লেখক – পবিত্র চক্রবর্তী
সবে মাত্র ঝড় থেমেছে । পরিত্যক্ত কোয়াটারের দরজায় এক-দুই-তিন করে প্রথমে অল্প থেমে তারপর বেশ জোরে কয়েকবার কড়া নাড়ার শব্দ হতেই বু’দি খাপ্পা হয়ে বলল , “ দেখ তো কে জ্বালায় ?” এখানে বলে রাখি বু’দি আশির দশকের পাড়া কাঁপানো ডাকাবুকো উঠতি মেয়ে তথা আমাদের যাবতীয় অনুষ্ঠানের মাথা । আমি বরাবরই শান্ত , খানিকটা মেয়েলী-কোমল । কারেন্ট চলে গেছে কিন্তু বু’দি তেড়েফুঁড়ে মোমবাতির আলোয় রিহেরসাল চালিয়ে যাচ্ছে । আমার পার্ট অল্প , কাজ কম । ফলস্ লাঙল পাশে রেখে টর্চ হাতে দরজা খুলতেই দেখি পাড়ার শুভেন্দু’দা । কেন জানি না আমাকে অদ্ভুত চোখে দেখত , তখন অত মানে বোঝার বয়স হয় নি । আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে বলল , “ বু আছে নাকী রে ?” আমি ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাতেই দাদা ইশারা করে ডাকতে বলল। আমি পিছন ফিরতেই দেখি এক ঢাল চুল হাতে পাকিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বু’দি হাজির ।
আমি ঘরের ভিতর যাচ্ছি । কানে এল , “ সেকী রে…আত্মহত্যা ! সুমন্ত এমন কান্ড কী করে করল ? পাড়ায় সবাই জানে ?...”
সময়টা গোবরে পোকামার্কা টেলিফোনের যুগ । আশির দশকের প্রথমার্ধ । বাতাসের গরম হাওয়ার ঝাপটা গায়ে এসে পরলেও উৎসাহের খামতি কখনই পরত না । বরং গায়ে যত বেশী হাওয়া লাগতো তত বেশী আমাদের কল্পনার পাল উঠত ফুলে ফেঁপে । সেবার মনে হয় কেউ গোপনে পালের কাপড়ে টুক করে ছেঁদা করে দিয়েছিল । তাই হাওয়া এপার ওপার যাতায়াত করতে সহজেই পেরেছিল । যাকগে সে কথায় পরে আসি । আমার পূর্বপুরুষ কাঁটাতার পেরনো মানুষ । প্রথম জীবন কলকাতায় কাটালেও পরবর্তীকালে জীবিকা সন্ধানে দুর্গাপুরে হাজির হন । তারপর শাল মহুয়া আমলকী ঘেরা অরণ্যে কাটে কালের প্রবাহ । দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল তখন প্রবাসী মানুষের আশ্রয়স্থল । ভোরের ভোঁ শব্দে জীবনের চাকা চলে মন্থর গতিতে ।
আমার জন্ম যখন হয় তখন দুর্গাপুর বেশ কয়েকটা ঘটনা দেখে ফেলেছে । নকশাল আন্দোলন , মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি । সত্যি বলতে এত কিছুর মাঝেও এই মিশ্র সংস্কৃতির মানুষেরা দিব্যি মানিয়ে উঠে ছিল । বছরে বাঁধাধরা কয়েকটা বাঙালী অনুষ্ঠান হতই । “ হতই” শব্দটা ব্যবহার করার কারণ তখনকার ওই না পাওয়ার মাঝে যেটুকু আনন্দ ছিল এখন কালের প্রবাহে কোথায় গিয়ে পরেছে তার হদিস রাখার মত মানুষ আর তেমন নেই ।
না , ইগো নিয়ে মারামারি আমরা কোন কালেই দেখি নি । আর হলেও যত সম্ভব দ্রুত মিটিয়ে নেওয়াটাই ছিল মুখ্য লক্ষ্য । হ্যাঁ যা বলছিলাম , আমাদের বাঙালীদের অনুষ্ঠানে সে পাঞ্জাবী হোক আর দক্ষিনী হোক মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা ধুতি না হোক কুর্তা-পাঞ্জাবী রীতিমত কিনে পরতো । যেহেতু ইস্পাত কারখানার দাক্ষিণ্যে আমরা বড় হয়েছিলাম তাই টাকার অভাব ছিল না । অভাব ছিল আপনজনদের কাছে পাওয়া । তখন কোলকাতার আত্মীয়দের কাছে দুর্গাপুর বলতে বহুদু…রর । তাই নানা প্রদেশের মানুষেরা ছিল আমাদের নিকট আত্মীয় । আরেকজন ছিল আমাদের সকলের আত্মীয় , তিনি হলেন পোষ্টম্যান কাকু ।
“ ও কাকু আমাদের চিঠি আছে গো …?” এটা ঠিক বেলা একটার সময় বলাটা অভ্যাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছিল । আসত চিঠি তার নিজের সময় মত । খুলে পড়তাম ।
“ স্নেহের অমুক, তোমরা আমার বিজয়ার শুভাশিস নিও …ইতি অমুক ।“ ভরা গ্রীষ্মে শারদের আশীর্বাদ ,হতাস হতাম তখন । এখন বেশ লাগে সেইসব দিনের কথা মনে করতে ।
বাংলা নববর্ষ বেশ জাঁকিয়েই হত । একেই প্রায় অবাঙালী জায়গা তার উপর প্রবাস । আর বাঙালীরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন বাংলার উৎসব সারম্বরেই করে থাকে । তখনও ছিল আজও আছে । কাজের সূত্রে ভারতের নানা প্রান্তরে যাই , এই বাঙালী বাঙালী বিষয়টা বেশ গভীর ভাবেই দেখি । যাইহোক , নববর্ষের দিন সক্কালবেলা আজন্মকালের বাঙালীর প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথের গলায় মালা পড়িয়েই শুরু হত । কেন হত জানি না । আরেকটু বেলা হতেই দূরের কোন চোঙা থেকে ভেসে আসত “ এস হে বৈশাখ এস এস…।”
দাদু বলতেন , “ ওরে রবি ঠাকুর এই গানটা লিখেছেন বাংলা বছরকে আপ্যায়ন করার জন্যই ।“ গভীরে ভাবার অবকাশ তখন সত্যিই কম ছিল । গুরুজন বলেছেন তাহলে তাই । আর তাছাড়া নববর্ষ মানে কতটা রবীন্দ্রনাথ তা নিয়ে বেশী মাথা না ঘামিয়ে বিকেলে নতুন জামাকাপড়ের আঘ্রাণ আকর্ষণ করত অনেকটা বেশী । কখন বিকেল হবে আর কখন দাদুর হাত ধরে যাবো দোকানে দোকানে । নো পড়া আর নো শাসন । আজ যে নতুন বছর ।
২
রুক্ষ মাটির আঁচলে সুজ্জিমামা ডুব দিতেই আধা নিভু নিভু রোড লাইটের আলোয় দাদু ঠাকুমার হাত ধরে সামনের বিশাল বড় মাঠ পেরিয়ে হাল খাতা করতে যেমন আমি বেরতাম । ঠিক তেমন হুসেন কাকা , লাজপত সিং বা আইয়ার আঙ্কেলের দলও বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে দোকানে দোকানে যেতেন । অবাক হওয়ার বালাই-ই ছিল না । আমার কাছে ওরাও তো বাঙালী ।
এ-কথা স্বীকার্য যে হালখাতার সাথে বাংলা নববর্ষের তেমন কোন ভাইভাই সম্পর্ক নেই । তবুও অন্যান্য অঞ্চলের মত সত্তর-আশীর দশকের দুর্গাপুরের দোকানপাট লক্ষ্মী আর গণেশের পুজোর মাধ্যমে নতুন হিসাবনিকাশের খাতা খুলতো । কয়েকজনকে দেখে সেই সময়ে খুবই ঈর্ষা হত ।
দাদুর কুনুই ধরে বলতাম , “ দাদু সেন কাকিমার ব্যাগ দেখেছো ! এই এত্ত মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার … আমাদের মোটে একটা !” গলায় অভিমানের রেশ বুঝতে পেরে দাদু বলতেন , “ আমারা তো মোটে কয়েকজন , একটা প্যাকেটেই ঠিক তাই না ।“ আসল ব্যাপারটা বেশ বড় হয়ে বুঝেছিলাম । রহস্যটা অন্য জায়গায় । প্রবাসী বাঙালী তার উপর কারখানা নির্ভর জীবনযাত্রা । সূক্ষ্ম অথচ দৃঢ় প্রভেদ ছিল অফিসার আর শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে । অনেকেরই ছিল ধারের খাতা । যার যত ধারের খাতা তার তত মিষ্টির প্যাকেট । মিষ্টি দিয়ে কিছুটা টাকা উশুল করার সুন্দর উপায় আর কী ।
প্রবাস জীবনে ঠাকুর ঠাকুর ব্যাপার , তিথি নক্ষত্র এইসব খুব একটা মেনে চলা যায় না । তাই নববর্ষের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জাঁকিয়ে ও জমিয়ে খাওয়া । সক্কালবেলা আনারুলের দোকানের ১৫ টাকা কেজির খাসীর মাংস কাঁচা শালপাতায় মুড়িয়ে বাবা এনে রাখতেন । উনোন আর গ্যাসের তাপে চড়বড় করে ফুটে ওঠে ভাত । নীচে আসন পেতে বাঙালী পরিবারের দুপুরের বা রাতের আহার করতো পেট পুরে । ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ক্যালভেনেটর ফ্রিজে রাখা থাকতো মিষ্টি । বাড়ীতে অতিথি এলেই সেগুলোর পরিবেশন আর সেই সুযোগে ফ্রিজ দেখানোর মোক্ষম সুযোগ কিছুতেই ছাড়তেন না ঠাকুমা । কথাগুলো এ কারনেই বলছি , এই যে ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া পাওয়া , আনন্দ এগুলো হুস করে বর্তমানে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে । এর কারণ আমাদের সকলেরই জানা যদিও ।
ছোটবেলা থেকে মা বাবাকে তুলনামূলক ভাবে কম পেয়েছি । এখন ভাবতে মন্দ লাগে না সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমি ছাড়া সকলেই চাকরী করতেন আমাদের বাড়ীতে । তখন যদিও ভীষণ ক্ষেপে যেতাম মা’কে কাছে না পেয়ে । আমি নাকী ফাঁকা ঘরে নাচ করতাম । বাবা ছিলেন আবার ভলিবল প্লেয়ার । ছেলের এই মেয়েলী স্বভাব মেনে নিতে পারতেন না । কিন্তু ঠাকুমার ছিল প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় । আর সেই প্রশ্রয়ের সুযোগ নিয়ে বু’দি আমাকে রাখতো নববর্ষের পরের দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে । সেবারও রেখেছিল দুটি বিভাগে তিনটি মেয়ের সাথে আমি একা ছেলে ( বালক ) আর রবীন্দ্রনাথের ‘ অমল ও দইওয়ালা ‘ নাটকে । আমার থেকে দাদু ঠাকুমার উৎসাহ বেশী । বাবার আর মুখ খোলার উপায় নেই । মা-ও অপ্রত্যক্ষ ভাবে পাশেই আছেন । আমি হব রবি ঠাকুরের নাটকের গ্রাম্য বালক দলের একজন । কাঁধে কাঠের লাঙল । মেরেকেটে দুটি লাইন ডায়লগ । মুখস্থ বিদ্যা ছোট্ট থেকেই ছিল না বলে লিড রোলে চান্স পেতাম না , সেটা অবশ্য এখন বুঝি ।
৩
পালের কাপড়ে ছেঁদাটা বেশ বড় ছিল সেবার । তাই কাঠের লাঙল আর আমার নাচ আজও মনে মনে দেখি । কষ্ট থেকে হাসি এখন সেই ঘটনায় । বু’দি আমাকে জিজ্ঞাসা করল , “ হ্যাঁ রে কাকু আছে নাকী বাড়ীতে ? এমন করে সুমন্ত চলে গেল আমাদের ছেড়ে !”
আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকলাম । সুমন্ত হচ্ছে আমাদের নাটকের অমল । বেশ বড় বয়েসে । কিন্তু চৌখস ছেলে । যেহেতু কম বয়েসের আর তেমন কেউ ছিল না তাই বু’দি ওকেই একপ্রকার জোর করে বাচ্চা অমলের লিড রোল দেয় । সামনের মাঠে ইতিমধ্যে সাফসুতরো থেকে শুরু করে কাঠের চৌকি সাজিয়ে ষ্টেজ করা হয়ে গেছে । দাদুর সাথে ওইবার হালখাতা সেরে ফিরে এসেই বু’দির তদারকিতে রিহেরসালে লেগে পরেছি । এরই মাঝে সুমন্তদার মৃত্যু । গলায় দড়ি । কিন্তু কেন ? বড় দাদারা ফিসফিস করে কী বেশ বলে – প্রেম , ডিচ্ । যত শুনি তত হই অবাক ! প্রেম , ডিচ্ এগুলো আবার কী ?
বু’দির ডান হাত ছিল সুমন্ত’দা । বাঁ হাত শুভেন্দু’দার সাথে পরামর্শ সেরে দিদি ঘোষণা করল বিষণ্ণ মনে “ নাটকের কান্ডারীর অকাল প্রয়ানে এবারে আর অনুষ্ঠান হবে না ।“ মনে মনে রেগে গিয়েছিলাম সুমন্ত’দার উপর । ঠিক হল পরের দিন সকালে পুলিশের কাজকর্ম সারা হলে ফুলের মালা দেওয়া হবে ।
সকাল হল । বাবা আমায় যেতে দিলেন না । যদি ভয়টয় পেয়ে যাই । কেন জানি না ওইদিন মনের থেকে খুব বেপরোয়া হয়ে গেছিলাম । কাউকে না জানিয়ে পিছু নিয়েছিলাম ভাগ্যিস । নইলে ওই ঘটনার সাক্ষী কোনদিনও থাকতে পারতাম না ।
আগে আগে বু’দি , শুভেন্দু’দা আর পিছনে কাকুদের দল । আর তার বেশ পিছনে এই অধম । দেখতে দেখতে সুমন্ত’দার বাড়ীর সামনে সকলে হাজির । হাতে ফুল, মালা । কিন্তু কেমন যেন চুপচাপ পরিবেশ ! অন্য কোন লোক নেই । উঠোনে এক মহিলা ঝাঁটা হাতে , কোমর নীচু করে সারা উঠোন ঝাঁট দিচ্ছেন । বু’দি ওনাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো ।
শোকে কী মানুষ এমনই হয়ে যায় ! চুপচাপ বাবার কোল ঘেঁষে দাঁড়ালাম । বাবা আমাকে দেখেও কিছু বললেন না । এদিকে আমার ছোট্ট ঘিলু কাজ করছে না । বু’দি সাহস নিয়ে আরেকটু এগিয়ে যেতেই ভদ্রমহিলা একগাল হেসে বললেন , “ আরে বু যে । ও সুমন্ত দেখ তোর বু’দি এসেছে …।“
শুভেন্দু’দা বু’দির দিকে বোকার মত চেয়ে আছে । সুমন্ত’দা পাজামার দড়ি কষতে কষতে বাইরে এল । বেশ কিছুক্ষণ পর আমাদের পরম সাহসিনী দিদি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল , “ এই আমরা সব ইয়ে দেখতে মানে তোকে দেখতে এলাম , নাটকের হিরো বলে কথা ।“
বাবার কাছে পরে শুনতে পেলাম , অন্য পাড়ার এক দাদা তাদের নতুন টেলিফোন আসার খুশীতে শুভেন্দু’দাকে ফোন করে জানিয়েছিল , “ শুভেন্দু সুশান্ত আত্মহত্যা করেছে ।“ নেটওয়ার্ক সমস্যায় শুভেন্দু’দা শোনে সুমন্ত’দা মরেছে ।
নাহ কপাল মন্দ । নায়ক বেঁচে উঠলেও সেবার হল না অনুষ্ঠান । মঞ্চ , নায়ক , কলাকুশলী এমন কী দর্শক হাজির , বাধ সাধল আকাশ কালো করা কালবৈশাখী । বছরের নতুন ও প্রথম ঝড় । আগে আদিগন্ত মাঠে তাকালে বৃষ্টি হবে কিনা বলতে পারতাম । এখন হয়ত চোখে পরেছে অনেক পলি । মাঠগুলো উঠেছে ভরে । হয়েছে নানা মাপের ফ্ল্যাট ,হোটেল , ডিস্কো , পাব । ফ্ল্যাটের আড়ালে খুঁজি সেই মাঠ , বু’দি , নববর্ষ , হালখাতা আর আমাকে ।