১৯.
|| সন্দেশখালীর বাংলো বাড়ি||
----উইলিয়াম সাজিদ সুলতান
ইউনিভার্সিটিতে এখন স্ট্রাইক চলছে। ক্লাস বন্ধ। আরও বেশ কয়েকদিন থাকবে । কলকাতায় টানা এক বছর আছি। কেমন একটা একঘেয়েমি বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কলকাতার অগণিত মানুষের নিঃশ্বাসে হয়ে ওঠা দূষিত বাতাসে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে । তাই ভাবলাম একবার গ্রামের হাওয়ায় স্নান করে আসি। সন্দেশখালিতে আমাদের একটা বাংলো বাড়ি আছে । প্রায় 1 বছর থেকে বাড়িটি একা । মা কে বললাম : "মা অনেক দিন তো সন্দেশখালি যাওয়া হয়নি , আমি ভাবছি একবার ঘুরে আসি "। মা প্রথমত রাজি হয়নি । পরে রাজি হয় বটে , কিন্তু সঙ্গে পাঠালো আমাদের বাড়ির চাকর ভোলারামদা কে । দুর্গাপুর লাহিড়ী স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়বে দুপুর 2:20 তে। প্রায় 6 ঘন্টার রাস্তা। প্রায় 2 টো নাগাদ স্টেশনে পৌঁছে গেলাম ভোলারামদা কে সঙ্গে নিয়ে । মা প্রয়োজন মতো সব জিনিসপত্র দিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে । আমি সঙ্গে নিয়েছি শরদ্বেন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প সংকলন। ভূত গল্পের প্রতি আমার ভীষণ নেশা। ছোটবেলায় মা এর কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি ভূতের । সে সবের এখন আর অবকাশ নেই ! সানডে সাসপেন্স খুব ভালোবাসি। তাই মাঝে মাঝে ভূত দেখতে ইচ্ছে করে, যদিও খুব একটা ভূতে বিশ্বাসী নয় আমি । ট্রেন এ জায়গা পেতে অসুবিধা হলো না ।
আমি জানালার ধারের জায়গাটা নিলাম। ভোলারামদা বলল ও নাকি বানকের উপর ঘুমাবে। আমি সম্মতি দিয়ে বললাম "ঠিক আছে"। অচেনা সহযাত্রী হিসেবে পেলাম দুই জন বৃদ্ধ ও 3 জন বৃদ্ধা কে । আমার বোরিং ফীল হয়নি । দাদু- দিদাদের সঙ্গে আমার খুব জমে। যদিও সেদিন তেমন কিছুই হয়নি। ট্রেন যথাসময়ে ছেড়ে দিয়েছে। আমি সেই ভূতের গল্পের বইটা পড়তে আরম্ভ করলাম ।
পরের স্টেশন হরিহর লাহিড়ীতে ট্রেন থামল। আমি বই পড়ছি , পড়েই চলেছি। বোধ করলাম একজন আমার ঠিক বিপরীতে জানালার ধারের ফাঁকা জায়গাটা পূরণ করল। জায়গাটা বেশ একটা খাপছাড়া মনে হচ্ছিল। আমি তখনও অজ্ঞ ,সে ছেলে না মেয়ে নাকি তৃতীয় কোনো প্রাণী। ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম এক কোকিলকণ্ঠী
মিহি বাঁশির মতো সুর কাকে যেন বলছে:" বাই, দেখা হবে আবার।" সেই অপূর্ব সুরে যেন ট্রেনের ঘর্ঘর শব্দ মাধুর্যে পরিণত হয়ে উঠেছে। আজ সেই সুরের কাছে ভূতের গল্পের লাইন গুলিও যেন পরাজয় স্বীকার করেছেন । তারপর যখন বইটা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে সামনে চাইলাম , চেয়েই থাকলাম চেয়েই থাকলাম। যেন স্বপ্ন দেখছি। কি অপরুপ চেহারা মায়াময় রহস্যময় দূর্বোধ্য চোখ। "সে কি কোনো ছোটবেলা মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্পের পাতালপুরীর পরী ?" যাইহোক ভ্যাবাচ্যাকা থেকে নিজেকে সামাল দিলাম । মনের মধ্যে তখনও একটা লাইন ঘুরপাক করছে ' আহা কি দেখিলাম জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না ।' আমি বাস্তবে ল্যান্ড করলাম । মেয়েটিকে সমবয়স্কি বলেই মনে হচ্ছে। নিজের মুখের সঙ্গে যুদ্ধ করে তার নাম জিজ্ঞেস করলাম । মেয়েটি অন্যমনস্ক হয়ে হয়তো উড়ে গিয়েছিল নিজের কোনো স্বপ্নের জগতে।
--- "কিছু বলছেন?"
আমি সবিস্ময়ে বললাম " আপনার নাম টা একবার জানতে চাইছিলাম।"
--- "আমার নাম তিথি। এই নামেই ডাকে সবাই । "
আমি মৃদু হেসে বললাম : " খুব সুন্দর নাম আপনার"। মেয়েটির ব্যবহার দেখে খুব মিশুকে মনে হলো। কিছুক্ষন পরে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো: "আপনার নাম কি ?"
আমি মৃদু হেসে ঔৎসুক্যের সহিত উত্তর করলাম : "নির্বোধ লাহিড়ী" । নাম শোনা মাত্র মেয়েটি তার কোমল ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে চিরল দাঁতের হাসি দিয়ে বলে উঠলো: " নির্বোধ...?"
--- "হ্যাঁ মায়ের দেওয়া নাম । অদ্ভুত হলেও মা বড্ড স্নেহ করে নাম টা দিয়েছে তাই আর চেঞ্জ করিনি। তবে আমি কিন্তু আসলে নির্বোধ না । " হেসেই বললাম ।
মেয়েটিকে সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম " আপনি কোথায় যাবেন?"
---"সন্দেশখালী।"
"বেড়াতে?"
--- " না আমার বাড়ি ওখানেই। দুর্গাপুর লাহিড়ী আমার মামা বাড়ি। ছুটি কাটাতে এসেছিলাম।"
আমি বেশ ফুরফুরে মেজাজে বললাম: " আমিও সন্দেশখালী যাচ্ছি।"
মেয়েটি কৌতূহলের সহিত প্রশ্ন করল: "বেড়াতে বুঝি?"
---"হ্যাঁ বলতে পারেন। মানে নিজেদেরই বাড়ি। প্রায় এক বছর থেকে কেউ থাকেনা ওখানে । আমি ছুটি কাটাতে যাচ্ছি আর কি ।"
" সন্দেশখালীর কোথায় ?"
আমি বললাম ,"স্টেশন থেকে হেঁটে 10 মিনিটের রাস্তা।" তারপর কিছুক্ষনেই অবস্থা ঘুরে গিয়ে দুজনের 'আপনি ' 'তুমি' রূপ ধারণ করেছে।
আমার হাতের বউটা দেখে সে জানতে চাইলো আমি ভূতের গল্প ভালোবাসি কি না । তারপর দুজনের মধ্যে বেশ জমিয়ে গল্প হলো। গল্পের নির্দিষ্ট কোনো বিষয়বস্তু ছিল না। শেষমেষ রাত্রি 9 টায় পৌঁছলাম সন্দেশখালী স্টেশন । ভোলারামদার মাথায় মাঝারি রকমের ভারী ব্যাগটা তুলে শুরু হলো পদযাত্রা। কিছুক্ষন নিস্তব্ধ থাকার পর তিথিকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাবো আর ঠিক সেই সময় সে বলে উঠলো:" চলো আমিও এই দিক হয়েই যাবো , তোমাদের ছেড়ে দিই। " তারপর রাস্তায় হাটতে শুরু করলাম একসাথে সঙ্গে ননস্টপ গল্প। আমার মধ্যে এত কথা ছিল আগে কোনো দিন বুঝতে পারিনি । হঠাৎ যে কি হলো !
মাঝে মাঝে কাকতলীয়ভাবে আমার হাতের সাথে তিথির হাতের মিলন, গায়ে গায়ে ধাক্কা, তিথির মুখের কোমল মৃদু হাসি, এ সব যেন আমাকে মোহে আছন্ন করে তোলে। ইতিমধ্যে আমি স্থির করে ফেলেছি যে মা কে একটা সারপ্রাইজ দেব।
"এই তো চলে এসেছি "। " তোমার আর কতটা পথ?"
--- তিথি মৃদু হেসে উত্তর করল: "আমাকে আর মিনিট পাঁচেক হাটতে হবে।"
"তুমি মেয়ে মানুষ , রাস্তায় যদি কোনো বিপদ হয়? চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। "
---" না না ! তুমি অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছো । তাছাড়া আমি এই গ্রামেরই , কোনো বিপদ হবে না"।একরকম বিচলিত হয়েই তিথিকে বিদায় দিয়ে আমি আর ভোলারামদা বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম।
মরুভূমির সমস্ত ধুলোবালি যেন ঝরে উড়ে এসে নিরুপায় হয়ে এই বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার। মাকড়সার জাল। এদিকে ওদিকে টিকটিকি আর ইঁদুরের যেন মেলা বসেছে। দরজার পসের সুইচ টা অন করলাম। ঘরে আর অন্ধকার নেই। ভোলারামদাকে এখন আপাতত ঘুমোনোর জন্য একটা ঘর পরিষ্কার করে দিতে বললাম। এখন আর খেতে ইচ্ছে করলোনা কিছু। ভোলারামদা কে বললাম:" তুমি খেতে চাইলে কিছু খেয়ে নাও। ব্যাগের মধ্যে টিফিন বক্সটা আছে।
---" আজ্ঞে দাদাবাবু"।
তারপর ভোলারামদার ঘর পরিস্কার হয়ে গেলে বিছানায় চাদর পেতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভোলারামদা একটা ক্ষীন গলায় বলে উঠলো: " দাদাবাবু আমি আজ তোমার পাশেই ঘুমাবো। বড্ড ভয় ভয় করছে।"
--- "ঠিক আছে ঘুমোও"। আমি খাটের একপাশে শুয়ে পরলাম। তারপর ঘড়ির এলার্মে ঘুম ভাঙল।
ভোলারামদা তখনও ঘুমোচ্ছে। ভোলারামদা কে ডেকে চা করতে আর তারপর সব ঘরগুলো পরিষ্কার করে দিতে বললাম । তারপর চা খেয়ে ভোলারামদা কে বললাম : "পরিস্কার হয়ে গেলে পাশের বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে এসে রান্না টা সেরে রেখো। আর হ্যাঁ , ঝোল টা বেশি করে করবে আর লবন যেন বেশি না হয় "। বলে আমি ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম ।
সকালের নবজাত সূর্যের আলো , নদীর অক্লান্ত সুশীল বাতাস আমার শরীরের শহুরে নোংরাগুলিকে যেন ম্লান করে দিলো। পাখিদের মধুমিশ্রিত কলতান শহুরে বিষাক্ত শব্দ গুলিকে পরাজিত করে আমার কানের সঙ্গে সঙ্গমে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। চাষীরা চলল অফিসে। বাচ্চাদের খেলার ছলে পড়তে যাওয়া দেখে ইচ্ছে হলো আরো একবার ছোটো হতে। ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো এক এক করে ভিড় জমাল। কখন সূর্য বিদায় নিয়েছে বুঝতেই পারিনি । ঘরে ফিরলাম সন্ধেবেলায় । খাওয়া দাওয়া সারতে রাত্রি হয়ে গেল । ভোলারামদা খাওয়া সেরে পাশের ঘরে ঘুমোতে গেল। আমিও শুয়ে পড়লাম । ঘুমে চোখ প্রায় জড়িয়ে এসেছে আর হঠাৎ ভীষণ জোরে বিদ্যুৎ গর্জে উঠলো। আমি চমকে উঠলাম। আমার হৃৎপিন্ড ঢিপঢিপ শব্দ শুরু করল । ঝোড়ো বাতাসের জেরে খোলা জানালা গুলো সজোরে ধাক্কা দিয়ে নড়তে শুরু করলো। উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতেই দেখি সামনের আম গাছ টি ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তার থেকে কিছু দূরের গাছ গুলি সব মর্মর শব্দে ভেঙে পড়লো মাটিতে। মনে হলো প্রকৃতি আজ তার নিষ্ঠুরতম লীলা নিয়ে নেমে এসেছে। তারপর শুরু হলো ভয়ঙ্কর বৃষ্টি। বৃষ্টির এক একটি ফোঁটায় মাটিতে যেন বড় বড় গর্ত সৃষ্টি নিচ্ছে। আমার ভেতর থেকে ঢিপঢিপ শব্দ আরো বেড়েছে। ঠিক সেই সময় দরজায় কেউ যেন জোর জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি ভয়কম্পিত গলায় বললাম : "কে...?"
---"নির্বোধ দরজাটা খোলো, আমি তিথি।"
আমি তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দিলাম। " এই ঝড় বৃষ্টির রাত্রে তুমি একা কি করছো ? এসো ভেতরে এসো।" তিথি ভেতরে এসে সোফায় বসল।
তিথির সৌন্দর্য সকালবেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই। তিথির মুখে একটি শান্তির রূপ প্রস্ফুটিত হয়েছে , যে শান্তি শুধুমাত্র হৃদয়ের তৃপ্তি থেকেই সম্ভব। হয়তো তা দেখেই ঝড়ের যে দেবতা একটু আগেই রুক্ষ ছিল সেই দেবতাই এখন শান্ত হয়েছে ।
আমি বললাম :" চা খাবে?"
--- " না থাক খাবো না।"
প্রকৃতি যেন সঙ্গে সঙ্গে আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠলো। জানালা গুলো আরো জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে যেন তাদের কেও দম বন্ধ করে মারতে চাইছে।তারপর হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ কে কেউ অপহরণ করে নিয়ে চলে গেল। ভোলারামদা কে ডেকেও , তার হদিস নেই।
---" আমার বড্ড ভয় করছে নির্বোধ।"
" ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি মোমবাতি জ্বালাচ্ছি।"
তারপর মোমবাতি ধরিয়ে সোফার দিকে তাকাতেই
আমার পুরো শরীর নিস্তব্ধ। সারা শরীর যেন বরফে পরিণত হয়ে গেল। থরথর করে কাঁপছে এই লম্বা শীর্ণ দেহটা । সমস্ত লোমগুলো যেন অসময়ে বাধ্যে ঘুম থেকে উঠলো। চোখগুলো যেন ডুকরে বেরিয়ে আসছে। চাইলেও কাওকে ডাকতে পারছি না । তারপর অর্ধমৃত কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলাম: " ক-ক-ক- কে তুমি?"
তারপর এক বীভৎস অসয্যশীল হাসি আমার কানের চারিপাশে ঘুরপাক খেতে শুরু করল। হাসির আওয়াজ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছিল সেই বীভৎস হাসি চারপাশের দেওয়ালগুলিকে তীব্রভাবে সজোরে আঘাত করছিল যে তাদের গা থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে, তারা আর্তনাদ করছে। আমি কিছুতেই চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলাম না। সেই হাসি এক বিকট হাসি।
তারপর হঠাৎ স্পষ্ট প্রতীয়মান অন্ধকার । তারপর সকালবেলা দেখি আমি নীচে অস্বাভাবিক অবস্থায় পড়ে আছি। ভোলারাম দা আমার চোখে মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে নিয়ে এলো।
ভোলারামদা একরকম স্মিতবিস্মিত সুরেই বলল : " দাদাবাবু অপনার কাল কি হয়েছিল বলুনতো? আপনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন কেন ?"
আমি ভোলারাম দা কে একরকম বিস্ময়ে কিন্তু সন্দেহের সহিত জিজ্ঞেস করলাম : "কাল কি রাত্রে ঝড় বৃষ্টি হয়েছিলো? "
---" না দাদাবাবু । এই সুন্দর অনুকূল আবহাওয়ায় হঠাৎ বৃষ্টি হবে কেন বলুন তো !"
তারপর হুড়মুড়িয়ে উঠে গিয়ে জানালার দিকে তাকাতেই দেখি আমগাছটা ঠিক তার নিজের জায়গাতেই আছে।
আমার হৃৎপিন্ড আরো একবার জোরে জোরে ঢিপ ঢিপ করে উঠলো।
ভোলারামদা জিজ্ঞেস করল : " আচ্ছা দাদাবাবু , সেদিন ট্রেন এর উপরে ,সবাই যখন ঘুমাচ্ছিল , আপনি ওরোম ভাবে হেসে হেসে কার সাথে কথা বলছিলেন বলুন তো ?"
আমি অবাক নিস্তব্ধ বিস্মিত প্রশ্নমিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম ভোলারামদার দিকে ।
" আমি কি তাহলে ....?"
William Wss
25/07/2017
[Meher Manjil ,79/A
Dilkhusa Street
Kolkata 700017
Near Dilkhusa Nursing Home
Park Circus
|| সন্দেশখালীর বাংলো বাড়ি||
----উইলিয়াম সাজিদ সুলতান
ইউনিভার্সিটিতে এখন স্ট্রাইক চলছে। ক্লাস বন্ধ। আরও বেশ কয়েকদিন থাকবে । কলকাতায় টানা এক বছর আছি। কেমন একটা একঘেয়েমি বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কলকাতার অগণিত মানুষের নিঃশ্বাসে হয়ে ওঠা দূষিত বাতাসে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে । তাই ভাবলাম একবার গ্রামের হাওয়ায় স্নান করে আসি। সন্দেশখালিতে আমাদের একটা বাংলো বাড়ি আছে । প্রায় 1 বছর থেকে বাড়িটি একা । মা কে বললাম : "মা অনেক দিন তো সন্দেশখালি যাওয়া হয়নি , আমি ভাবছি একবার ঘুরে আসি "। মা প্রথমত রাজি হয়নি । পরে রাজি হয় বটে , কিন্তু সঙ্গে পাঠালো আমাদের বাড়ির চাকর ভোলারামদা কে । দুর্গাপুর লাহিড়ী স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়বে দুপুর 2:20 তে। প্রায় 6 ঘন্টার রাস্তা। প্রায় 2 টো নাগাদ স্টেশনে পৌঁছে গেলাম ভোলারামদা কে সঙ্গে নিয়ে । মা প্রয়োজন মতো সব জিনিসপত্র দিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে । আমি সঙ্গে নিয়েছি শরদ্বেন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প সংকলন। ভূত গল্পের প্রতি আমার ভীষণ নেশা। ছোটবেলায় মা এর কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি ভূতের । সে সবের এখন আর অবকাশ নেই ! সানডে সাসপেন্স খুব ভালোবাসি। তাই মাঝে মাঝে ভূত দেখতে ইচ্ছে করে, যদিও খুব একটা ভূতে বিশ্বাসী নয় আমি । ট্রেন এ জায়গা পেতে অসুবিধা হলো না ।
আমি জানালার ধারের জায়গাটা নিলাম। ভোলারামদা বলল ও নাকি বানকের উপর ঘুমাবে। আমি সম্মতি দিয়ে বললাম "ঠিক আছে"। অচেনা সহযাত্রী হিসেবে পেলাম দুই জন বৃদ্ধ ও 3 জন বৃদ্ধা কে । আমার বোরিং ফীল হয়নি । দাদু- দিদাদের সঙ্গে আমার খুব জমে। যদিও সেদিন তেমন কিছুই হয়নি। ট্রেন যথাসময়ে ছেড়ে দিয়েছে। আমি সেই ভূতের গল্পের বইটা পড়তে আরম্ভ করলাম ।
পরের স্টেশন হরিহর লাহিড়ীতে ট্রেন থামল। আমি বই পড়ছি , পড়েই চলেছি। বোধ করলাম একজন আমার ঠিক বিপরীতে জানালার ধারের ফাঁকা জায়গাটা পূরণ করল। জায়গাটা বেশ একটা খাপছাড়া মনে হচ্ছিল। আমি তখনও অজ্ঞ ,সে ছেলে না মেয়ে নাকি তৃতীয় কোনো প্রাণী। ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম এক কোকিলকণ্ঠী
মিহি বাঁশির মতো সুর কাকে যেন বলছে:" বাই, দেখা হবে আবার।" সেই অপূর্ব সুরে যেন ট্রেনের ঘর্ঘর শব্দ মাধুর্যে পরিণত হয়ে উঠেছে। আজ সেই সুরের কাছে ভূতের গল্পের লাইন গুলিও যেন পরাজয় স্বীকার করেছেন । তারপর যখন বইটা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে সামনে চাইলাম , চেয়েই থাকলাম চেয়েই থাকলাম। যেন স্বপ্ন দেখছি। কি অপরুপ চেহারা মায়াময় রহস্যময় দূর্বোধ্য চোখ। "সে কি কোনো ছোটবেলা মায়ের কাছ থেকে শোনা গল্পের পাতালপুরীর পরী ?" যাইহোক ভ্যাবাচ্যাকা থেকে নিজেকে সামাল দিলাম । মনের মধ্যে তখনও একটা লাইন ঘুরপাক করছে ' আহা কি দেখিলাম জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না ।' আমি বাস্তবে ল্যান্ড করলাম । মেয়েটিকে সমবয়স্কি বলেই মনে হচ্ছে। নিজের মুখের সঙ্গে যুদ্ধ করে তার নাম জিজ্ঞেস করলাম । মেয়েটি অন্যমনস্ক হয়ে হয়তো উড়ে গিয়েছিল নিজের কোনো স্বপ্নের জগতে।
--- "কিছু বলছেন?"
আমি সবিস্ময়ে বললাম " আপনার নাম টা একবার জানতে চাইছিলাম।"
--- "আমার নাম তিথি। এই নামেই ডাকে সবাই । "
আমি মৃদু হেসে বললাম : " খুব সুন্দর নাম আপনার"। মেয়েটির ব্যবহার দেখে খুব মিশুকে মনে হলো। কিছুক্ষন পরে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো: "আপনার নাম কি ?"
আমি মৃদু হেসে ঔৎসুক্যের সহিত উত্তর করলাম : "নির্বোধ লাহিড়ী" । নাম শোনা মাত্র মেয়েটি তার কোমল ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে চিরল দাঁতের হাসি দিয়ে বলে উঠলো: " নির্বোধ...?"
--- "হ্যাঁ মায়ের দেওয়া নাম । অদ্ভুত হলেও মা বড্ড স্নেহ করে নাম টা দিয়েছে তাই আর চেঞ্জ করিনি। তবে আমি কিন্তু আসলে নির্বোধ না । " হেসেই বললাম ।
মেয়েটিকে সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম " আপনি কোথায় যাবেন?"
---"সন্দেশখালী।"
"বেড়াতে?"
--- " না আমার বাড়ি ওখানেই। দুর্গাপুর লাহিড়ী আমার মামা বাড়ি। ছুটি কাটাতে এসেছিলাম।"
আমি বেশ ফুরফুরে মেজাজে বললাম: " আমিও সন্দেশখালী যাচ্ছি।"
মেয়েটি কৌতূহলের সহিত প্রশ্ন করল: "বেড়াতে বুঝি?"
---"হ্যাঁ বলতে পারেন। মানে নিজেদেরই বাড়ি। প্রায় এক বছর থেকে কেউ থাকেনা ওখানে । আমি ছুটি কাটাতে যাচ্ছি আর কি ।"
" সন্দেশখালীর কোথায় ?"
আমি বললাম ,"স্টেশন থেকে হেঁটে 10 মিনিটের রাস্তা।" তারপর কিছুক্ষনেই অবস্থা ঘুরে গিয়ে দুজনের 'আপনি ' 'তুমি' রূপ ধারণ করেছে।
আমার হাতের বউটা দেখে সে জানতে চাইলো আমি ভূতের গল্প ভালোবাসি কি না । তারপর দুজনের মধ্যে বেশ জমিয়ে গল্প হলো। গল্পের নির্দিষ্ট কোনো বিষয়বস্তু ছিল না। শেষমেষ রাত্রি 9 টায় পৌঁছলাম সন্দেশখালী স্টেশন । ভোলারামদার মাথায় মাঝারি রকমের ভারী ব্যাগটা তুলে শুরু হলো পদযাত্রা। কিছুক্ষন নিস্তব্ধ থাকার পর তিথিকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাবো আর ঠিক সেই সময় সে বলে উঠলো:" চলো আমিও এই দিক হয়েই যাবো , তোমাদের ছেড়ে দিই। " তারপর রাস্তায় হাটতে শুরু করলাম একসাথে সঙ্গে ননস্টপ গল্প। আমার মধ্যে এত কথা ছিল আগে কোনো দিন বুঝতে পারিনি । হঠাৎ যে কি হলো !
মাঝে মাঝে কাকতলীয়ভাবে আমার হাতের সাথে তিথির হাতের মিলন, গায়ে গায়ে ধাক্কা, তিথির মুখের কোমল মৃদু হাসি, এ সব যেন আমাকে মোহে আছন্ন করে তোলে। ইতিমধ্যে আমি স্থির করে ফেলেছি যে মা কে একটা সারপ্রাইজ দেব।
"এই তো চলে এসেছি "। " তোমার আর কতটা পথ?"
--- তিথি মৃদু হেসে উত্তর করল: "আমাকে আর মিনিট পাঁচেক হাটতে হবে।"
"তুমি মেয়ে মানুষ , রাস্তায় যদি কোনো বিপদ হয়? চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। "
---" না না ! তুমি অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছো । তাছাড়া আমি এই গ্রামেরই , কোনো বিপদ হবে না"।একরকম বিচলিত হয়েই তিথিকে বিদায় দিয়ে আমি আর ভোলারামদা বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম।
মরুভূমির সমস্ত ধুলোবালি যেন ঝরে উড়ে এসে নিরুপায় হয়ে এই বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার। মাকড়সার জাল। এদিকে ওদিকে টিকটিকি আর ইঁদুরের যেন মেলা বসেছে। দরজার পসের সুইচ টা অন করলাম। ঘরে আর অন্ধকার নেই। ভোলারামদাকে এখন আপাতত ঘুমোনোর জন্য একটা ঘর পরিষ্কার করে দিতে বললাম। এখন আর খেতে ইচ্ছে করলোনা কিছু। ভোলারামদা কে বললাম:" তুমি খেতে চাইলে কিছু খেয়ে নাও। ব্যাগের মধ্যে টিফিন বক্সটা আছে।
---" আজ্ঞে দাদাবাবু"।
তারপর ভোলারামদার ঘর পরিস্কার হয়ে গেলে বিছানায় চাদর পেতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভোলারামদা একটা ক্ষীন গলায় বলে উঠলো: " দাদাবাবু আমি আজ তোমার পাশেই ঘুমাবো। বড্ড ভয় ভয় করছে।"
--- "ঠিক আছে ঘুমোও"। আমি খাটের একপাশে শুয়ে পরলাম। তারপর ঘড়ির এলার্মে ঘুম ভাঙল।
ভোলারামদা তখনও ঘুমোচ্ছে। ভোলারামদা কে ডেকে চা করতে আর তারপর সব ঘরগুলো পরিষ্কার করে দিতে বললাম । তারপর চা খেয়ে ভোলারামদা কে বললাম : "পরিস্কার হয়ে গেলে পাশের বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে এসে রান্না টা সেরে রেখো। আর হ্যাঁ , ঝোল টা বেশি করে করবে আর লবন যেন বেশি না হয় "। বলে আমি ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম ।
সকালের নবজাত সূর্যের আলো , নদীর অক্লান্ত সুশীল বাতাস আমার শরীরের শহুরে নোংরাগুলিকে যেন ম্লান করে দিলো। পাখিদের মধুমিশ্রিত কলতান শহুরে বিষাক্ত শব্দ গুলিকে পরাজিত করে আমার কানের সঙ্গে সঙ্গমে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। চাষীরা চলল অফিসে। বাচ্চাদের খেলার ছলে পড়তে যাওয়া দেখে ইচ্ছে হলো আরো একবার ছোটো হতে। ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো এক এক করে ভিড় জমাল। কখন সূর্য বিদায় নিয়েছে বুঝতেই পারিনি । ঘরে ফিরলাম সন্ধেবেলায় । খাওয়া দাওয়া সারতে রাত্রি হয়ে গেল । ভোলারামদা খাওয়া সেরে পাশের ঘরে ঘুমোতে গেল। আমিও শুয়ে পড়লাম । ঘুমে চোখ প্রায় জড়িয়ে এসেছে আর হঠাৎ ভীষণ জোরে বিদ্যুৎ গর্জে উঠলো। আমি চমকে উঠলাম। আমার হৃৎপিন্ড ঢিপঢিপ শব্দ শুরু করল । ঝোড়ো বাতাসের জেরে খোলা জানালা গুলো সজোরে ধাক্কা দিয়ে নড়তে শুরু করলো। উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করতেই দেখি সামনের আম গাছ টি ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তার থেকে কিছু দূরের গাছ গুলি সব মর্মর শব্দে ভেঙে পড়লো মাটিতে। মনে হলো প্রকৃতি আজ তার নিষ্ঠুরতম লীলা নিয়ে নেমে এসেছে। তারপর শুরু হলো ভয়ঙ্কর বৃষ্টি। বৃষ্টির এক একটি ফোঁটায় মাটিতে যেন বড় বড় গর্ত সৃষ্টি নিচ্ছে। আমার ভেতর থেকে ঢিপঢিপ শব্দ আরো বেড়েছে। ঠিক সেই সময় দরজায় কেউ যেন জোর জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি ভয়কম্পিত গলায় বললাম : "কে...?"
---"নির্বোধ দরজাটা খোলো, আমি তিথি।"
আমি তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দিলাম। " এই ঝড় বৃষ্টির রাত্রে তুমি একা কি করছো ? এসো ভেতরে এসো।" তিথি ভেতরে এসে সোফায় বসল।
তিথির সৌন্দর্য সকালবেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই। তিথির মুখে একটি শান্তির রূপ প্রস্ফুটিত হয়েছে , যে শান্তি শুধুমাত্র হৃদয়ের তৃপ্তি থেকেই সম্ভব। হয়তো তা দেখেই ঝড়ের যে দেবতা একটু আগেই রুক্ষ ছিল সেই দেবতাই এখন শান্ত হয়েছে ।
আমি বললাম :" চা খাবে?"
--- " না থাক খাবো না।"
প্রকৃতি যেন সঙ্গে সঙ্গে আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠলো। জানালা গুলো আরো জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে যেন তাদের কেও দম বন্ধ করে মারতে চাইছে।তারপর হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ কে কেউ অপহরণ করে নিয়ে চলে গেল। ভোলারামদা কে ডেকেও , তার হদিস নেই।
---" আমার বড্ড ভয় করছে নির্বোধ।"
" ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি মোমবাতি জ্বালাচ্ছি।"
তারপর মোমবাতি ধরিয়ে সোফার দিকে তাকাতেই
আমার পুরো শরীর নিস্তব্ধ। সারা শরীর যেন বরফে পরিণত হয়ে গেল। থরথর করে কাঁপছে এই লম্বা শীর্ণ দেহটা । সমস্ত লোমগুলো যেন অসময়ে বাধ্যে ঘুম থেকে উঠলো। চোখগুলো যেন ডুকরে বেরিয়ে আসছে। চাইলেও কাওকে ডাকতে পারছি না । তারপর অর্ধমৃত কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলাম: " ক-ক-ক- কে তুমি?"
তারপর এক বীভৎস অসয্যশীল হাসি আমার কানের চারিপাশে ঘুরপাক খেতে শুরু করল। হাসির আওয়াজ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছিল সেই বীভৎস হাসি চারপাশের দেওয়ালগুলিকে তীব্রভাবে সজোরে আঘাত করছিল যে তাদের গা থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে, তারা আর্তনাদ করছে। আমি কিছুতেই চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলাম না। সেই হাসি এক বিকট হাসি।
তারপর হঠাৎ স্পষ্ট প্রতীয়মান অন্ধকার । তারপর সকালবেলা দেখি আমি নীচে অস্বাভাবিক অবস্থায় পড়ে আছি। ভোলারাম দা আমার চোখে মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে নিয়ে এলো।
ভোলারামদা একরকম স্মিতবিস্মিত সুরেই বলল : " দাদাবাবু অপনার কাল কি হয়েছিল বলুনতো? আপনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন কেন ?"
আমি ভোলারাম দা কে একরকম বিস্ময়ে কিন্তু সন্দেহের সহিত জিজ্ঞেস করলাম : "কাল কি রাত্রে ঝড় বৃষ্টি হয়েছিলো? "
---" না দাদাবাবু । এই সুন্দর অনুকূল আবহাওয়ায় হঠাৎ বৃষ্টি হবে কেন বলুন তো !"
তারপর হুড়মুড়িয়ে উঠে গিয়ে জানালার দিকে তাকাতেই দেখি আমগাছটা ঠিক তার নিজের জায়গাতেই আছে।
আমার হৃৎপিন্ড আরো একবার জোরে জোরে ঢিপ ঢিপ করে উঠলো।
ভোলারামদা জিজ্ঞেস করল : " আচ্ছা দাদাবাবু , সেদিন ট্রেন এর উপরে ,সবাই যখন ঘুমাচ্ছিল , আপনি ওরোম ভাবে হেসে হেসে কার সাথে কথা বলছিলেন বলুন তো ?"
আমি অবাক নিস্তব্ধ বিস্মিত প্রশ্নমিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম ভোলারামদার দিকে ।
" আমি কি তাহলে ....?"
William Wss
25/07/2017
[Meher Manjil ,79/A
Dilkhusa Street
Kolkata 700017
Near Dilkhusa Nursing Home
Park Circus
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন