বললেন। কারন তেনার মনে হয়েছিল ছেলেরা আবার ছেলেদের গায়ে হাত দেয় নাকি? তারা তো মেয়েদের নিয়েই ইন্টারেস্ট দেখায়! ঐ ছেলেদের একজন কোন প্রভাবশালী নেতার ছেলে, কলেজের পরিচালন কমিটির হোমরা চোমরা পদে আছেন তাই কিছু করা কঠিন তিনি তাকেই সতর্ক হতে পরামর্শ দিলেন। সে বুঝল তার জন্যে কেউ মুখ খুলবে না।আজকাল অনি ও পাওা দেয় না। সে কলেজের সেরা সুন্দরীর প্রেমে পড়েছে। তার সাথেই সময় কাটায়। এদিকে তার জীবনের যে ধ্রুবতারা ছিল সেই মা মারা গেল হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে। তার আর কেউ রইল না। সে ঠিক করেছে তার যা ভাল লাগে তাই করবে। সে মেয়েদের মত শাড়ী, গয়না পরে রাস্তায় বেরতো।পাড়ার লোক টিটকিরি দিত, হাসত। বাবার কানে বিষ ঢালার লোকের অভাব হল না। বাবা প্রথমে তাকে শাসালেন, তারপর ও সে একই রকম আছে দেখে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিলেন ত্যাজ্য করে। প্রথম দিকে দু একজন বন্ধুদের বাড়ীতে থেকে নাচের স্কুলেই ছোট বাচ্চাদের নাচ শেখাতে লাগল।আত্মীয়রা তো জায়গা দিলই না উল্টে গালাগালি করত। দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে নিত। কোন হস্টেলে তার জায়গা হল না। ছেলেদের মেসে কিছুদিন ছিল কিন্তু ঐ বিরক্ত করত। সেখানেও স্পষ্ট বলে দিল মেয়েলি পোষাক আসাক সে ব্যবহার করতে পারবে না। এরই ভেতর দূর্গাপূজো চলে এল। সবাই সেজে গুজে হৈ চৈ করছে। সেও সুন্দর করে সেজে পাড়ার পূজোয় কাকীমাদের সাথে হাত লাগায়। পাড়ার মেয়েদের সাথে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে হপিং করে। এলো দশমী। এবার দূগ্গা মায়ের যাবার পালা। রাএে মহা সমারোহে আলোক সজ্জায়, ব্যান্ড পার্টির গানে ছেলে মেয়ে বুড়ো সবাই উল্লাসে নাচতে নাচতে শোভা যাএা সহকারে এগিয়ে চলে। দীপ এখন নিজের নাম বলে বেড়ায় দীপশিখা। সেও নাচতে নাচতে সবার সাথে গলা মেলায় ---

" বল দুগ্গা মাইকী। আসছে বছর আবার হবে "। বাবু ঘাটে গিয়ে ঠাকুর নামানোর তোড়জোড় চলে। প্রচুর ক্লাব থেকে প্রতিমা নিরঞ্জনে এসেছে। অনেক ভীড়ে দীপশিখা নিজের পাড়ার লোকদের হারিয়ে ফেলে। এদিকে বেশ কিছুদিন আগে কিছু লোক তাকে পুরুষ সমকামী দের লালসা মেটাতে তাকে টাকার বিনিময়ে অফার দেয় কিন্তু দীপ তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। এখানে তাদেরকে দেখে সে একটু অন্ধকারের লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে। এভাবেই তাদের সাথে আলো অন্ধকারে লুকোচুরি চলতে থাকে। একসময় একটা বজ্র কঠিন হাত তার মুখ চেপে ধরে।তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। সে হাত পা ছোঁড়ে, কিন্তু কোন লাভ হয় না।এর ভেতর তার হাত পা বেঁধে, মুখে প্লাস্টার আটকে দিয়ে নির্যাতন চলতে থাকে। একসময় তার হুঁশ হারায়। যন্ত্রনায় দীর্ণ হয় সে। পরদিন প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে তার লাশ পড়ে থাকে। পুলিশ অপরিচিত বডি মর্গে ঢোকায়। দীপশিখা সকাল বেলার খবর কাগজে টি ভি তে হেড লাইন হয়ে যায়। সমাজের অবহেলা, বাড়ীর নন্ কোঅপারেশন তাকে বাঁচতে দিল না।



গল্প : আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন