ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৯


সৃজিত মুখার্জির বাইশে শ্রাবণের পর আমার দেখা আর একটি অসাধারণ থ্রিলার "vinci da",
আর সৃজিত মুখার্জি মানেই একটা চমক, কারণ লাস্ট মুহূর্ত পর্যন্ত যে দর্শককে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে ,সেই পরিচালকের একটি আলাদা সম্মান প্রাপ্য।

একঘন্টা সাতান্ন মিনিটের এক টানটান উত্তেজনায়,
সমান্তরাল ও নগরকীর্তন খ্যাত ঋদ্ধির অভিনয় , যে ছোটো থেকেই অপরাধ আইনের প্রতি তার তীব্র আসক্তি, ১৮ বছর বয়স হবার আগের মুহূর্তেই সে তার মাতাল ও অত‍্যাচারী বাবাকে খুন করে মা কে তার অত‍্যাচার থেকে বাঁচায়। কিন্তু অপরাধের তকমা তার গায়ে লাগায় তার মা তার পাশে থাকে না ,
আইন অনুযায়ী তার কোনো কঠোর শাস্তি হয় না এবং ক্রমে সে পড়াশোনা ও বুদ্ধির দ্বারা বুঝে নেয় আইনের খুঁটিনাটি।
ক্রমে বড়ো হওয়া আদি বোসের ভুমিকায় অভিনয়ে আসেন ঋত্বিক,
সিরিয়াল কিলারের ভুমিকায় সে শহরে একের পর এক খুন করতে থাকে।

অপরদিকে,একজন সাধারন Prosthetic Artist থেকে নিজের অজান্তেই এক সিরিয়াল কিলার কে সাহায্য করে বসা থেকে, ঘটনার শেষে নিজের হাতেই সেই সিরিয়াল কিলার কে খুন করা.... সব মিলিয়ে রুদ্রনীলের অভিনয় আপনার নজর কাড়তে বাধ্য,

এক দক্ষ পুলিস অফিসারের ভূমিকায় অনির্বানের অভিনয় ,এবং সোহিনীর অভিনয় ও যথেষ্ট প্রশংসনীয়,

সিনেমার প্রত্যেক টি গান আপনার মন কাড়তে বাধ্য, আর আপনি যদি ইতি মধ্যে অনুপম রায়ের ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে তো কথাই নেই ,সে ক্ষেত্রে অনুপম রায়ের লেখা এবং নোবেলের গাওয়া " তোমার মনের ভেতর যাই" গানটি এবং অনুপম রায়ের গাওয়া "শান্ত হও" গান দুটি আপনার মন কাড়তে বাধ্য, এছাড়া "গ্যাস বেলুন" তো আছেই দর্শকের মন ভরানোর জন্য ,

শেষে একটা কথাই বলবো,এই সিনেমাটিকে কোনো হলিউডি সিনেমায় সাথে তুলনা করা ভুল ,
তবে আমার মনে হয় এটি যথেষ্ট একটি ভালো সিনেমা, বাংলা সিনেমা ঠিক একদিন উঠে দাঁড়াবে,
তার শুধু একটু সময় চাই ,তাকে সেই সময় টুকু অন্তত দিন , আর অনেকের মতে কিছু সিনেমা কপি হচ্ছে, আসলে কপি করলেও না সৃজিত একটু নতুন কিছু দেন ,যাতে সেই ফিল্মটির কিছু নিজস্বতা থাকে ,আর এখানেই সৃজিতের কৃতিত্ব।
আমি জানি না আদৌও এই ফিল্ম কপি কিনা কিংবা কোনো অংশ কপি করা হয়েছে কিনা ,তবে এটি যদি সৃজিতের নিজস্ব লেখা হয় তাহলে আমি আর একবার কুর্নিস জানাই সৃজিত মুখার্জি কে।




শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

প্লিজ যেও না
মৌমন মিত্র

তোমার নাভি চক্রে রাখব ওসে ভেজা পদ্মপাতা
এক মুঠো  মেঘের দীনতা।
প্লিজ ছেড়ে যেও না,

তোমার ত্বকের মসৃনতায়
আমি মিশব সম্ভাব্য আদরে!

প্লিজ যেও না।

লেপ কাঁথা মড়কে মোরা পুরনো বাসন কোসন
 মাদুর বালিশ চারিদিক তুমি তে মাখামাখি।
লক্ষীটি দোহাই তোমার প্লিজ ছেড়ে যেও না।

দক্ষিনা বাতাস ,চকিতে অনাবিল মুহূর্ত,
শিমুল ,বেলি ,চাপা ,রজনী
বুঝি না যে কোন ফুলের স্পর্শে কাতর হবে তুমি।

আমি শঙ্খর ধ্বনিতে, তোমার আবগের ঋণে, 
কফির নরম ধোঁয়ায়,
ঘুম ঘুম আদরে
অনাদিকাল তোমার স্পর্শে ভিজতে চাই।

মনে রেখে দিও
দোহাই তবু প্লিজ যেও না।
চিরন্তন আলো

আলো দেখলে ভয় হয়,গা শিউরায়;
আলোর প্রহেলিকায় বিমর্ষ হয়ে যাই।
আলোর রঙীন গোলকধাঁধার চক্রব‍্যূহে-
প্রতিনিয়ত সমাপ্তির সমান্তরালে পৌঁছাই।
এই তো সেদিন আলোর লোভে-
এক বুক পাহাড় নিয়ে সূর্যের কাছে গেছিলাম।
সূর্য একরাশ উষ্ণতা ছুড়ে দিল!
গা ঝলসে সমুদ্রের শীতলতায় স্নান করলাম।
কিন্তু সমুদ্রের আলোয় অন্তরালের আঘাত!
কী ভীষণ কষ্টদায়ক! ক্ষয়ে গেল আমার শরীর।
পরে আঁকিবুকি পথে গেলাম:গাছের সাথে দেখা;
গাছ বলল-তোমায় আমি প্রাণ দেব।
গাছের আলোর লোভে ধীরে ধীরে পা বাড়ালাম:
বুঝতেই পারিনি বুকের ভিতর শিকড় গজাচ্ছে।
হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে উঠল এক অজানা বিষবৃক্ষ!
কই সে তো আমায় আলো দেয় না!
সে তো ছায়া দেয়,সেই ছায়া যে অন্ধকারে
আমার শরীরে নিমেষে মুখ লুকোয়।
বরং ফিরে যাই সেই আলো ঝলমলে অতীতে!
যেথায় রয়েছে প্রকৃতির রচিত নিষ্কলুষ কাব‍্য,
সেথায় সাদামাটায় নাকি চিরন্তন লুকিয়ে থাকে!

                            -রুন্না ভাওয়াল


                      অপ্রকাশিত খুশি

খুশির রক্তিমাভার অগোছালো রূপ আছে
স্বাভাবিক নিশ্চল পথে পরিস্ফুটন কম হয়,
আবহমানকালে তাঁর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ভাসে;
বিবর্ণ আনন্দগুলো নীলাভ নিস্ক্রিয় হয়।
শ‍্যাওলার স‍্যাঁতস‍্যাঁতে জমা জলে যখন-
পাট গুলো স্বয়ংক্রিয় ভাবে পচে ওঠে!
আমি খুশির উষ্ণতা দেখতে পাই তাঁর মুখে।
পিতৃ পরিচয়হীন মেয়েটা যখন টিউশন পড়িয়ে-
একটা মোটা কাপড় ওই অবৈধনীর গায়ে জড়িয়ে দেয়!
চিলেকোঠার কোনঠাসা 'মা'র মুখে খুশি দেখি।
একলা আকাশে নিস্প্রভ চাঁদ কামুক হয়ে ওঠে;
হঠাৎই যখন পারিপার্শ্বিক 'তারা'দের সমাগম হয়-
'খুশি'টা আমি তার দীপ্তির ঝলকে দেখতে পাই।
বাঞ্ছিত খুশি গুলো বঞ্চিত না হওয়াই থাক।
মিশে যাক অন্তরের 'অপ্রকাশিত খুশি'।

                        -রুন্না ভাওয়াল।
রিটার্ন গিফ্ট/সেরা উপহার
--------
বাবা-মা দুজনেই চাকরি করায়, খুব ছোটোবেলা থেকেই দিনের বেশিরভাগ সময়টাই ঠাম্মির কাছে থাকতো আহেলি। একটু বড় হলো, তখন দুপুরবেলা, ওকে হোমটাক্স করতে বসিয়ে,  ঠাম্মিও একটা মোটা মতন খাতা নিয়ে তাতে কি সব যেন লিখতেন।
আহেলি অনেকবার দেখতে চাইলেও, উনি বারবার বলতেন --"বড় হও, তখন দেখাবো।"
প্রতিবার জন্মদিনে ঠাম্মিকে প্রণাম করে বলতো:-- "এবার তো বড় হয়েছি।"
এইভাবে ওর আঠারোতম জন্মদিনে ওর হাতে সেই খাতা তুলে দেন ঠাম্মি।

আহেলি অবাক হয়ে পড়ে, কি সুন্দর সুন্দর কবিতা!

আজ ঠাম্মির সত্তরতম জন্মদিন।  আহেলি খুব ঘটা করে পালন করলো। অনেক অতিথি অভ্যাগত।
ঠাম্মির হাতে উপহার তুলে দিলো। মোড়ক খুলে দেখলেন, ওনার কবিতাগুলো বইয়ের ভিতর। জীবনের সেরা উপহার পেয়ে, আহেলিকে বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেললেন।
       ********
   পাপিয়া মণ্ডল
নন্দিনীর স্বপ্ন

অফিসের পাশেই ঝাঁ চকচকে বার কাম রেস্টুরেন্ট "বি- সিক্স"। মদ্যপানে অভ্যেস না থাকলেও অমিত ফাস্টফুড খেতে খুব ভালোবাসে। তাই মাঝেমাঝেই চলে যায় দুপুরের দিকে হালকা স্যান্ডউইচ বা চাউমিন খেতে। এরকম ভাবেই একদিন নতুন ওয়েটার নন্দিনীর সাথে আলাপ। এমনিতে নতুন বন্ধু বান্ধবী তৈরিতে অমিতের জুড়ি মেলা ভার। প্রথমদিন নন্দিনীকে দেখেই অমিতের বেশ ভালো লেগে গেছিল। প্রায় রেগুলার কাস্টমার হওয়ার দরুন ফোনে নম্বর সহজেই আদানপ্রদান হলো।অমিতের মতো কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী তার নম্বর নেওয়াতে নন্দিনীর খুব অবাক লেগেছিল। তার মতো এক নিম্নশ্রেণীর মানুষ, যাকে সুন্দর সাজপোশাক পরে ওয়েটারের কাজ করতে হয়, তার সাথে এতটা যেচে আলাপ, রাতে ঘরে ফিরে বৃদ্ধ বাবাকে খেতে দিয়ে আয়নার সামনে অনেকদিন পর নন্দিনী নিজেকে দেখলো ভালো করে, একটা লাল টিপ পরে।
অল্পবয়সে মা মারা যাওয়ার পর এবং বাবার মিলের চাকরি চলে যাওয়ার পর, বোনেদের বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিজের জীবনের সব আশা আকাঙ্খাকে নন্দিনী জলাঞ্জলি দেয়। অনেকদিন বাদে কেউ যেচে তার নম্বর নেওয়াতে একটু বেশি উত্তেজিত ও খুশি যেন সে আজ। রাত 12 টার সময়ে হটাৎ হোয়াটসআপে প্রথম মেসেজ আর সহসা এক শীতল আবেশে ভেসে গেল নন্দিনী, অনেকদিন বাদে।বন্ধুত্ব গড়ালো অনেকদূর। হোটেলে আলাপ হয়ে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, প্রিন্সেপ ঘটে আড্ডা, লেক কালিবাড়িতে পুজো দেয়া বা ইলিশ উৎসবে সুন্দরবনে একদিনের ট্রিপ, নন্দিনী হটাৎ অনুভব করলো জীবন বড্ডো পরিবর্তনশীল।
জীবন পরিবর্তনশীল ছিল, অনেকটা নিষ্ঠুরভাবে । যেদিন নন্দিনীর সাথে দেখা করে অমিত জানালো যে সামনের মাসে তার বিয়ে, বিয়ের পর সে আমেরিকা যাচ্ছে পি এইচ ডি করতে, যেখানে তার হবু স্ত্রী তথা 5 বছরের পুরানো গার্লফ্রেন্ড শ্রীতমা মাস্টার্স করে চাকরি করছে। হ্যাঁ, নন্দিনী শুধু বলতে পেয়েছিল যে ভালো থেকো, বাকিটা বলতে পারেনি, মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। তার মনে হয়েছিল যে হোটেলের ওয়েটাররা শুধু বাবুদের সময় কাটানোর মাধ্যম, তাদের কি আদৌ স্বপ্ন দেখার যোগ্যতা আছে ? ঈশ্বর কি আদৌ তাদের প্রতি সদয়? সবাই শ্রীতমা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না, যোগ্যতা এখন ভালোবাসা দিয়ে হয় না, হয়তো সামাজিক স্ট্যাটাস টাই আসল।
কিস্তিমাত!

‘সাদা কালো ঘুঁটিতে’ তখন নৈরাজ্যের আবাস!
জীবন-দাঁড়িপাল্লায় একটা প্রথাগত জয় আর পরাজয় ----
অর্থাৎ, বীভৎস এক কৃত্রিম খেলা
এক গুরুত্বহীন মরণখেলা
এক অনিবার্য শেষের খেলা!
নাম ‘জীবন-দাবা।’

ধরা যাক,
নিয়মের ‘সাদা ঘুঁটিটা’ অমীমাংসিত এক জীবিত দাবি।
সামনের ‘কালোটা’ রাষ্ট্রের নিরক্ষর তর্জনী
সঙ্গে চাবুকের এক নম্র তান্ডব ----
আর অজস্র বিনোদনের হাসি।

শুরুতেই...
সাদা সৈন্যের এক ভ্রুণ
মায়ের কোলই হল তার কবরজমি।

 এক পৈশাচিক দেনা দিয়ে খেলাটা কেমন শুরু!


অবশেষে, লাল নীল গেরুয়া রক্তের মিছিলে
খেলা যখন তুঙ্গে
তখন চেক আর নয়,
ডিরেক্ট চেকমেট আগ্রাসনের আওতায়।

পূর্বনির্ধারিত খেলা শেষ!
ওদের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুরও মৃত্যু হয়েছে।
কালো-রাষ্ট্র
তোমায় ‘কুর্নিশ’ - তোমায় ‘সেলাম’
তোমায় ‘শুভেচ্ছা’ জানাই!
তুমি জিতে গেছ -----
জিতে গেছ ওদের মৃতদেহে লাথি মেরে।।।


সুমি...
ইমাজিনেশন যখন ইলুউশন
বিকাশ দাস (বিল্টু )
(18-04-19)

ইমাজিনেশন য্খন ইলুউশন  হয় তখনি পেইন্টিং হয় দার্শনিক ভাবধারার

ভাবের বহিঃপ্রকাশ হয় পোড়খাওয়া  রাজনৈতিক বিশ্লেষকের, সাহসিকতা এভারেস্ট বিজয়ী বাচেন্দ্রি  পালের

কলমের আঁচড়গুলো  বুকের ভিতরের আবদ্ধ পিঞ্জরায় বিঁধতে থাকে, দংশনে দংশিত বিষ হজম করে বেরিয়ে আসে অবয়ব, কিংবা মানসরুপী মূর্তি, ভাসতে থাকে মূর্তমান  এক বাস্তব ও বীভৎস  রূপী

কথার বুলেট কিংবা প্রতিশ্রুতির বন্যা বিঁধে গাণ্ডীব তীরের ফলার ন্যায়, শিহরিত কানের স্নায়ুর সাথে চোখের যোগ সূত্র !

 চোখে ঝাপসা  প্রতিচ্ছবি আঁকে ,ইমাজিনেশন  এর কথা আসতেই আবার ইলুউশন হওয়ার ভয়ে বুকটা আর্তনাদ করে কাচ ভাঙার বেদনায়

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার আমি কে প্রশ্ন করতেই দুচোখে বন্যার জল গড়িয়ে আসে, আয়না দেখে  ফেলে এই ভয়ে আয়নাকে  বলেই দেই  আমি আমার বেশ

মুচকি হেসে আয়না বুঝে নেয় হৃদয়তীরের শোকানল
কি যে খেলা খেলছে তা শুধু মন আর মনেই জানে.....
       

                     ##c@biltu@##
সম্পর্কের ইতিকথা
বিকাশ দাস (বিল্টু )
(12-04-19)

হাড়গুলি কি আজও আছে? তা তো চৈত্রের  এক দাবদাহ  দিনে ক্যালসিয়াম শেষে ছাই !

পাললিক  শিলার জীবাশ্মে  আমি হাড়  খুঁজি, খুঁজে বের করি একটি  একটি হাড়ের মধ্যে রয়েছে কেমন আমার নিখাদ সম্পর্ক !
আর অস্থি  মজ্জায় লেপ্টে থাকা ডিএনএ তে আমার  ভালোবাসার পরশ কতটুকু

কার্বন  ডেটিং প্রয়োগ করে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সম্পর্ক খুঁজি

সম্পর্কে  কি একবন্ধন আছে? আমার তো দ্বিবন্ধন.... তবুও সাধারণ হাইড্রোজেন

মাটিতে তো ছাই , বিয়োজিত  জৈব সারে হাড় গুলিও মাটি, আমার দেহের মাটি খনন করলেও পাই শুধুই ছাই

সম্পর্কের বন্ধনের স্নেহলতা  সেখানেই লুকিয়ে?

একটি  কালো কয়লা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে গভীর সম্পর্কের সমুদ্রের তলদেশ থেকে পান্নাগুলো মনের অলঙ্কার হয়ে সম্পর্কের বুদ্ বুদ্ কে ফুটিয়ে তোলে আর উষ্ণপ্রস্রবণ জল আরও ফুটতে থাকে

বিনিদ্র রাতে চোখে কালশিটে  দাগের পরেও
আমার সম্পর্কের ইতি টানতে পারিনি

হয়তবা সম্ভবও নয়.....এ যে নিবিড় সম্পর্ক

             
শীতকাল:
জয়ীতা চ্যাটার্জী

জানি তুমি জানো নি জানে নি তোমার মন
কখন ছায়াপথ থেকে তুলে নেয় ধ্রুবতারা,
মুছে দেয় অবসন্ন ক্ষন।
তোমার শীতল জাপটে ধরা নেয় না শরীর স্নায়ু।
তুলে নিতে নিতে বুকের রাজ্য, নিশ্বাসে কমে বায়ু।
অমন হিমেল কাতর চুমু অবশ ঠোঁটেই  ঝরায় রক্তপাত,
তোমার গায়ের গন্ধ মাখে রাতের মায়া অমানিশার জাল।
কনকনে হাতের ছোঁয়ায় তোমার ,
আঙুল হারায় সহ্য বোধ।
অমর মেঘলোকে বিছিয়ে রাখা দুটি চোখ
আর পৃথিবীর কাছে আদরের ঋণ শোধ।
তোমার এমন ঠান্ডা শরীর রক্তে মাংসে মরণ ডেকে আনে।
পদ চিহ্নগুলো বুকে তোলা থাকে
 দেহ মরে গেলেও মিশে যাই
তোমার নিঃশ্বাসে আর ঘ্রাণে।
তোমার বরফ নিঃশ্বাস ছুঁয়েছে
গলা, বুক, পিঠ আজীবন ইচ্ছামতো।
দূর থেকে যতই দূরে চলে যাই
তোমার প্রশ্বাস জুড়ে আমার চিহ্ন অবিরত।।

বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৯

| আমি জলবাজ বলছি |

তেলবাজ আর জলবাজের যামানায়

আমি জলবাজ বলছি

 বৃষ্টির জন্য চাতক যেমন তেমন

চেয়ে আছি তোমার নৈকট্যে এক প্রকল্পস্বাদ।



কাজের বিনিময়ে খাদ্য হলেও

এখন দখলের বিনিময়ে বিজয়

কিইবা আসে যায় অবৈধ বিচরণে

 সাদা বকের কা কা শব্দে

অথচ শহরগুলো কাঁদছে তাঁর হারানো শিল্পকলার জন্য।



তেল আর জল যেমন মিশে না

তেমনি ভালো আর মন্দ

সিন্ডিকেট যদি লেজুরিপনা

লোভাতুর খলনায়কের হয়

শেষ দৃশ্যে এসে মার খেতেই হবে কাহিনীকারের হাতে।



আমি জলবাজ বলছি

রক্তাক্ত বিভাজনের চেতনাবিমুখ এক মৈত্রীপুরুষ

মা মাটি আর মানুষের কবি।



যতদূর দৃষ্টি যায়

এক নৈসর্গিক চিত্রকারীগর আমাকে

নির্দেশনা দেয়

ভালোবাসা আর শুধুই ভালোবাসা

সম্প্রীতি সমঝোতার দরদী সমাজ

তেল না আমি জলবাজ বলছি।





কবিঃ- ফারুক মোহাম্মদ ওমর


মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৯

নারীদের আজও সৌন্দর্য রক্ষা করে চলতে হয় কেন?


   প্রসাধনীর আড়ালে

সুদর্শনা তন্বী, লিপ্‌স্টিকের সঠিক পরিমান ব্যবহার, লং ল্যাশ্‌, নিজেকে পাতে দেওয়ার উপকরণ মাত্র। সেই উনবিংশ থেকে আজকের শতাব্দীতেও। অন্দরমহল কেবল বদলেছে। উপঢৌকনে নারীরা পেয়েছে নিজেদের একটু অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। সমাজের যে কোন স্তরে নারীদের আজও সৌন্দর্য রক্ষা করতে হয়। তা না হলে সমাজ তাদের আজ ও কোণঠাসা করে চলেছে। প্রায়শই নৃশংস রুপে।

কিছুদিন আগে একটি টক্‌ শো তে Ellen DeGeneres কথা বলছিলেন Jenifer Lopez এর সাথে। কথা হচ্ছিল তার low carb diet নিয়ে এবং একটি পিয়ানোর ওপর তার নৃত্য কৌশলী নিয়ে। কি ভাবে তিনি stilettos পরে উনপঞ্চাশ্‌ বছর বয়েসে অবলীলায় নৃত্য পরিবেশন করেছেন। বিশ্বাস করুন এই মাঝ্‌ বয়েসি মহিলার দিক থেকে চোখ ফেরান যায় না। তার মানে প্রসাধন আর ডায়েট্‌, যতদিন তিনি যৌবনা, ততদিন তার এই জগতে ঠাঁই।



এরপর চোখ পড়ল আরেকটি পাতায় যেখানে বলছে একটি মহিলা নিজেই নিজেকে মেরে ফেলেছে। কারণ? তার মেক্‌ আপ্‌ ঠিক স্থানে খুঁজে পাননি। হয়তো ভাবছেন আত্মহত্যা বুঝি একটু বাড়াবাড়ি। ঠিক তাই। তবে এই বাড়াবাড়ির স্থানে এক নারী পৌঁছে গেল কি ভাবে? কৈশোরে ক্লাসে এক বান্ধবীকে দেখতাম প্যাড দেওয়া অন্তর্বাস পড়তে। কি জানি, ওই ছোট্ট বয়েসে কি ভাবে যেন বুঝেছিলাম মেয়েদের ফ্ল্যাট ব্রেস্টেড হওয়াটা বুঝি বা অপরাধের। কালের পরিবর্তনে জানলাম প্যাড দেওয়া অন্তর্বাস, আজকের দিনের একটি বুমিং Industry।

একজন মহিলার ভুল breast augmentation surgery হয় । বছর দুই পর ওনাকে আবার ওই একই সার্জারি করাতে হয়। কেন শুনবেন? ওনার implantation ফেটে যায়। গ্ল্যামার ম্যাগাজিনে ২০০৬ এ একটি আর্টিকেল বলে ৩,৬৪,০০০ মহিলা এই breast augmentation surgery  করেন, যা ৪০% বেশি, বিগত পাঁচ বছরের থেকে। তাদের মধ্যে প্রায় ৮৫% মহিলাদের জীবনের ঝুকিও  ছিল।

এবার চলুন কোন এক জঙ্গলা পরিবেশে যাই। ওদের বোনা গয়না, ওদের হাতের পোড়া মাংস আমরা উন্নত সমাজ, বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি। এক হাতে single malt, আরেক হাতে আপনার দেশের মাটি। weekend party র এমন বেহিসাবি মুহূর্ত আপনাদের বেশ পরিচিত, তখন পার্টির নর্তকীদের দেখতে বেশ লাগে, তাই না? ভাবেন ‘ আঃ লাগাতার উন্নতি হচ্ছে’ । আর ওই জঙ্গলা মেয়েগুলো? যাদের কারুকাজ করা accessories আপনার কন্যা, বোন, বউ অথবা মা কে বেশ মানায়। ওদের কাঁধে চড়ে ওই জঙ্গলা পুরুষগুলো এখনো আমাদের সমাজের আদিম নৃত্য পরিবেশন করে।



এই কদিন আগে, খুব তীব্র কষ্ট মাখা দুটি শব্দ পড়লাম। ‘Husband Stitch’, ভাবছেন পুরুষরাও শেলাই ফোরাই করছে বইকি আজকাল! না ঠিক তা নয় জানেন। কিছু কিছু নতুন মায়েরা ঠিক মা হওয়ার পর মুহূর্তে তাদের যোনিতে একটি additional stitch করিয়ে রাখেন। যা মহিলাদের যোনিকে সরু করে রাখে যাতে পুরুষরা সঠিক ভাবে তাদের কাম্‌  উপভোগ করতে পারে। মহিলারা, মানে এইসব মহিলাদের আর কোনদিন একই অনুভুতি ফিরে আসে না। আর্টিকেল টি আমায় বহু রাত haunt করেছে।



এযাবৎ আমরা ভেবে এসেছি যে যদি আমরা স্লিম, সুন্দরী হই তাহলেই আমরা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এর আড়াল বেজায় ভয়ংকর!

আর কত গুলো women’s day এভাবেই তথ্য ভিত্তিক আর্টিকেল লিখে যাব আমরা বলতে পারেন? বদল কে আমি অস্বীকার করছি না, কিন্তু সময়ের অনুপাতে এই বদলের পরিমান কি মনে হয় সমানুপাত আপনাদের?

আসুন না, তাহলে বিশ্বকবির বানীই আত্মস্থ করি

‘আমাদের শক্তি মেরে তোরাও বাঁচবি নে রে

বোঝা তোর ভারি হলেই ডুববে তরীখান’

রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯

গল্প

   
 কাল বৈশাখ
  অতনু রায়
ভাবতেই অবাক লাগে, যুগের সুতোয় গাঁথা সবকটা বৈশাখের মাপও আলাদা হতে পারে। কিছু বৈশাখ সযত্নে পুষে রাখে নতুন বছরের স্বাদটাকে, আবার কিছু বৈশাখ কালবৈশাখীর মেঘলা বাতাসে লুকিয়ে পড়তে চায়। শ্রাবণ ছাড়া বৈশাখেও পুরানো আঘাতের মেলা বসে। ঠিক এমনই এক বৈশাখে মেঘ এসেছিল আমার শহরে। 
                     
                       আজ থেকে প্রায় চার বছর আগের একটি ক্লান্ত শনিবার। ঠিক তার পরের দিন আসতে চলেছে নতুন একটি বছর। অফিসের গরুখাটা
শেষ হয়ে তখন সবে বাড়ি ফিরছি। শনিবার ছাড়া অন্য কোনোদিনেই সাতটার ট্রেন ধরার সৌভাগ্য আমার হয় না। এদিকে তার সাথে সম্পর্কটা একসপ্তাহ হলো ভালো যাচ্ছে না।মন মেজাজ তেমন ভালো নেই। কথা ছিল কালকের দিনটা তার সাথে কাটাবো।ট্রেন থেকে নামতেই হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো তার নাম। ফোনটা ধরেই শুনলাম তার কঠিন গলা। আমাকে বলল তক্ষুনি দেখা করতে। আমি ভাবলাম বোধহয় আমার মান ভাঙাতে কাছে ডাকছে।আমিও কোনোরকম গ্যারেজ থেকে বাইকটা বার করে চটপট বাড়ি গেলাম। বাড়িতে কোনোরকম হাত-মুখ ধুয়ে মায়ের হাতের গরম চা অর্ধেক কাপ গোগ্ৰাসে গিললাম আর বেরিয়ে পড়লাম গঙ্গার উদ্দেশ্যে। বেশি দূর নয়, পাঁচ মিনিটেই পৌঁছালাম। দেখি তিনি আমার আগেই এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হাতে একটা মস্ত ব্যাগ।
     
                         আমি বাইকের স্ট্যান্ডটা ফেলে তার কাছে গেলাম।যেমন যাই তেমনই কাছে গেলাম, অনেকটা কাছে। কিন্তু এই প্রথমবার আমার কাছে যাওয়াটা তার খুশির কারণ হয়ে উঠলো না।সেই লজ্জা, সেই লাল মুখ কোনোকিছুই যেন খুঁজে পেলাম না।সে যেন হঠাৎ দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছে। আমাকে হঠাৎ বলল সে নাকী আর সম্পর্ক রাখবে না।আমি ভাবলাম মজা করছে,কারণ এর আগেও এমনটা করেছে। কিন্তু না, দেখলাম সবটাই সত্যি। সে তার হাতের ব্যাগটা আমার হাতে তুলে দিল। দেখলাম আমার দেওয়া সবকটা উপহার সযত্নে রাখা।
সে বলল সে আমাকে নিয়ে পারবে না সুখে থাকতে। সে অন্য একজনকে ভালোবেসে ফেলেছে, তার সাথে থাকতে চায়। বলে বিদায় জানালো। আর আমি বললাম, "ভালো থেকো"।
সে চলে গেল পীঠ দেখিয়ে। মনে হল মনটায় যেন এক শক্ত হাতের কামার হাতুড়ি বসিয়েছে। 

                   আমিও সেই অবস্থায় বাইকে উঠে পড়লাম।মনে তখন শুধু পাথর । বাইকটা চলছে একশো দশে। চোখের জলে চশমার কাঁচে বাস্প জমে আসছে।সামনেটা শুধু আবছা।এমন সময় দেখলাম শুধু একটা আলো।আমাকে ছিটকে ফেলল ফুটপাতে।তারপর সবটাই রহস্যের মত ধোঁয়াশা। চোখ খুলে দেখলাম আমি হাসপাতালে। অনেক ক্ষত ছিল। তাও সেরে উঠেছি। 
    
      আজ আমি আছি ভালোই।সেও বোধহয় সুখে আছে। সেরে উঠলেও চোরা ক্ষতটা আজও চিনচিন করে।

সম্পাদকীয়



বৈশাখী সংখ্যাঃ-
বহুদিন বিরত থাকার পর আবার এলাম ফিরে সাথে নিয়ে নতুন ইভেন্ট। এবারের সংখ্যা বৈশাখ নিয়ে। বৈশাখ আসলেই  মনে পড়ে রাঙা পাঞ্জাবি পরে বাড়ির বড়দের সাথে হালখাতা করতে যাওয়া।এমন কিছু ছোটবেলার স্মৃতি হয়তো কাজের ব্যস্ততায় কিংবা বিকেল ফেরা দমকা হাওয়ায় আপনাদেরকেও মনে করিয়ে দিয়ে যায়।

বৈশাখের মেঘলা সকাল আর মেঘের সাথে পাল্লা দেওয়া বজ্র ফোরাম, কাজ ফেলে ছুটির মেজাজে আরাম কেদারা আর চায়ের ভাড়ে। কিংবা কাদা মেখে ফুটবল, বিকেলের পর ঠাকুমা বা দাদুর কাছে গল্পে মেতে ওঠা রোমাঞ্চকর সন্ধ্যে মেতে উঠবে বৈশাখ হয়তো এই ভাবে।
আবার কারো কাছে বাংলা ক্যালেন্ডারে প্রথম প্রেম, হলদে পাঞ্জাবি কিংবা সবুজ শাড়ি পরনে ছেলেটি আর মেয়েটি, জোড়াসাঁকো হোক কিংবা পোর্টবন্দরে।
   @জয়দীপ 

কবিতা


  উপহার
  জয়দীপ রায়

শেষের বৈশাখের
কোচিং ফেরা ব্যাগ কাধের
অন্ধকার জমে চিলেকোঠায়
বৃষ্টির ঝাপটায় ভেজা কলার
বকুনির সমুদ্র সফেন
তখনও বইছিল সিঁড়ি বেয়ে
সিঁড়ি ভাঙার ভুলের মাশুল
গুনছিল এক সদ্য জাতক
ভিজে বালুচরে লেগে যে
পায়েসের গন্ধ
উদ্বেলিত জীমূত চত্বর
পারলে ভিজুক ধান দুব্যের উঠান
ঠাকুমার শঙ্খে বেজে ওঠা
আশীর্বাদ টাও ভিজুক
ভিজুক চাতকটাও
চেয়েছি যে মেঘ পেয়েছি মল্লার
পচিঁশের উঠানে বৃষ্টি উপহারে।

কবিতা


  ১লা বৈশাখ
   বেবী পোদ্দার         
   
        খুলে যায় যত দ্বার,বন্ধ দুয়ার
               গ্রামের পর গ্রাম
          শহর এসেছে মানুষের সমাগমে
             গ্রাম এসেছে আগে-
           প্রবেশ করেছে বৈশাখ
              ঝড় জল বৃষ্টি বাদল।

           পল্লবিত আম্রপত্র
          দরজায় স্বত্বিক চিহ্ন
            আজ হাল খাতা?
         বদলে যাচ্ছে সব ধুলো ঝড়
         কাঁচা আম কুড়াবার ধূম
           সে সব আজ কোথায়?

          তবু এসেছে বৈশাখ।
          দই মিষ্টি ইলিশ
         এসেছে শিবের গাজন
          আজ এসেছে বৈশাখ
                            মেলা পার্বন।

কবিতা

 
 ভবিষ্যত

মুঠো থেকে হারিয়েছে ঘুম
চুম্বনে লেগে আছে লম্পট প্রশ্নদাগ।

তোমাকে গোছাতে গিয়ে বহুবার
অবাধ্য এ বর্তমান,
সময় চিনেছে ভালো থাকা আপেক্ষিক।
কুয়াশার তেজ কেটে
নেমে আসা রোদের শহর---
যেন আজ আমি তার কেউ নই,
শুধু আগামীকে ভেবে এই পথ।

তোমাকে দেখবো বলে
আরো বহুবার...
আমি ঈশ্বর ভেবে ছুঁয়ে দেখেছি জ্বর।

অন্তরা চট্টোপাধ্যায়

কবিতা

 
  ক্যানভাস 
গৌতম সমাজদার

  তুমি প্রায়ই বলতে
   মন মিথ্যে বলে,বলায়--
   ইনিয়ে বিনিয়ে রামধনু ছড়ায়--
   র‌ঙীন ফানুসে পৃথিবী ভরায়।
আমি তর্ক জুড়ে বলতাম,
      হৃদয়‌ই তো হাল,
      যা ভাবে তাই করায়
       ভাসায়, নোঙ্গর এ জড়ায়।
তুমি বলতে সোহাগ ভরে
        শরীর কখনো মিথ্যে বলেনা,
         মিথ্যে বলায় না সতর্ক মুহূর্তেও।
শরীরের রং ক্যানভাসে আঁকা যায় না
        বলতে তুমি, শরীর নিজেই ক্যানভাস
         যতখুশি তুলির আঁচড় টানো--
         মন না চাইলেও ভেসে যাও,
          শুধুই ভেসে যাও.......।।

কবিতা

 
 
হালখাতা
রথীকান্ত সামন্ত

সৌভাগ্যের দ্রুয়িদ, ধাতব মূল্যের সূর্য উঠেছে সিঁদুর মেখে। আহ্নিকগতি আজ বৈদিকপথে ঘুরে সাদা হিসাবভূমে এঁকে দেয় মঙ্গলচিহ্ন।এখন সকাল। অজেয় সেকেন্ড প্রতিমিনিটে এগিয়ে যায় এক শুভেচ্ছা-সম্বল সন্ধ্যার দিকে।
পথের ধারেই আমিও খুলেছি সভ্যতার সাজানো দোকান ; আমিও আঁকিয়েছি সূর্যটানের স্বস্তিক, তুলে রাখতে বিক্রির লাভ লোকসান। সন্ধ্যে নামে। ঠান্ডা পানীয়স্নাত কত পিপীলিকা ঐশ্বর্যখন্ড মুখে ফিরে যায় প্রীতিবিনিময়ে।
আমিও হিসাব লিখবো আজ, কত চর্ম্মসার  কঙ্কাল খিদে দত্তক নেয়; বছরে কত বাড়ে দেহকর, পিঁপড়ের কত বিষ জমা হয় বাৎসরিক বিক্রীত দেহে। তুলনা করাই যায়, এই ভেবে গত সন বের করে আনি। অমনি ধুলো আর ধুলো, আর ধূসর দিগন্তে পিঁপড়েরা মিলিয়ে যায়
স্বস্তিখন্ড মুখে। হিসাব কষি,ওদের পিছনে কটা নগ্নশিশু মিলিয়ে যায় ফিবছর সতৃষ্ণচোখে।

কবিতা



 আজ ও ধরা আছে 
  চৈতালী রায়

তোমার আর আমার মাঝে সম্পর্কের যে সেতুটা ঝুলছিল
খুব অনায়াসেই তার বিনিময়ে একটা গোটা নদী কেনা যেত। 
আমাদের তৈরি করা শব্দের হাত ধরে আমরা পৌঁছে গেছিলাম 
শব্দের শেষ নীলিমায় নীল হয়ে যাওয়া তলে। 
তুমি হৃদয়ে ঠুসে ভরেছিলে বারুদ 
আমার ছিল আবেগ, উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা। 
কাঁচের স্বচ্ছ দেওয়ালে শ্যাওলা জমেছিল 
উত্তাল ঢেউয়ে বিকৃত কীটপতঙ্গ। 
চোরা স্রোতে তোমার হৃদয়ে অসুখ বেঁধেছিল ক্ষয়ে যাওয়ার
পায়ের পাতায় ক্লান্তির গাঁথুনি। 
একটার পর একটা দেওয়াল আমি ভাঙছিলাম 
তোমার কাছে আরও কাছে পৌঁছানোর জন্য। 
নৈকট্য কিংবা নৈঃশব্দ্য যতবার ছুঁতে গেছি অবলীলায় হাত বাড়িয়ে 
সামনের থেকে সরে গিয়ে সেগুলো রাস্তার দু'পাশে ভিড় করেছিল। 
তোমার বিপন্ন, অস্থির মানসিকতায় 
কাঁচের দেওয়াল ভেঙে খান খান হয়েছে। 
নৈঃশব্দ্য আজও ধরা আছে 
তোমার আর আমার ঠিক মাঝখানটিতে

কবিতা


 রবি প্রণাম                                             পারমিতা ভট্টাচার্য
  পারমিতা ভট্টাচার্য
তোমার মতন করে , কেই বা ডাকতে পারে ,
এসো হে বৈশাখ আজই আমার প্রাণের পরে ।
প্রেমে – অপ্রেমে , তুমি থেকো দুঃখে – সুখে ,
খরবায়ু নিয়ে এসো এই ব্যাথাতুর বুকে ।
বৈশাখের দাবদাহে ক্ষীণ ক্লিষ্ট জীবনে ,
তোমার গান ঢালুক সুধা বিশ্ববাসীর প্রাণে ।
যূথী , বেল , মল্লিকা , মাধবীলতার ছোঁয়ায় ,
ধন্য হল মানব জনম , বৈশাখী মত্ততায় । 
রবি তুমি শুধু কবি নয় , নয় বৈশাখী আলাপে ,
তুমি চিরসখা আমার প্রাণের , আনন্দে – বিলাপে ।
তোমার মত এমন ব্যাকুল কয় জনারই ডাক ,
তোমার পায়ে শত প্রণাম কবি , জীবনে বৈশাখী ছোঁয়া পাক ।

কবিতা


        প্রশ্ন বৈশাখে?
         সুদীপ্ত সেন

        গুটি ফেলে গেছে প্রজাপতি
         বসন্ত ফুরিয়ে গেছে চৈত্র সেলে
         আজ বৈশাখ।

        তোমার গায়ে নতুন কুর্তি
        ওড়না লাগেনা, নাওনি তাই
        এই কুর্তিতে আজ বৈশাখ।

        হাল খাতা নতুন পাতা পাবে
        ফুরিয়ে যে পাতা খবর হীন
       দোকানে দোকানে আজ বৈশাখ।

       যে মেয়েটা রোজ ফুল বিক্রী করে
       যে মাসি রোজ ঘর মোছে,কাপড় কাচে
       তাদের, বৈশাখে নতুন পোশাক হয়েছে? 

কবিতা


অনুজ্জ্বল বৈশাখের প্রসাদ
সুনন্দ মন্ডল

বিষণ্ন বিকেলে অবহেলায় অবহেলায় ক্ষত বিক্ষত হতে থাকা যুবকটি এক বৃদ্ধের মতো কুঁজো হয়ে বসে পড়ল বটের নীচে।
 
কেউ একজন বলেছিল পূর্ণিমা চাঁদের হাই দেখতে পাবি!
সেও বলেছিল একরাশ হতাশা আর অবজ্ঞার বাতাবরণ কিছুই না এই সমাজের চৌকোনে।
আর অমুক বলেছিল নির্ভেজাল বাস্তুভিটেতে সুখের মোড়কে দুঃখটাকেও সঙ্গী করে চলতে হয়।
তমুকও বলতে চেয়েছিল কিছু মানুষের মানসিক বৃত্তির পরিকাঠামো।

রঙিন স্বপ্নগুলো বাস্তবতার ভিড়ে হারিয়ে ফেলা যুবকের চোখের কোনে এখনও সেই অনামিকা।
যে খড়কুটোর মত আশা জোগাবে ভেবে দিনের মলিনতা ঢাকতে চেয়েছে যুবকটি।
রাতের জ্যোৎস্না মেখেও কোটরাগত শরীরের হাড়ে জ্বালানির মতো অবসন্নতার আস্তাকুঁড়।

বর্তমান অতীত হবে একদিন, আবার অতীত বর্তমানকে সঙ্গে করে ভবিষ্যতে পৌঁছায়।

অনামিকা সাতাশ পেরিয়ে অপেক্ষায় সেই সদ্য পেরিয়ে যাওয়া পঁয়ত্রিশের আর মনে পড়ে বসন্তের বিকেল, কমলার গাছ, রামপুরহাট প্ল্যাটফর্ম, ঝালমুড়ি, ভাঁড়ের চা, অভাবী পকেটে কয়েকটা খুচরো আর হলুদ পাঞ্জাবির ওপরে জেগে থাকা এতবছরের বেকারত্বের ঘানি টানা যুবকটির ম্লান মুখ! আর প্রার্থনা করে একটা সরকারি লেবেল দেওয়া কর্মীর হাসিমুখ।

পয়লা বৈশাখে স্নান সেরেছে বাঙালি, শুদ্ধ হতে চেয়েছে সমাজ। কিন্তু অনুজ্জ্বল এই সদ্য কয়েকটা পাকা দাড়ি গজিয়ে ওঠা মুখটি। 

চাকরি নেই, কাজ নেই, হয়তো অনামিকাও নেই জীবনের রথে। তবুও টাকা ছাড়া মূল্যহীন হয়ে পড়া শুকনো চেহারায় অনামিকার মুখোমুখি হতে চায়! কিন্তু বাস্তব আর মনুষ্যত্ব কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে অনিমেষের।

নতুন বছর, নতুন পয়লা, নতুন বৈশাখ, আরও একটা বেকার জীবন। অস্তিত্বহীন সংকটে ভালোবাসা ছাড়াই সমাজের চৌকাঠ। যা এই অনুজ্জ্বল বৈশাখে প্রসাদের নমুনা!
                    


কবিতা


 দূর তবু দূর নয়...
  কুনাল গোস্বামী 

সেদিন কচি সবুজ ঘাসের উপর শুয়েছিলাম আমি আর আমার কবিতা 
তুমি এলে শান্ত দুপুরের মতো,
দখিনে বাতাসে তখন একমুঠো গন্ধরাজ ফুলের মতো তোমার শরীরের গন্ধ 
সমস্ত যৌনতা কাটিয়ে তোমার এলোকেশী চুল স্পর্শ করলো আমার কবিতা

তোমার রক্তমাংসের শরীরটা সেই কত দূরে,দূরত্বটা সত্যি বলতে অনেক
তাও তোমার বুকে নিজের মাথাটা রাখতে ইচ্ছা করে 
যেমনি রাখে পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্না নদীর উত্তাল বুকে!

তুমি বলো- আমি তো কবি,তাই প্রেমের ভাষাটা আমি নাকি ভালোই জানি
আমি বলি- তুমি ছাড়া প্রেমটা ঠিক মরুভূমির মতো
যেখানে হয়তো প্রাণ আছে, তবে বাঁচার তাগিদে যুদ্ধ হয় সেখানে প্রতিনিয়ত..

কবিতা


যদিও গরাদে...
এইমাত্র আমার পোষা খরগোশগুলোকে ঘাস দিয়ে এলাম। ওরাও জিভে ঘাস বুনতে বুনতে জানিয়ে দিল ভালো আছে
যদিও গরাদে। তবু ওরা পাগল নয়
না হলে নিশ্চিত, ঘাস-খেলাপে জানিয়ে দিত আলো নেই



ফিরে যেতে হয় বলে

গাছকে ভালোবাসো বা,
শিশিরের আশেপাশে
খুঁড়ে দ‍্যাখো তোমার অতীত
ওখানে বসে থেকো
ওখানে বসে থেকো না
স্তব্ধ হয়ে আমার মতো
এ ঠিকানা তোমার নয়
এ ঠিকানা তোমার হবে জেনে’ও
ফিরে এসো
ফিরে যেতে হয় বলে


জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি

কবিতা


র বী ন  ব সু
———————

সোঁদাগন্ধ ও সযত্ন বাঙ্ময়

এই যে প্রাচীন জনপদ       পুরনো সোঁদাগন্ধ
অলৌকিক হাওয়ারা সব কেমন এলোমেলো

হাড়হিম করা রহস্যগল্পের নেপথ্যে অনিবার্য টান
তাকে তুমি সঙ্গোপনে পাশে রাখো

হেঁটে যাও দূরে বিলম্বিত আলাপের প্রান্ত ছুঁয়ে
যে মানবী-স্মৃতি তাকে শিলালিপি ভেবে বোসো না

অক্ষরে অক্ষরে আজ মায়ার শরীর
খননে উৎকর্ষ ওঠে,  উঠে আসে সযত্ন বাঙ্ময়

পবিত্র পাপের মত তাকে যদি ক্ষমা করা যায়
উঠোনজোড়া স্মৃতি অবাক বিস্ময় নিয়ে বসন্তকে
                                              দেখে যায়...

গল্প


অমলের পুনরাগমন ও ছেঁড়া পাল
লেখক – পবিত্র চক্রবর্তী
সবে মাত্র ঝড় থেমেছে । পরিত্যক্ত কোয়াটারের দরজায় এক-দুই-তিন করে প্রথমে অল্প থেমে তারপর বেশ জোরে কয়েকবার কড়া নাড়ার শব্দ হতেই বু’দি খাপ্পা হয়ে বলল , “ দেখ তো কে জ্বালায় ?” এখানে বলে রাখি বু’দি আশির দশকের পাড়া কাঁপানো ডাকাবুকো উঠতি মেয়ে তথা আমাদের যাবতীয় অনুষ্ঠানের মাথা । আমি বরাবরই শান্ত , খানিকটা মেয়েলী-কোমল । কারেন্ট চলে গেছে কিন্তু বু’দি তেড়েফুঁড়ে মোমবাতির আলোয় রিহেরসাল চালিয়ে যাচ্ছে । আমার পার্ট অল্প , কাজ কম । ফলস্‌ লাঙল পাশে রেখে টর্চ হাতে দরজা খুলতেই দেখি পাড়ার শুভেন্দু’দা । কেন জানি না আমাকে অদ্ভুত  চোখে দেখত , তখন অত মানে বোঝার বয়স হয় নি । আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে বলল , “ বু আছে নাকী রে ?” আমি ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাতেই দাদা ইশারা করে ডাকতে বলল। আমি পিছন ফিরতেই দেখি এক ঢাল চুল হাতে পাকিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বু’দি হাজির ।
আমি ঘরের ভিতর যাচ্ছি । কানে এল , “ সেকী রে…আত্মহত্যা ! সুমন্ত এমন কান্ড কী করে করল ? পাড়ায় সবাই জানে ?...”
সময়টা গোবরে পোকামার্কা টেলিফোনের যুগ । আশির দশকের প্রথমার্ধ । বাতাসের গরম হাওয়ার ঝাপটা গায়ে এসে পরলেও উৎসাহের খামতি কখনই পরত না । বরং গায়ে যত বেশী হাওয়া লাগতো তত বেশী আমাদের কল্পনার পাল উঠত ফুলে ফেঁপে । সেবার মনে হয় কেউ গোপনে পালের কাপড়ে টুক করে ছেঁদা করে দিয়েছিল । তাই হাওয়া এপার ওপার যাতায়াত করতে সহজেই পেরেছিল । যাকগে সে কথায় পরে আসি । আমার পূর্বপুরুষ কাঁটাতার পেরনো মানুষ । প্রথম জীবন কলকাতায় কাটালেও পরবর্তীকালে জীবিকা সন্ধানে দুর্গাপুরে হাজির হন । তারপর শাল মহুয়া আমলকী ঘেরা অরণ্যে কাটে কালের প্রবাহ । দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল তখন প্রবাসী মানুষের আশ্রয়স্থল । ভোরের ভোঁ শব্দে জীবনের চাকা চলে মন্থর গতিতে । 
আমার জন্ম যখন হয় তখন দুর্গাপুর বেশ কয়েকটা ঘটনা দেখে ফেলেছে । নকশাল আন্দোলন , মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি । সত্যি বলতে এত কিছুর মাঝেও এই মিশ্র সংস্কৃতির মানুষেরা দিব্যি মানিয়ে উঠে ছিল । বছরে বাঁধাধরা কয়েকটা বাঙালী অনুষ্ঠান হতই । “ হতই” শব্দটা ব্যবহার করার কারণ তখনকার ওই না পাওয়ার মাঝে যেটুকু আনন্দ ছিল এখন কালের প্রবাহে কোথায় গিয়ে পরেছে তার হদিস রাখার মত মানুষ আর তেমন নেই । 
না , ইগো নিয়ে মারামারি আমরা কোন কালেই দেখি নি । আর হলেও যত সম্ভব দ্রুত মিটিয়ে নেওয়াটাই ছিল মুখ্য লক্ষ্য । হ্যাঁ যা বলছিলাম , আমাদের বাঙালীদের অনুষ্ঠানে সে পাঞ্জাবী হোক আর দক্ষিনী হোক মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা ধুতি না হোক কুর্তা-পাঞ্জাবী রীতিমত কিনে পরতো । যেহেতু ইস্পাত কারখানার দাক্ষিণ্যে আমরা বড় হয়েছিলাম তাই টাকার অভাব ছিল না । অভাব ছিল আপনজনদের কাছে পাওয়া । তখন কোলকাতার আত্মীয়দের কাছে দুর্গাপুর বলতে বহুদু…রর । তাই নানা প্রদেশের মানুষেরা ছিল আমাদের নিকট আত্মীয় । আরেকজন ছিল আমাদের সকলের আত্মীয় , তিনি হলেন পোষ্টম্যান কাকু ।
“ ও কাকু আমাদের চিঠি আছে গো …?” এটা ঠিক বেলা একটার সময় বলাটা অভ্যাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছিল । আসত চিঠি তার নিজের সময় মত । খুলে পড়তাম । 
“ স্নেহের অমুক, তোমরা আমার বিজয়ার শুভাশিস নিও …ইতি অমুক ।“ ভরা গ্রীষ্মে শারদের আশীর্বাদ ,হতাস হতাম তখন । এখন বেশ লাগে সেইসব দিনের কথা মনে করতে । 
বাংলা নববর্ষ বেশ জাঁকিয়েই হত । একেই প্রায় অবাঙালী জায়গা তার উপর প্রবাস । আর বাঙালীরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন বাংলার উৎসব সারম্বরেই করে থাকে । তখনও ছিল আজও আছে । কাজের সূত্রে ভারতের নানা প্রান্তরে যাই , এই বাঙালী বাঙালী বিষয়টা বেশ গভীর ভাবেই দেখি । যাইহোক , নববর্ষের দিন সক্কালবেলা আজন্মকালের বাঙালীর প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথের গলায় মালা পড়িয়েই শুরু হত । কেন হত জানি না । আরেকটু বেলা হতেই দূরের কোন চোঙা থেকে ভেসে আসত “ এস হে বৈশাখ এস এস…।”
দাদু বলতেন , “ ওরে রবি ঠাকুর এই গানটা লিখেছেন বাংলা বছরকে আপ্যায়ন করার জন্যই ।“ গভীরে ভাবার অবকাশ তখন সত্যিই কম ছিল । গুরুজন বলেছেন তাহলে তাই । আর তাছাড়া নববর্ষ মানে কতটা রবীন্দ্রনাথ তা নিয়ে বেশী মাথা না ঘামিয়ে বিকেলে নতুন জামাকাপড়ের আঘ্রাণ আকর্ষণ করত অনেকটা বেশী । কখন বিকেল হবে আর কখন দাদুর হাত ধরে যাবো দোকানে দোকানে । নো পড়া আর নো শাসন । আজ যে নতুন বছর ।
রুক্ষ মাটির আঁচলে সুজ্জিমামা ডুব দিতেই আধা নিভু নিভু রোড লাইটের আলোয় দাদু ঠাকুমার হাত ধরে সামনের বিশাল বড় মাঠ পেরিয়ে হাল খাতা করতে যেমন আমি বেরতাম । ঠিক তেমন হুসেন কাকা , লাজপত সিং বা আইয়ার আঙ্কেলের দলও বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে দোকানে দোকানে যেতেন । অবাক হওয়ার বালাই-ই ছিল না । আমার কাছে ওরাও তো বাঙালী ।
এ-কথা স্বীকার্য যে হালখাতার সাথে বাংলা নববর্ষের তেমন কোন ভাইভাই সম্পর্ক নেই । তবুও অন্যান্য অঞ্চলের মত সত্তর-আশীর দশকের দুর্গাপুরের দোকানপাট লক্ষ্মী আর গণেশের পুজোর মাধ্যমে নতুন হিসাবনিকাশের খাতা খুলতো । কয়েকজনকে দেখে সেই সময়ে খুবই ঈর্ষা হত ।
দাদুর কুনুই ধরে বলতাম , “ দাদু সেন কাকিমার ব্যাগ দেখেছো ! এই এত্ত মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার … আমাদের মোটে একটা !” গলায় অভিমানের রেশ বুঝতে পেরে দাদু বলতেন , “ আমারা তো মোটে কয়েকজন , একটা প্যাকেটেই ঠিক তাই না ।“ আসল ব্যাপারটা বেশ বড় হয়ে বুঝেছিলাম । রহস্যটা অন্য জায়গায় । প্রবাসী বাঙালী তার উপর কারখানা নির্ভর জীবনযাত্রা । সূক্ষ্ম অথচ দৃঢ় প্রভেদ ছিল অফিসার আর শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে । অনেকেরই ছিল ধারের খাতা । যার যত ধারের খাতা তার তত মিষ্টির প্যাকেট । মিষ্টি দিয়ে কিছুটা টাকা উশুল করার সুন্দর উপায় আর কী ।
প্রবাস জীবনে ঠাকুর ঠাকুর ব্যাপার , তিথি নক্ষত্র এইসব খুব একটা মেনে চলা যায় না । তাই নববর্ষের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জাঁকিয়ে ও জমিয়ে খাওয়া । সক্কালবেলা আনারুলের দোকানের ১৫ টাকা কেজির খাসীর মাংস কাঁচা শালপাতায় মুড়িয়ে বাবা এনে রাখতেন । উনোন আর গ্যাসের তাপে চড়বড় করে ফুটে ওঠে ভাত । নীচে আসন পেতে বাঙালী পরিবারের দুপুরের বা রাতের আহার করতো পেট পুরে । ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ক্যালভেনেটর ফ্রিজে রাখা থাকতো মিষ্টি । বাড়ীতে অতিথি এলেই সেগুলোর পরিবেশন আর সেই সুযোগে ফ্রিজ দেখানোর মোক্ষম সুযোগ কিছুতেই ছাড়তেন না ঠাকুমা । কথাগুলো এ কারনেই বলছি , এই যে ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া পাওয়া , আনন্দ এগুলো হুস করে বর্তমানে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে । এর কারণ আমাদের সকলেরই জানা যদিও ।
ছোটবেলা থেকে মা বাবাকে তুলনামূলক ভাবে কম পেয়েছি । এখন ভাবতে মন্দ লাগে না সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমি ছাড়া সকলেই চাকরী করতেন আমাদের বাড়ীতে । তখন যদিও ভীষণ ক্ষেপে যেতাম মা’কে কাছে না পেয়ে ।  আমি নাকী ফাঁকা ঘরে নাচ করতাম । বাবা ছিলেন আবার ভলিবল প্লেয়ার । ছেলের এই মেয়েলী স্বভাব মেনে নিতে পারতেন না । কিন্তু ঠাকুমার ছিল প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় । আর সেই প্রশ্রয়ের সুযোগ নিয়ে বু’দি আমাকে রাখতো নববর্ষের পরের দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে । সেবারও রেখেছিল দুটি বিভাগে তিনটি মেয়ের সাথে আমি একা ছেলে ( বালক ) আর রবীন্দ্রনাথের ‘ অমল ও দইওয়ালা ‘ নাটকে । আমার থেকে দাদু ঠাকুমার উৎসাহ বেশী । বাবার আর মুখ খোলার উপায় নেই । মা-ও অপ্রত্যক্ষ ভাবে পাশেই আছেন । আমি হব রবি ঠাকুরের নাটকের গ্রাম্য বালক দলের একজন । কাঁধে কাঠের লাঙল । মেরেকেটে দুটি লাইন ডায়লগ । মুখস্থ বিদ্যা ছোট্ট থেকেই ছিল না বলে লিড রোলে চান্স পেতাম না , সেটা অবশ্য এখন বুঝি ।
পালের কাপড়ে ছেঁদাটা বেশ বড় ছিল সেবার । তাই কাঠের লাঙল আর আমার নাচ আজও মনে মনে দেখি । কষ্ট থেকে হাসি এখন সেই ঘটনায় । বু’দি আমাকে জিজ্ঞাসা করল , “ হ্যাঁ রে কাকু আছে নাকী বাড়ীতে ? এমন করে সুমন্ত চলে গেল আমাদের ছেড়ে !”
আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকলাম । সুমন্ত হচ্ছে আমাদের নাটকের অমল । বেশ বড় বয়েসে । কিন্তু চৌখস ছেলে । যেহেতু কম বয়েসের আর তেমন কেউ ছিল না তাই বু’দি ওকেই একপ্রকার জোর করে বাচ্চা অমলের লিড রোল দেয় । সামনের মাঠে ইতিমধ্যে সাফসুতরো থেকে শুরু করে কাঠের চৌকি সাজিয়ে ষ্টেজ করা হয়ে গেছে । দাদুর সাথে ওইবার হালখাতা সেরে ফিরে এসেই বু’দির তদারকিতে রিহেরসালে লেগে পরেছি । এরই মাঝে সুমন্তদার মৃত্যু । গলায় দড়ি । কিন্তু কেন ? বড় দাদারা ফিসফিস করে কী বেশ বলে – প্রেম , ডিচ্‌ । যত শুনি তত হই অবাক ! প্রেম , ডিচ্‌ এগুলো আবার কী ? 
বু’দির ডান হাত ছিল সুমন্ত’দা । বাঁ হাত শুভেন্দু’দার সাথে পরামর্শ সেরে দিদি ঘোষণা করল বিষণ্ণ মনে “ নাটকের কান্ডারীর অকাল প্রয়ানে এবারে আর অনুষ্ঠান হবে না ।“ মনে মনে রেগে গিয়েছিলাম সুমন্ত’দার উপর । ঠিক হল পরের দিন সকালে পুলিশের কাজকর্ম সারা হলে ফুলের মালা দেওয়া হবে ।
সকাল হল । বাবা আমায় যেতে দিলেন না । যদি ভয়টয় পেয়ে যাই । কেন জানি না ওইদিন মনের থেকে খুব বেপরোয়া হয়ে গেছিলাম । কাউকে না জানিয়ে পিছু নিয়েছিলাম ভাগ্যিস । নইলে ওই ঘটনার সাক্ষী কোনদিনও থাকতে পারতাম না । 
আগে আগে বু’দি , শুভেন্দু’দা আর পিছনে কাকুদের দল । আর তার বেশ পিছনে এই অধম । দেখতে দেখতে সুমন্ত’দার বাড়ীর সামনে সকলে হাজির । হাতে ফুল, মালা । কিন্তু কেমন যেন চুপচাপ পরিবেশ ! অন্য কোন লোক নেই । উঠোনে এক মহিলা ঝাঁটা হাতে , কোমর নীচু করে সারা উঠোন ঝাঁট দিচ্ছেন । বু’দি ওনাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো ।
শোকে কী মানুষ এমনই হয়ে যায় ! চুপচাপ বাবার কোল ঘেঁষে দাঁড়ালাম । বাবা আমাকে দেখেও কিছু বললেন না । এদিকে আমার ছোট্ট ঘিলু কাজ করছে না । বু’দি সাহস নিয়ে আরেকটু এগিয়ে যেতেই ভদ্রমহিলা একগাল হেসে বললেন , “ আরে বু যে । ও সুমন্ত দেখ তোর বু’দি এসেছে …।“
শুভেন্দু’দা বু’দির দিকে বোকার মত চেয়ে আছে । সুমন্ত’দা পাজামার দড়ি কষতে কষতে বাইরে এল । বেশ কিছুক্ষণ পর আমাদের পরম সাহসিনী দিদি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল , “ এই আমরা সব ইয়ে দেখতে মানে তোকে দেখতে এলাম , নাটকের হিরো বলে কথা ।“
বাবার কাছে পরে শুনতে পেলাম , অন্য পাড়ার এক দাদা তাদের নতুন টেলিফোন আসার খুশীতে শুভেন্দু’দাকে ফোন করে জানিয়েছিল , “ শুভেন্দু সুশান্ত আত্মহত্যা করেছে ।“ নেটওয়ার্ক সমস্যায় শুভেন্দু’দা শোনে সুমন্ত’দা মরেছে ।
নাহ কপাল মন্দ । নায়ক বেঁচে উঠলেও সেবার হল না অনুষ্ঠান । মঞ্চ , নায়ক , কলাকুশলী এমন কী দর্শক হাজির , বাধ সাধল আকাশ কালো করা কালবৈশাখী । বছরের নতুন ও প্রথম ঝড় । আগে আদিগন্ত মাঠে তাকালে বৃষ্টি হবে কিনা বলতে পারতাম । এখন হয়ত চোখে পরেছে অনেক পলি । মাঠগুলো উঠেছে ভরে । হয়েছে নানা মাপের ফ্ল্যাট ,হোটেল , ডিস্কো , পাব ।  ফ্ল্যাটের আড়ালে খুঁজি সেই মাঠ , বু’দি , নববর্ষ , হালখাতা আর আমাকে ।

 

















প্রবন্ধ


প্রবন্ধ- পত্রিকা-সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ 
লেখিকা- ডঃ রমলা মুখার্জী 
বৈঁচী, হুগলি 

প্রস্ফুটিত প্রসূণে পূর্ণ 
নন্দনকানন - 
সৌরভে সারা বিশ্বের 
মাতাল তনু-মন।
      রবীন্দ্র প্রতিভার ডালিতে আছে নানা নামী-দামী ফুলের মেলা ।তাই শুধু কাব্য সাহিত্যের জগতেই তিনি অনন্য সাধারণ ছিলেন না, আরও নানা বিষয়ে তিনি তাঁর উজ্বল প্রতিভার দীপ্তি ছড়িয়েছেন ।তিনি যেন সেই পরশপাথর, যা স্পর্শ করতেন তাই সোনা হয়ে উঠত ।তাঁর বহুরত্নখচিত মুকুটের একটি পালক হল পত্রিকা সম্পাদনা ।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পত্রিকা-সম্পাদক রূপেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ।ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য সম্পৃক্ত আবহাওয়ায় বড় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ।ঠাকুরবাড়ির শিশুকিশোরদের সাহিত্য চারাগুলিতে জল সিঞ্চনকরার জন্য ঠাকুর পরিবার থেকে 'বালক' পত্রিকা প্রকাশ করা হত ।এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১২৯২ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিণী জ্ঞানদানন্দিনীর সম্পাদনায় ।রবীন্দ্রনাথ এই 'বালক' পত্রিকার কার্যাধক্ষ্য থাকলেও পত্রিকাটির সব দায়িত্বই তাঁকে নিতে হয়েছিল ।এক বছর স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে এই পত্রিকা চলে এবং পরবর্তীকালে এই পত্রিকা ভারতী পত্রিকার সাথে যুক্ত হয় ।এই এক বছরের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চাশটিরও বেশি লেখা এতে প্রকাশিত হয়েছিল ।এরপর ১২৯৮ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায়
 ও কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক 'হিতবাদী' পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-সম্পাদকরূপে নির্বাচিত হলেন। এই 'হিতবাদী' র হাত ধরেই রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের দ্বার উন্মোচিত হল। উত্তরবঙ্গে জমিদারি দেখাশোনা করার সময় তিনি বাংলা ও বাঙালির অনেক কাছাকাছি আসতে পারেন আর তাই তাদের জীবন ও জীবিকা খুব গভীর ভাবে অনুসন্ধানের সুযোগ পান। ফলস্বরূপ রচিত হল নানা সার্থক ছোট গল্প যা তিনি  ' হিতবাদী' পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। গল্পগুলোর গভীরতা উপলব্ধি হয় তো সব শ্রেণীরপাঠকের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাই হিতবাদীর সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের কাছে হাল্কা কাহিনিমূলক গল্প চাইলেন। রবীন্দ্রনাথ অসন্তুষ্ট হয়ে 'হিতবাদী' ছাড়লেন কারণ তিনি হলেন অতল সমুদ্র। সাগর তাই মুক্তির পথ খুঁজেপেয়েছিল। 
      'সাধনা' পত্রিকাপ্রথমে সুধীন্দ্রনাথ ও পরে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেন।এই পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নতুনত্বের দাবী রাখে।
রবীন্দ্রনাথের 'সাধনা' ‌ আসলে নবজীবনের সাধনা, অগ্রগতির সাধনা। তাই এই পত্রিকার প্রতিটি ষান্মাষিক খন্ডের নামপত্রের উল্টোদিকে ছাপা থাকত -
"আগে চল্ আগে চল্, ভাই।
পড়ে থাকা পিছে, মরে থাকা মিছে,
বেঁচে মরে কি বা ফল ভাই,
আগে চল্ আগে চল, ভাই।"
নানা বিষয়ের নানান লেখা এই 'সাধনা' পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেছিল। গানের স্বরলিপি, দর্শন, ব্রজবুলি, রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথের গদ্য-পদ্য রচনা, অনেক রাজনৈতিক প্রবন্ধ এই পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হতো। গ্রাম্য সাহিত্য, গ্রাম্য ছড়া এই সব লোকরচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগ্রহ করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন আত্মত্যাগী দেশের মানুষকে। সে ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বলেন্দ্র ঠাকুর, উমেশ চন্দ্র বটব্যাল এবং আরও অনেক গুণিজন এবং তাঁরা সবাই 'সাধনা'র সাধনাকে অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।'সাধনা' পত্রিকায় শুধু সাহিত্য নয়, বিভিন্ন বিষয়ের লেখা স্হান পেত। এমনকি বিজ্ঞানের অনেক প্রবন্ধও এখানে প্রকাশিত হত। জগদানন্দ রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু এঁরা 'সাধনা' পত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে বিজ্ঞানের নানা বিষয় সম্বন্ধে মানুষকে অবহিত করতেন।১২৯৮ সাল থেকে ১৩০২ সাল পর্যন্ত সাধনা পত্রিকাটি চলে। স্বাধীনতা লড়াইয়ের প্রাক্কালে মারাঠা বীরদের সম্বন্ধে বাঙালীদের আগ্রহী করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ খুবই সচেষ্ট হয়েছিলেন।তিনি মারাঠা ঐতিহাসিক সখারাম গণেশ দেওস্করকে অনুরোধ করেছিলেন 'সাধনা'
পত্রিকায় লেখা দেওয়ার জন্য।সখারাম রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন এবং মারাঠা ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ পটভূমি রঙে রসে সাজিয়ে বাঙালি পাঠকদের উপহার দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ব্রতে দীক্ষিত হতে সাহস যুগিয়েছিল এইসব মারাঠা বীরদের কাহিনি।
      'সাধনা'র আর একটি নতুন দিগন্ত হল সাহিত্য সমালোচনার ধারা প্রবর্তন। বাংলা সমালোচনার ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি বলা যেতে পারে। প্রথম এই ধারাটি প্রচলিত হয় ১৩০০ সালের 'সাধনা' পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের 'রাজসিংহ' আলোচনার মাধ্যমে। ক্রমশ নানান সাহিত্য সমালোচিত হয় এই পত্রিকায়। নতুন নানা স্বাদের সাহিত্য চিন্তার প্রকাশ আমরা দেখতে পেলাম এই 'সাধনা' পত্রিকায় ।পত্রিকা সম্পাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে যে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না।




প্রবন্ধ


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শেষের কবিতা': প্রেমের এক ভিন্ন প্রেক্ষিত
~বিদিশা নাথ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে আধুনিকতার পথ প্রদর্শক, মানব চরিত্র ও সম্পর্কের তুল্য মূল্য বিচারের অন্যতম কান্ডারী,সমাজ বোধ ও মানবিকতাবোধ এই দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ ভারসাম্যকে আয়না স্বরূপ তুলে ধরার সফলতম কারিগর যাঁর লেখা 'শেষের কবিতা' উপন্যাসটিকে রচনাকালের পাশাপাশি বর্তমান যুগেও সমান তাৎপর্যপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়।
একটি উপন্যাসের ভিত্তিপ্রস্তরের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল তার সময়কাল।'শেষের কবিতা' প্রকাশিত হয় ১৯২৯ এ।ভারতবর্ষে তখন একটি টালমাটালের যুগ চলছে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, স্বরাজ ও বয়কট, বঙ্গভঙ্গ এর পাশাপাশি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের  মুক্ত আদানপ্রদান এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রসার যা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী অন্তঃসার শূন্যতা কে তুলে ধরেছিল আর কিছু প্রাচীন হিন্দু সংস্কারের মুলেও আঘাত করেছিল যার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।এই প্রসঙ্গে শ্রী প্রমথনাথ বিশী বলেন," বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাঙালির নিজের উপর যেন অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করিয়াছে- সম্মুখে ভবিষ্যত অন্ধকার কাজেই কোনো কাজ নাই কিন্তু সেই যুদ্ধ ও নিপুণতা আছে আর এই দুইটা দিয়ে একমাত্র বস্তু কে সে সাধনা করিয়াছে-কি করিয়া কথা বলিতে হয়,কথাই এখন বাঙালির আত্মপ্রকাশের প্রধান উপায়।অমিত রায় সেই বাংলাদেশের লোক।"
'শেষের কবিতা উপন্যাস টিতে সতেরোটি পরিচ্ছেদ আছে এবং প্রত্যেকটির আলাদা নাম রয়েছে যেমন প্রথম টি হল 'অমিত-চরিত'।উপন্যাসটির নায়ক অমিত যে একজন"বেহিসেবি,উড়নচন্ডী,বান ডেকে ছুটে চলেছে বাইরের দিকে-সমস্ত নিয়ে চলেছে ভাসিয়ে ,হাতে কিছুই রাখে না।" এরপর চতুর্থ অধ্যায় 'লাবণ্য পুরাবৃত্ত'-এ আমরা দেখতে পাই লাবণ্য-র,উপন্যাসের নায়িকার। সে মাতৃহারা,আধুনিকতা ,আত্মসম্মান ও স্বনির্ভরতা যার রক্তে, যে রোম্যান্টিক কিন্তু বিচক্ষণ ,আত্মবিস্মৃত নয়। পঞ্চম অধ্যায় 'আলাপের আরম্ভ'তে এ নায়ক ও নায়িকার আলাপ হয়। যেখানে অমিত লাবণ্যকে বর্ননা করে সকালবেলার দীপ্ত সৌন্দর্য রূপে এবং শান্তি রূপে যা "বিবেচনা শক্তির গভীরতায় অচঞ্চল।"লাবণ্যের প্রেমের স্বরুপ বোঝা যায় অষ্টম অধ্যায়-' লাবণ্য তর্কে' যেখানে সে জানায় সে অমিতের প্রেমে নবজন্ম লাভ করেছে, অমিত কে বিয়ে করে সে প্রেম সে নষ্ট করতে চায় না তার চেয়ে সে অমিতের স্বপ্ন হয়ে থাকতে চায়।একাদশ পরিচ্ছেদ থেকে প্রেমের অন্তিমপর্ব শুরু হয় যখন লাবণ্যের 'আশঙ্কা' সত্যি করে চতুর্দশ পরিচ্ছেদে 'ধূমকেতু'তে ধূমকেতুর মতোই আবির্ভাব ঘটে অমিতের বোন সিসি-র বন্ধু কেটি বা কেতকী মিত্র যে কিনা লাবণ্যের ভাষায় অমিতের 'অনাদরে গড়া', প্রাণচঞ্চলতা, ইঙ্গবঙ্গ অনুকরণসর্বস্বতার প্রতিমূর্তি। যাকে অমিত বহু আগে আংটি পরিয়ে ছিল ঠিক লাবণ্যের মতোই।এরপর  ঘটনাপ্রবাহ যেখানে পৌঁছয় আমরা দেখতে পাই  ষোড়শ পরিচ্ছেদ 'মুক্তি' তে যেখানে লাবণ্য অমিতের পরানো আংটি খুলে দেয় আর বলে," আমার প্রেম থাক নিরঞ্জন-বাইরের রেখা,বাইরের ছায়া তাতে পড়বে না।"
'শেষের কবিতা ভালোবাসার দুটি রূপ ব্যক্ত করে,"যে ভালোবাসা ব্যপ্ত ভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ;যে ভালোবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সব কিছুতে যুক্ত হয়ে থাকে সংসারে সে দেয় আসঙ্গ।দুটোই আমি চাই।"অমিত এই ভাবেই লাবণ্যের মধ্যে পায় আকাশ আর কেটির মধ্যে বাসা।
এই উপন্যাস শুধু প্রেমের নকশিকাঁথা বুনন করে তা নয় এতে রয়েছে বাস্তবতার অবারিত প্রতিফলন  কারণ এই উপন্যাস দেখায় নারী স্বাধীনতার জয়জয়কার। সে স্বাধীনতা শুধু  আর্থিক না,আত্মিক ও। রবীন্দ্রনাথ নর-নারী সম্পর্ক সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেন,"the union of man and woman will all represent a perfect co operation in building up a human history on equal terms in each department of life" যার পূর্ন সহমত দেখা যায় এই উপন্যাসে।তাই এখানে তাঁর নায়িকা নায়কের তাকে গ্রহণের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না,সে অতি সহজেই বলে চলে যেতে পারে,"তোমার সঙ্গে আমার যে অন্তরের সম্বন্ধ তা নিয়ে তোমার লেশমাত্র দায় নেই।"
শেষের কবিতা তে অমিত প্রেমের এক নব্য দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে যা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। প্রেম হয় নানা স্তরের ,নানা প্রেক্ষিতের তাই অমিত লাবণ্যের  প্রতি তার প্রেম কে দীঘির জলের সাথে তুলনা করে যা বারবার ব্যবহারের নয় যে শুধু তার মনের সাঁতার কাটার জন্য আর কেটির প্রেম হল 'ঘড়ার তোলা জল' যা বারবার তুলে বারবার ব্যবহার করা যায়। এ যেন রবীন্দ্রনাথ-এর প্রেমের প্রতি একান্ত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি।কিছু প্রেম কে সাংসারিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্ষেত্রে বেঁধে ফেলে নষ্ট করতে নেই তাকে তার নিজস্ব বৈচিত্র ও দূর্জ্ঞেয়তা নিয়ে থাকতে দিতে হয়।আর কিছু প্রেমে মেশে একনিষ্ঠতা আর ব্যবহারিকতার খাদ যা সংসারের বেচাকেনার বাজারে মুদ্রার তুল্য ধরা হয়।
উপনিষদের তত্ত্ব অনুযায়ী তাই রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন প্রেম ব্যবহারের ক্লিস্টতা পেরিয়ে আপন করুক ত্যাগের আদর্শ। তাই এই উপন্যাসের শেষ অধ্যায় 'শেষের কবিতা'-য় লাবণ্যের শেষ সম্ভাষণ যেন ঋনীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার যখন শেষ একটি পত্রে বিদায় জানায় এই বলে-
"তোমারে যা দিয়েছি সে তোমারি দান গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়।"

গল্প


নববর্ষের সেকাল -একাল

সেকাল নিয়ে বলতে গেলে আমার ছোটোবেলা, মানে নব্বইয়ের দশকের কথা মনে পড়ে। আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা সবটাই বীরভূমের সিউড়িতে। জ্ঞান হয়ে থেকেই দেখতাম, সেদিনটা বছরের অন্যান্য দিনগুলির চেয়ে অনেকটাই আলাদা। সকাল সকাল স্নান করেই একটা নতুন ফ্রক পেতাম। সেটা পড়েই কাছের কোনো মন্দিরে যেতাম মমা-বাবার সাথে পুজো দিতে। তারপর জলখাবারে লুচি, আলুর দম আর মিষ্টি। দুপুরে ভাত, ডাল, সবজি, মাছ, চাটনি,দই। এইদিন থেকে প্রথম আমাদের বাড়িতে কাঁচা আম খাওয়া শুরু হতো। সারা দিনটা বেশ আনন্দের সঙ্গে কাটতো। তারপর বিকেলে বাবা,মা,আমি আর ভাই, চারজন মিলেই বেরোতাম দোকানে দোকানে হালখাতা করতে। কতগুলো যে মিষ্টির প্যাকেট হতো! ওই প্যাকেটের ভিতর মিষ্টির সঙ্গে গুটকা কচুরি থাকতো, ওটা খেতে খুবই পছন্দ করতাম আমি। বাড়ি ফেরার আগে বাবা আমাদেরকে আইসক্রিম বা কোনো ঠাণ্ডা পানীয় খাওয়াতেন। কি যে ভালো কাটতো দিন টা!

এখন নববর্ষের জাঁকজমক বেড়েছে। চৈত্রের প্রথম থেকেই জামাকাপড়ের দোকান গুলোতে সেল শুরু হয়। সেল চলে বড় বড় মল গুলোতেও। মানুষের কেনাকাটাও বেড়েছে। আড়ম্বর বেড়েছে দোকানগুলোতেও। হালখাতার প্যাকেট গুলোতেও লেগেছে আভিজাত্যের ছোঁয়া। মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি মাতোয়ারা হয় এই দিনটিতে। খাদ্যাভ্যাস  এবং জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সমঞ্জস্য রেখে, খাদ্যতালিকারও বদল হয়েছে।
 সাহিত্য জগতেও এই দিনটির গুরুত্ব এখন অপরিসীম। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় । প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গল্প ও কাব্য গ্রন্থও। টিভির বিভিন্ন চ্যানেলগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান চলে দিনভর। সর্বোপরি এই দিনটির গুরুত্ব উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বাঙালি হিসাবে সত্যিই গর্ববোধ করি আমাদের এমন একটা রীতির জন্য।
সব্বার জন্য শুভ নববর্ষের একরাশ শুভেচ্ছা রইলো। ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।
       
কলমেঃ-পাপিয়া মণ্ডল।
//নারীকে নারী বলেই সন্মান দিও..//

এইতো সেদিন ভিড়ের মাঝে আঁকড়ে ধরতে যাকে,
হঠাৎ কেন, কিসের ভুলে পর করলে তাকে?
নিশ্বাসে যার ঘুম আসত, বালিশ ভিজতো আবেগে,
এখন কেন সারাটা রাত কাটাও তুমি একলা জেগে?
যে দুটি হাত পরস্পর ছুঁতো তাদের আঙুলখানি,
আজকে প্রেমে হঠাৎ করে কিসের এত রাহাজানি?
একদিন তো ভালো বেসেই করেছিলে অনেক শপথ,
কিসের এত তাড়ার ছলে পাল্টে নিলে পুরানো পথ?
আজকে তাকে প্রেমিকা বলে পরিচয় দিতে সত্যি বাঁধে?
এদ্দিন তো রূপে-গুনে মুগ্ধ হয়ে, ডুবে ছিলে তারই স্বাদে।
"ভালোবাসা" অনুভূতি, "ভালোবাসা"য় সব ছিল,
আজকে দেখো রিয়েলিটি কত কিছু বদলে দিল।
যে "তুমি" টা ভীষণ চেনা, আজকে কেমন পাল্টি খেলে,
ভাবো তো,
আমিও যদি পাল্টে যেতাম, তোমার সাথে এমন হলে!!
আমায় নিয়ে চললে পথে শুনতে হবে অনেক কথা,
তাই তো তোমার পুরুষ সাজে আজ সেজেছে নীরবতা।
কোথায় ছিল সমাজ জ্ঞান? কোথায় তখন পরিবার?
যখন তুমি আমার সাথে মুহূর্তদের করতে পার।
আসলে কি বলোতো,
যার কাঁধে মাথা রেখে কাটত তোমার দিন,
সেই মেয়েটা অন্যরকম, নির্ভেজাল ভার্জিন।
তার বদলে ধর্ষিতা?
ভাবনি কখনো এমন হবে! তাই তো ঝুড়িঝুড়ি প্রতিশ্রুতি,
আগে যদি জানতে, তবে বাহানায় কবেই ঘটে যেত বিচ্যুতি।
আমিও আজ সত্যি জানলাম,
ভালোবাসা আর সম্পর্কের তফাৎ
সব চেয়ে বড়ো বেইমান বুঝেছি
বিশ্বাসের সেই দুটি হাত।
আচ্ছা, তোমার বোনের সাথেও এমন হলে?
বলছি না হবেই, তবে হতেও তো পারতো,
মেনে নিতে কেমন করে?
যখন সমাজ, প্রতিবেশী তাকেও পিষে পিষে মারতো?
সব নিয়মই বদলে যায় নিজের নিজের স্বার্থে,
হয়তো অন্য পরিকল্পনা ফিক্সড হয়েছে আমার পরিবর্তে।
তবে কি জানো তো, সময় সব ফিরিয়ে দেয়,
আগে হোক বা পরে,
যাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছো,
হয়তো সেও রেখেছে অন্ধকারে।
হঠাৎ যদি জানতে পারো, তারও একজন এক্স ছিল,
আর গভীর ছিল সম্পর্ক তাদেরও,
সেদিনও তাকে ডিভোর্স দিয়ে
সমাজ সেবার আরও একধাপ পদ না হয় এগিও,
আজকে যাকে ত্যাগ করলে,
তার যোগ্য তুমি নও,
মাথা তুলে কজনে বা বলতে পারে নিজের কথা?
একদিন সে এঞ্জেল হবেই লিখবে নিজের রূপকথা।
সেদিন না হয় কষ্ট করে একবারটি পড়ে নিও,
প্রেমিকা নয়, স্ত্রী নয়, বোন নয়,
শুধু নারীকে নারী বলেই সন্মান দিও...

                                        _শিল্পা মণ্ডল