১৮. ভূত নয় , ভয়ের মতন
---------পিনাকি
ফোন পেয়েই আমি বুঝেছিলাম , আজ আবার কোন পাগলামি শুরু হবে । একে কলকাতার রাস্তায় কনকনে ঠাণ্ডা বরফের কুচির মতন যেন ঝরে পড়ছে । দু’ বছর আগের শীতপোশাক গুলো , আলমারিতে যত্নে তুলে রেখেছিলাম । এমন ভাবে তাদের সাহায্য নিতে হবে ভাবাই যায়নি ! জীবনে মাঝে – মাঝেই এমন অভিজ্ঞতা -- এসেই যায় ।
এখন রাত দশটা । শনিবার । টুয়া আমাকে ফোন করবে না । আমি সকালেই বলেছি , আজ আর বাড়ি যাব না । ভীষণ দরকারে অন্যত্র যেতে হচ্ছে । সোমবার ফিরব । তখনই অকে ওকে গল্প টা দেব ।
বাড়ি ফাঁকা । মা , দমদমে দাদার কাছে । তাই আজ বাঘাযতীনে নিজের বাড়িতে গেলে , হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হত । বাইরে থেকে কিছু রুটি আর তর্কা কিনতে হত ।
আমি একটা মাসিক ম্যাগাজিনের সাংবাদিক । মাসে একবার প্রকাশিত হয় । একটি বিভাগে প্যারানর্মাল , ভূত – প্রেত , কালাজাদু নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয় । সামনের মাসে আমাকে গল্প দিতে হবে । সময় বেঁধে দিয়েছে ।
টুয়া ম্যাগাজিনের অলৌকিক বিভাগের প্রধান সম্পাদক । আজ আমার বাড়িতে গল্পটা নিতে আসছে । আমি চাপে পড়ে মিথ্যা কথা বলে দিয়েছি । বলেছি , আজ শনিবার আমার বাড়িতে আসবে , টুয়াকে এক কাপ কফি করে খাওয়াব আর গল্পটা ওর পেন – ড্রাইভে ভরে দেব । আসলে একমাস আগের থেকে তাড়া দিয়েছে । আমার অভ্যাস মুখে - মুখে লেখা জমা দেওয়া । এখন দেখছি মুখ অপেক্ষারত , আমাকে গ্রাস করবে ! পালানোটাই সেরা পথ ।
আমি গল্প লিখতে পারিনি , তাই পালিয়ে আজ রাতটুকু রেহাই পেলাম, কাল রবিবার আমি অফিস যাবনা । ছুটি নিয়েছি । আবার সোমবার দেখা যাবে ।
আজ সন্ধ্যা ছ’টায় রণের ফোন পেলাম ! একমাস আগে , আমাকে নরেন্দ্রপুরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল । জানতে চাইল , সময় আছে কি না ? একা বাড়িতে থেকে এম্নিতেই এমনিতেই বাজে চিন্তায় ডুবে থাকবার চেয়ে , বন্ধুর সাথে তার পুরানো বাড়িতে রাত কাটানো বেশ ভালো ।
২
বাঘাযতীন স্টেশনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম । কেউ হাত ধরল । দেখলাম , রণ এসে গিয়েছে ।
-চল , টিকিট কেটেছিস ? নাকি তোরটা কাটব ?
-মান্থলি আছে ।
রণ বলল – আমার অফিসটা এখানেই । তুই দাঁড়িয়ে থাক আমি আসছি , টিকিট কেটে ।
আমি দেখলাম রণের দু’ হাত ভরা পলিথিনের প্যাকেট । নির্ঘাত রাতের খাবার কিনেছে । আমি তর্কা – রুটি কিনতাম । ফোনে রণ বলেই দিয়েছে , রাতে গল্প হবে , খাওয়া- দাওয়া হবে । সব ব্যবস্থা করা হয়েছে । দেখলাম বেশ তেলাক্ত আর লোভনীয় প্যাকেট , দেখেই ক্ষিধে পাচ্ছে । ভিতরে খাবার গুলো আমাদের সাহায্য প্রার্থনা করছে । অভয় দিচ্ছি , এতটুকু অসম্মানিত হবে না , বন্দী খাবারেরা ।
ট্রেন ফাঁকাই ছিল । বগিতে আমাদের নিয়ে , খুব বেশি হলে দশ জন ।
জানালার ধারে বসেছি । সামনে রণ , উল্টোদিকের সীটে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-অনেক দিন পর , কেমন আছিস ?
-ভালো । এই একমাস কোথায় ছিলিস ! আর আজ আচমকা আমাকে ফোন করলি ?
-এই একমাস খুব ঝামেলায় ছিলাম । এখনো আছি । আমার আচমকাই তোর কথা মনে পড়ল । তাই ভাবলাম , তোকে ডাকা যাক ।
-কেন ?
-এমনি ।
-আচ্ছা , নরেন্দ্রপুরে বাড়িটাকে প্রমোটিং করবি বলেছিলিস । এখনো কিছু হয়নি ।
-নারে , আমি একমাসের জন্য মুম্বাই দিদির কাছে ছিলাম ।
-কেন ?
-আসলে , দাদুর বাড়ি । তিন মাস হল মারা গিয়েছে । দাদু আমাদের দু’ জনের নামে লিখে দিয়েছিল। আমি দিদির স্বাক্ষর নিতে গিয়েছিলাম । ফিরে মনে হল তোকে ফোন করা যাক । আবার ভাবলাম যদি সময় থাকে আজ তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখাবো । তাই ডাকলাম ।
-বেশ করেছিস । আমি বোরিং হচ্ছিলাম ...
ট্রেন থামতেই , নেমে দেখলাম যতদূর চোখ যায় কুয়াশার চাঁদরে ঢেকে গি য়েছে স্টেশন চত্বর । পাশের ছোট - ছোট দোকানের মুখে খুব অল্প ক্রেতা , শীত পোষাকে দাঁড়িয়ে । তাদের দেখে ঠাণ্ডা আরও বেড়ে গেল ! রণ বলল – ভাই , হেঁটে গেলে কুড়ি মিনিট ।
আমি বললাম – অটোয় লোক হতে অনেক সময় নেবে । পায়ে হেঁটে যাব ।
আকাশে চাঁদের আলো । আকাশের নীচে আমরা , রাতের শীতলতা নিয়ে গন্তব্যে এগিয়ে চলেছি । আমি স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি , পাশে ঝিমিয়ে থাকা ঝোঁপ থেকে , অভিশপ্ত নিঃশ্বাস ভেসে আসছে , ঠাণ্ডা যেন রক্তে মিশে যাচ্ছে । পথে কেউ নেই । আমরা দুই বন্ধু , নির্জন রাস্তা , মাঝে – মাঝে পাকা বাড়ির ফাইবারের জানালার ভিতর থেকে ভেসে আসা আলোর ছায়া , আর পথের বাঁকে হলুদ আলোর লাইটপোস্ট । এইসব কিছু নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম ।
লোহার গেট খুলতেই , দ্বোতলা বড়ি । একতলায় দুটো ঘর । আমায় বলল – ভাই , পাশাপাশি যে দুটো ঘর দেখছিস , ডানদিকের ঘরে থাকব । আশা করি অসুবিধা হবেনা ?
আমি বললাম - সে নয় ঠিকাছে , ভিতরে ঢোক । খুব ঠাণ্ডা লাগছে ।
রণ বলল - ফাঁকা জায়গা , একটাই বাড়ি । পাশে মাঠ আছে । তাই , ঠাণ্ডা লাগছে । আয় ।
রণ প্রথমে প্রধান গ্রিলের তালা খুলল । কিছুটা সিমেন্টের পথ পেরিয়ে আরেকটা গ্রিল । তালা খুলে আমাকে ডানদিকের ঘরে নিয়ে গেল । বলল – তুই ভিতরে গিয়ে বস । আমি আসছি ।
আমি খেয়াল করলাম ওর হাতে প্যাকেটে তেল জমেছে । চুইয়ে – চুইয়ে পড়ছে । ট্রেনে বলেছিল প্যাকেটে --- আলুরদম , পরোটা আর স্যালাড আছে । রাস্তায় আসতে – আসতে নাকে গন্ধ এসেছে । বেশ ক্ষিধে পেয়েছে ।
আমি দেখলাম রণ প্যাকেট দুটো আমার হাতে ধরিয়ে বলল - তুই ঘরে গিয়ে গিয়ে টেবিলে এগুলো রাখ, আমি দেখছি জল আছে নাকি ।
রাত অনেক । প্রায় এগারোটা । খাওয়া হয়ে গিয়েছে । এখানে ঠাণ্ডা নিজের মতন এসে আমাদের কাবু করে ফেলেছে । আমরা একটা বিছানাতেই শুয়ে আছি । গলা অব্দি লেপ দেওয়া । মাথায় কান ঢাকা টুপি । ঘরে টিম – টিম করে খুব অল্প পাওয়ারের হলুদ বাল্ব জ্বলছে ।
আমরা অনেক দিন পর প্রাণ খুলে গল্প করলাম । এখন ঘুম আসছে । ভাবছি গল্পটা দেওয়া হবে না। এখানে এসে শীত এতটাই কাবু করেছে যে , কিছু ভেবে উঠতে পাচ্ছি না । ঘুম পাচ্ছে ।
রণ বলল - তুই ভূতে বিশ্বাস করিস ?
আমি বললাম - ওরা শীতের থেকে নিরাপদ । এই রাতে ভূতের কথা কেন ? কাল দিনের বেলায় বলবি । ঘুম পাচ্ছে ।
রণ আমার দিকে ফিরে বলল – তুই তার মানে মানিস না ?
আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম – ভাই , কাল আমি তোর কাছ থেকে গল্পটা শুনব । আমার দরকার আছে । দেখ বাড়িরে বোরিং হব বলে এখানে আসা । প্লিজ , আমি এখন ঘুমাই তারপর দেখা যাবে ।
আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । স্পষ্ট মনে আছে । তাহলে জেগে গিয়েছি কেন ! ঘরটা অন্ধকার । রণ হলুদ বাল্বটা নিভিয়ে দিয়েছিল হয়ত । পাশে শুয়ে । আচমকা ঘুম ভাঙল ! আমার মনে হচ্ছে , দরজার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে ! না দরজা বন্ধ ,তাহলে বন্ধ দরজার উল্টো দিকে কেউ !
আমাকে বাথরুমে যেতে হবে । এই শীতে একবার লেপের তলায় গেলে , আর শীতের হাতে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে মন চায়না । আমি আর চেপে রাখতে পারলাম না । রণ কে ডাকব না । যতটা মনে হচ্ছে গেটের বাইরে ইটের ঘর আছে । চাবিটা টেবিলের উপর ছিল ,
আমি দরজা খুললাম । বারান্দায় আলো নেই , অন্ধকারেই মুঠো ফোনের সহায়তায় তালা খুললাম । ভয় লাগছে । অনেক সময় পরিস্থিতি মানুষের মনে ভয়ের অনুভূতি সৃষ্টি করে । মাথায় চাঁদের আলো । বাথরুমের দরজা খুলেই হিশু করছি । শব্দ কানে আসছে । শীত রাত । চারপাশে দেখে মনে হয় , সবাই ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে চায় ।
আমি ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই , মনে হল আচমকাই আমার পা ভারী হয়ে গেল ! কেন হল ? আমার মনে হচ্ছে কেউ , আমার ঘাড় ধরেছে । এই সব মনের ভুল কেননা চারপাশে কেউ ছিলনা ।
আমি নিজেকে খুব আস্তে – আস্তে টেনে নিয়ে যাচ্ছি । আমার মনে হল , এখন উল্টে যাব । আমি বহু কষ্টে এগিয়ে যাচ্ছি । সামনে একটা কিছু দেখে আমি চুপ !
মানুষের আচমকা ভয়ের অনুভূতি হয়ত এটাই ! আমি দেখলাম , বাঁ –দিকে ঘরের সামনে বেঞ্চে একজন বসে আছেন । কালো ছায়ার মতন । সে আমার দিকে তাকিয়ে কিনা বুঝতে পাচ্ছিলাম না। তবে এত রাতে কে? আমার মনে হচ্ছে ছায়াটা হাওয়ায় ভাসছে । মানুষের মূর্তি , মানুষ নয় । আমি চলতে পাচ্ছিনা । আমার শরীরের পেশী সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে । মূর্তি নিজের মতনই বসে। আমার গা ঘুলিয়ে আসছে । বমি করে দেব ।
ঘুম ভাঙল , নিজেকে বিছানায় পেলাম । আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে মুখ । রণের ।
-তুই কাল রাতে বাইরে গিয়েছিলিস ? আমায় ডাকা উচিত ছিল ।
রণের কথা ঠিক । আমি বললাম – ভুল হয়ে গিয়েছে ।
রণ বলল – ভাই , ভুলে যদি তোর কোন ক্ষতি হয়ে যেত । তোর বাড়ির লোক আমায় ছাড়ত না ।
আমি চুপ করে থাকলাম । আগের রাতের কথাটা রণের কাছ থেকে জানতেই হবে ,বললাম - তুই একটা কথা বলবি ?
-বল ।
-তোদের এখানে তুই আর আমি ছাড়া কাল রাতে অন্য কে ছিলেন ?
-কেউ না । তবে কেউ ছিলেন কি ?
-মানে ?
-তুই আগে বল ।
আমি বললাম । অভিজ্ঞতার কথা ।
রণ চুপ করে আছে । তারপর বলল – ভাই , আজ দুপুরেই এই জায়গা ছাড়ছি । তুই যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন , সেই অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে ।
আমি বললাম – মানে ?
রণ বলল – ভাই , আমার দাদুর আত্মা এখনো এই জায়গা ছাড়েনি । শেষ জীবনে একাই থাকতেন । বাবা – কাকুর সময় হতনা দেখার । মরবার পরেই আমরা প্রমোটারদের জমি দেব বলে এখানে আসি। আমি তিনদিন ধরে এখানে আছি । রাতে একদিন দেখি ছায়া মূর্তি । চোখের ভুল কিনা , পরীক্ষা করবার জন্য তোকে রাতে থাকবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম । আমার এই কথা তুই বিশ্বাস করবি , আর কেউ করবেনা । আমার মনে হচ্ছিল আমি অসুস্থ হয়ত । কাল রাতে তোর অভিজ্ঞতা প্রমাণ করল , মানুষ অনেক কিছুই দেখতে পারে না , টের পায় না । বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই । তবুও এই জীবন্ত পৃথিবীতে সেই সব কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে ।
আমার খুব ইচ্ছা করছিল , রণকে খিস্তি দিতে । কাল আমার সাথে আরও খারাপ কিছু হতে পারত ।
আমার কাঁধে হাত দিয়ে রণ বলল - ভাই এই কথা কাউকে বলিস না । গল্প লিখলেও ঠিকানাটা চেপে যাবি । তা নাহলে , ক্ষতি হবে ।
মনে – মনে নিজেকে বললাম - এতটুকু আমি করতেই পারি । কাল ওইরকম অভিজ্ঞতার জন্যই , এখন থেকে আর আমার ভয়ের গল্প লিখতে অসুবিধা হবে না । আমার মনে হল , ভূতের কোন গল্প হয়না । তবে ভয়ের গল্প হয় ।আমি আগের রাতে ভূত দেখিনি , রণের দাদুর আত্মাকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , আত্মার অস্তিত্ব আছে ?
এই সব ভাবনা এখন নয় । বাড়ি ফিরতে হবে । এইমাত্র টুয়ার এস . এম .এস পেলাম
-- সোমবার , শেষ সুযোগ ............
----------------------------------------------------------------------------------------------------
নাম - পিনাকি চক্রবর্তী
ঠিকানা – ১ নং রাজা এস সি মল্লিক রোড
যাদবপুর পুলিশ আবাসন , ব্লক – এল , ফ্ল্যাট - নয় (L /9)
কলকাতা -৭০০০৩২
পো .অফিস – যাদবপুর ইউনিভার্সিটি
---------পিনাকি
ফোন পেয়েই আমি বুঝেছিলাম , আজ আবার কোন পাগলামি শুরু হবে । একে কলকাতার রাস্তায় কনকনে ঠাণ্ডা বরফের কুচির মতন যেন ঝরে পড়ছে । দু’ বছর আগের শীতপোশাক গুলো , আলমারিতে যত্নে তুলে রেখেছিলাম । এমন ভাবে তাদের সাহায্য নিতে হবে ভাবাই যায়নি ! জীবনে মাঝে – মাঝেই এমন অভিজ্ঞতা -- এসেই যায় ।
এখন রাত দশটা । শনিবার । টুয়া আমাকে ফোন করবে না । আমি সকালেই বলেছি , আজ আর বাড়ি যাব না । ভীষণ দরকারে অন্যত্র যেতে হচ্ছে । সোমবার ফিরব । তখনই অকে ওকে গল্প টা দেব ।
বাড়ি ফাঁকা । মা , দমদমে দাদার কাছে । তাই আজ বাঘাযতীনে নিজের বাড়িতে গেলে , হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হত । বাইরে থেকে কিছু রুটি আর তর্কা কিনতে হত ।
আমি একটা মাসিক ম্যাগাজিনের সাংবাদিক । মাসে একবার প্রকাশিত হয় । একটি বিভাগে প্যারানর্মাল , ভূত – প্রেত , কালাজাদু নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয় । সামনের মাসে আমাকে গল্প দিতে হবে । সময় বেঁধে দিয়েছে ।
টুয়া ম্যাগাজিনের অলৌকিক বিভাগের প্রধান সম্পাদক । আজ আমার বাড়িতে গল্পটা নিতে আসছে । আমি চাপে পড়ে মিথ্যা কথা বলে দিয়েছি । বলেছি , আজ শনিবার আমার বাড়িতে আসবে , টুয়াকে এক কাপ কফি করে খাওয়াব আর গল্পটা ওর পেন – ড্রাইভে ভরে দেব । আসলে একমাস আগের থেকে তাড়া দিয়েছে । আমার অভ্যাস মুখে - মুখে লেখা জমা দেওয়া । এখন দেখছি মুখ অপেক্ষারত , আমাকে গ্রাস করবে ! পালানোটাই সেরা পথ ।
আমি গল্প লিখতে পারিনি , তাই পালিয়ে আজ রাতটুকু রেহাই পেলাম, কাল রবিবার আমি অফিস যাবনা । ছুটি নিয়েছি । আবার সোমবার দেখা যাবে ।
আজ সন্ধ্যা ছ’টায় রণের ফোন পেলাম ! একমাস আগে , আমাকে নরেন্দ্রপুরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল । জানতে চাইল , সময় আছে কি না ? একা বাড়িতে থেকে এম্নিতেই এমনিতেই বাজে চিন্তায় ডুবে থাকবার চেয়ে , বন্ধুর সাথে তার পুরানো বাড়িতে রাত কাটানো বেশ ভালো ।
২
বাঘাযতীন স্টেশনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম । কেউ হাত ধরল । দেখলাম , রণ এসে গিয়েছে ।
-চল , টিকিট কেটেছিস ? নাকি তোরটা কাটব ?
-মান্থলি আছে ।
রণ বলল – আমার অফিসটা এখানেই । তুই দাঁড়িয়ে থাক আমি আসছি , টিকিট কেটে ।
আমি দেখলাম রণের দু’ হাত ভরা পলিথিনের প্যাকেট । নির্ঘাত রাতের খাবার কিনেছে । আমি তর্কা – রুটি কিনতাম । ফোনে রণ বলেই দিয়েছে , রাতে গল্প হবে , খাওয়া- দাওয়া হবে । সব ব্যবস্থা করা হয়েছে । দেখলাম বেশ তেলাক্ত আর লোভনীয় প্যাকেট , দেখেই ক্ষিধে পাচ্ছে । ভিতরে খাবার গুলো আমাদের সাহায্য প্রার্থনা করছে । অভয় দিচ্ছি , এতটুকু অসম্মানিত হবে না , বন্দী খাবারেরা ।
ট্রেন ফাঁকাই ছিল । বগিতে আমাদের নিয়ে , খুব বেশি হলে দশ জন ।
জানালার ধারে বসেছি । সামনে রণ , উল্টোদিকের সীটে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-অনেক দিন পর , কেমন আছিস ?
-ভালো । এই একমাস কোথায় ছিলিস ! আর আজ আচমকা আমাকে ফোন করলি ?
-এই একমাস খুব ঝামেলায় ছিলাম । এখনো আছি । আমার আচমকাই তোর কথা মনে পড়ল । তাই ভাবলাম , তোকে ডাকা যাক ।
-কেন ?
-এমনি ।
-আচ্ছা , নরেন্দ্রপুরে বাড়িটাকে প্রমোটিং করবি বলেছিলিস । এখনো কিছু হয়নি ।
-নারে , আমি একমাসের জন্য মুম্বাই দিদির কাছে ছিলাম ।
-কেন ?
-আসলে , দাদুর বাড়ি । তিন মাস হল মারা গিয়েছে । দাদু আমাদের দু’ জনের নামে লিখে দিয়েছিল। আমি দিদির স্বাক্ষর নিতে গিয়েছিলাম । ফিরে মনে হল তোকে ফোন করা যাক । আবার ভাবলাম যদি সময় থাকে আজ তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখাবো । তাই ডাকলাম ।
-বেশ করেছিস । আমি বোরিং হচ্ছিলাম ...
ট্রেন থামতেই , নেমে দেখলাম যতদূর চোখ যায় কুয়াশার চাঁদরে ঢেকে গি য়েছে স্টেশন চত্বর । পাশের ছোট - ছোট দোকানের মুখে খুব অল্প ক্রেতা , শীত পোষাকে দাঁড়িয়ে । তাদের দেখে ঠাণ্ডা আরও বেড়ে গেল ! রণ বলল – ভাই , হেঁটে গেলে কুড়ি মিনিট ।
আমি বললাম – অটোয় লোক হতে অনেক সময় নেবে । পায়ে হেঁটে যাব ।
আকাশে চাঁদের আলো । আকাশের নীচে আমরা , রাতের শীতলতা নিয়ে গন্তব্যে এগিয়ে চলেছি । আমি স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি , পাশে ঝিমিয়ে থাকা ঝোঁপ থেকে , অভিশপ্ত নিঃশ্বাস ভেসে আসছে , ঠাণ্ডা যেন রক্তে মিশে যাচ্ছে । পথে কেউ নেই । আমরা দুই বন্ধু , নির্জন রাস্তা , মাঝে – মাঝে পাকা বাড়ির ফাইবারের জানালার ভিতর থেকে ভেসে আসা আলোর ছায়া , আর পথের বাঁকে হলুদ আলোর লাইটপোস্ট । এইসব কিছু নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম ।
লোহার গেট খুলতেই , দ্বোতলা বড়ি । একতলায় দুটো ঘর । আমায় বলল – ভাই , পাশাপাশি যে দুটো ঘর দেখছিস , ডানদিকের ঘরে থাকব । আশা করি অসুবিধা হবেনা ?
আমি বললাম - সে নয় ঠিকাছে , ভিতরে ঢোক । খুব ঠাণ্ডা লাগছে ।
রণ বলল - ফাঁকা জায়গা , একটাই বাড়ি । পাশে মাঠ আছে । তাই , ঠাণ্ডা লাগছে । আয় ।
রণ প্রথমে প্রধান গ্রিলের তালা খুলল । কিছুটা সিমেন্টের পথ পেরিয়ে আরেকটা গ্রিল । তালা খুলে আমাকে ডানদিকের ঘরে নিয়ে গেল । বলল – তুই ভিতরে গিয়ে বস । আমি আসছি ।
আমি খেয়াল করলাম ওর হাতে প্যাকেটে তেল জমেছে । চুইয়ে – চুইয়ে পড়ছে । ট্রেনে বলেছিল প্যাকেটে --- আলুরদম , পরোটা আর স্যালাড আছে । রাস্তায় আসতে – আসতে নাকে গন্ধ এসেছে । বেশ ক্ষিধে পেয়েছে ।
আমি দেখলাম রণ প্যাকেট দুটো আমার হাতে ধরিয়ে বলল - তুই ঘরে গিয়ে গিয়ে টেবিলে এগুলো রাখ, আমি দেখছি জল আছে নাকি ।
রাত অনেক । প্রায় এগারোটা । খাওয়া হয়ে গিয়েছে । এখানে ঠাণ্ডা নিজের মতন এসে আমাদের কাবু করে ফেলেছে । আমরা একটা বিছানাতেই শুয়ে আছি । গলা অব্দি লেপ দেওয়া । মাথায় কান ঢাকা টুপি । ঘরে টিম – টিম করে খুব অল্প পাওয়ারের হলুদ বাল্ব জ্বলছে ।
আমরা অনেক দিন পর প্রাণ খুলে গল্প করলাম । এখন ঘুম আসছে । ভাবছি গল্পটা দেওয়া হবে না। এখানে এসে শীত এতটাই কাবু করেছে যে , কিছু ভেবে উঠতে পাচ্ছি না । ঘুম পাচ্ছে ।
রণ বলল - তুই ভূতে বিশ্বাস করিস ?
আমি বললাম - ওরা শীতের থেকে নিরাপদ । এই রাতে ভূতের কথা কেন ? কাল দিনের বেলায় বলবি । ঘুম পাচ্ছে ।
রণ আমার দিকে ফিরে বলল – তুই তার মানে মানিস না ?
আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম – ভাই , কাল আমি তোর কাছ থেকে গল্পটা শুনব । আমার দরকার আছে । দেখ বাড়িরে বোরিং হব বলে এখানে আসা । প্লিজ , আমি এখন ঘুমাই তারপর দেখা যাবে ।
আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । স্পষ্ট মনে আছে । তাহলে জেগে গিয়েছি কেন ! ঘরটা অন্ধকার । রণ হলুদ বাল্বটা নিভিয়ে দিয়েছিল হয়ত । পাশে শুয়ে । আচমকা ঘুম ভাঙল ! আমার মনে হচ্ছে , দরজার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে ! না দরজা বন্ধ ,তাহলে বন্ধ দরজার উল্টো দিকে কেউ !
আমাকে বাথরুমে যেতে হবে । এই শীতে একবার লেপের তলায় গেলে , আর শীতের হাতে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে মন চায়না । আমি আর চেপে রাখতে পারলাম না । রণ কে ডাকব না । যতটা মনে হচ্ছে গেটের বাইরে ইটের ঘর আছে । চাবিটা টেবিলের উপর ছিল ,
আমি দরজা খুললাম । বারান্দায় আলো নেই , অন্ধকারেই মুঠো ফোনের সহায়তায় তালা খুললাম । ভয় লাগছে । অনেক সময় পরিস্থিতি মানুষের মনে ভয়ের অনুভূতি সৃষ্টি করে । মাথায় চাঁদের আলো । বাথরুমের দরজা খুলেই হিশু করছি । শব্দ কানে আসছে । শীত রাত । চারপাশে দেখে মনে হয় , সবাই ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে চায় ।
আমি ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই , মনে হল আচমকাই আমার পা ভারী হয়ে গেল ! কেন হল ? আমার মনে হচ্ছে কেউ , আমার ঘাড় ধরেছে । এই সব মনের ভুল কেননা চারপাশে কেউ ছিলনা ।
আমি নিজেকে খুব আস্তে – আস্তে টেনে নিয়ে যাচ্ছি । আমার মনে হল , এখন উল্টে যাব । আমি বহু কষ্টে এগিয়ে যাচ্ছি । সামনে একটা কিছু দেখে আমি চুপ !
মানুষের আচমকা ভয়ের অনুভূতি হয়ত এটাই ! আমি দেখলাম , বাঁ –দিকে ঘরের সামনে বেঞ্চে একজন বসে আছেন । কালো ছায়ার মতন । সে আমার দিকে তাকিয়ে কিনা বুঝতে পাচ্ছিলাম না। তবে এত রাতে কে? আমার মনে হচ্ছে ছায়াটা হাওয়ায় ভাসছে । মানুষের মূর্তি , মানুষ নয় । আমি চলতে পাচ্ছিনা । আমার শরীরের পেশী সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে । মূর্তি নিজের মতনই বসে। আমার গা ঘুলিয়ে আসছে । বমি করে দেব ।
ঘুম ভাঙল , নিজেকে বিছানায় পেলাম । আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে মুখ । রণের ।
-তুই কাল রাতে বাইরে গিয়েছিলিস ? আমায় ডাকা উচিত ছিল ।
রণের কথা ঠিক । আমি বললাম – ভুল হয়ে গিয়েছে ।
রণ বলল – ভাই , ভুলে যদি তোর কোন ক্ষতি হয়ে যেত । তোর বাড়ির লোক আমায় ছাড়ত না ।
আমি চুপ করে থাকলাম । আগের রাতের কথাটা রণের কাছ থেকে জানতেই হবে ,বললাম - তুই একটা কথা বলবি ?
-বল ।
-তোদের এখানে তুই আর আমি ছাড়া কাল রাতে অন্য কে ছিলেন ?
-কেউ না । তবে কেউ ছিলেন কি ?
-মানে ?
-তুই আগে বল ।
আমি বললাম । অভিজ্ঞতার কথা ।
রণ চুপ করে আছে । তারপর বলল – ভাই , আজ দুপুরেই এই জায়গা ছাড়ছি । তুই যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন , সেই অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে ।
আমি বললাম – মানে ?
রণ বলল – ভাই , আমার দাদুর আত্মা এখনো এই জায়গা ছাড়েনি । শেষ জীবনে একাই থাকতেন । বাবা – কাকুর সময় হতনা দেখার । মরবার পরেই আমরা প্রমোটারদের জমি দেব বলে এখানে আসি। আমি তিনদিন ধরে এখানে আছি । রাতে একদিন দেখি ছায়া মূর্তি । চোখের ভুল কিনা , পরীক্ষা করবার জন্য তোকে রাতে থাকবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম । আমার এই কথা তুই বিশ্বাস করবি , আর কেউ করবেনা । আমার মনে হচ্ছিল আমি অসুস্থ হয়ত । কাল রাতে তোর অভিজ্ঞতা প্রমাণ করল , মানুষ অনেক কিছুই দেখতে পারে না , টের পায় না । বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই । তবুও এই জীবন্ত পৃথিবীতে সেই সব কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে ।
আমার খুব ইচ্ছা করছিল , রণকে খিস্তি দিতে । কাল আমার সাথে আরও খারাপ কিছু হতে পারত ।
আমার কাঁধে হাত দিয়ে রণ বলল - ভাই এই কথা কাউকে বলিস না । গল্প লিখলেও ঠিকানাটা চেপে যাবি । তা নাহলে , ক্ষতি হবে ।
মনে – মনে নিজেকে বললাম - এতটুকু আমি করতেই পারি । কাল ওইরকম অভিজ্ঞতার জন্যই , এখন থেকে আর আমার ভয়ের গল্প লিখতে অসুবিধা হবে না । আমার মনে হল , ভূতের কোন গল্প হয়না । তবে ভয়ের গল্প হয় ।আমি আগের রাতে ভূত দেখিনি , রণের দাদুর আত্মাকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , আত্মার অস্তিত্ব আছে ?
এই সব ভাবনা এখন নয় । বাড়ি ফিরতে হবে । এইমাত্র টুয়ার এস . এম .এস পেলাম
-- সোমবার , শেষ সুযোগ ............
----------------------------------------------------------------------------------------------------
নাম - পিনাকি চক্রবর্তী
ঠিকানা – ১ নং রাজা এস সি মল্লিক রোড
যাদবপুর পুলিশ আবাসন , ব্লক – এল , ফ্ল্যাট - নয় (L /9)
কলকাতা -৭০০০৩২
পো .অফিস – যাদবপুর ইউনিভার্সিটি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন