ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯

প্রবন্ধ


প্রবন্ধ- পত্রিকা-সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ 
লেখিকা- ডঃ রমলা মুখার্জী 
বৈঁচী, হুগলি 

প্রস্ফুটিত প্রসূণে পূর্ণ 
নন্দনকানন - 
সৌরভে সারা বিশ্বের 
মাতাল তনু-মন।
      রবীন্দ্র প্রতিভার ডালিতে আছে নানা নামী-দামী ফুলের মেলা ।তাই শুধু কাব্য সাহিত্যের জগতেই তিনি অনন্য সাধারণ ছিলেন না, আরও নানা বিষয়ে তিনি তাঁর উজ্বল প্রতিভার দীপ্তি ছড়িয়েছেন ।তিনি যেন সেই পরশপাথর, যা স্পর্শ করতেন তাই সোনা হয়ে উঠত ।তাঁর বহুরত্নখচিত মুকুটের একটি পালক হল পত্রিকা সম্পাদনা ।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পত্রিকা-সম্পাদক রূপেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ।ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য সম্পৃক্ত আবহাওয়ায় বড় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ।ঠাকুরবাড়ির শিশুকিশোরদের সাহিত্য চারাগুলিতে জল সিঞ্চনকরার জন্য ঠাকুর পরিবার থেকে 'বালক' পত্রিকা প্রকাশ করা হত ।এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১২৯২ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিণী জ্ঞানদানন্দিনীর সম্পাদনায় ।রবীন্দ্রনাথ এই 'বালক' পত্রিকার কার্যাধক্ষ্য থাকলেও পত্রিকাটির সব দায়িত্বই তাঁকে নিতে হয়েছিল ।এক বছর স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে এই পত্রিকা চলে এবং পরবর্তীকালে এই পত্রিকা ভারতী পত্রিকার সাথে যুক্ত হয় ।এই এক বছরের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চাশটিরও বেশি লেখা এতে প্রকাশিত হয়েছিল ।এরপর ১২৯৮ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায়
 ও কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক 'হিতবাদী' পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-সম্পাদকরূপে নির্বাচিত হলেন। এই 'হিতবাদী' র হাত ধরেই রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের দ্বার উন্মোচিত হল। উত্তরবঙ্গে জমিদারি দেখাশোনা করার সময় তিনি বাংলা ও বাঙালির অনেক কাছাকাছি আসতে পারেন আর তাই তাদের জীবন ও জীবিকা খুব গভীর ভাবে অনুসন্ধানের সুযোগ পান। ফলস্বরূপ রচিত হল নানা সার্থক ছোট গল্প যা তিনি  ' হিতবাদী' পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। গল্পগুলোর গভীরতা উপলব্ধি হয় তো সব শ্রেণীরপাঠকের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাই হিতবাদীর সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের কাছে হাল্কা কাহিনিমূলক গল্প চাইলেন। রবীন্দ্রনাথ অসন্তুষ্ট হয়ে 'হিতবাদী' ছাড়লেন কারণ তিনি হলেন অতল সমুদ্র। সাগর তাই মুক্তির পথ খুঁজেপেয়েছিল। 
      'সাধনা' পত্রিকাপ্রথমে সুধীন্দ্রনাথ ও পরে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেন।এই পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নতুনত্বের দাবী রাখে।
রবীন্দ্রনাথের 'সাধনা' ‌ আসলে নবজীবনের সাধনা, অগ্রগতির সাধনা। তাই এই পত্রিকার প্রতিটি ষান্মাষিক খন্ডের নামপত্রের উল্টোদিকে ছাপা থাকত -
"আগে চল্ আগে চল্, ভাই।
পড়ে থাকা পিছে, মরে থাকা মিছে,
বেঁচে মরে কি বা ফল ভাই,
আগে চল্ আগে চল, ভাই।"
নানা বিষয়ের নানান লেখা এই 'সাধনা' পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেছিল। গানের স্বরলিপি, দর্শন, ব্রজবুলি, রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথের গদ্য-পদ্য রচনা, অনেক রাজনৈতিক প্রবন্ধ এই পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হতো। গ্রাম্য সাহিত্য, গ্রাম্য ছড়া এই সব লোকরচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগ্রহ করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন আত্মত্যাগী দেশের মানুষকে। সে ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বলেন্দ্র ঠাকুর, উমেশ চন্দ্র বটব্যাল এবং আরও অনেক গুণিজন এবং তাঁরা সবাই 'সাধনা'র সাধনাকে অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।'সাধনা' পত্রিকায় শুধু সাহিত্য নয়, বিভিন্ন বিষয়ের লেখা স্হান পেত। এমনকি বিজ্ঞানের অনেক প্রবন্ধও এখানে প্রকাশিত হত। জগদানন্দ রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু এঁরা 'সাধনা' পত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে বিজ্ঞানের নানা বিষয় সম্বন্ধে মানুষকে অবহিত করতেন।১২৯৮ সাল থেকে ১৩০২ সাল পর্যন্ত সাধনা পত্রিকাটি চলে। স্বাধীনতা লড়াইয়ের প্রাক্কালে মারাঠা বীরদের সম্বন্ধে বাঙালীদের আগ্রহী করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ খুবই সচেষ্ট হয়েছিলেন।তিনি মারাঠা ঐতিহাসিক সখারাম গণেশ দেওস্করকে অনুরোধ করেছিলেন 'সাধনা'
পত্রিকায় লেখা দেওয়ার জন্য।সখারাম রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন এবং মারাঠা ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ পটভূমি রঙে রসে সাজিয়ে বাঙালি পাঠকদের উপহার দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ব্রতে দীক্ষিত হতে সাহস যুগিয়েছিল এইসব মারাঠা বীরদের কাহিনি।
      'সাধনা'র আর একটি নতুন দিগন্ত হল সাহিত্য সমালোচনার ধারা প্রবর্তন। বাংলা সমালোচনার ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি বলা যেতে পারে। প্রথম এই ধারাটি প্রচলিত হয় ১৩০০ সালের 'সাধনা' পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের 'রাজসিংহ' আলোচনার মাধ্যমে। ক্রমশ নানান সাহিত্য সমালোচিত হয় এই পত্রিকায়। নতুন নানা স্বাদের সাহিত্য চিন্তার প্রকাশ আমরা দেখতে পেলাম এই 'সাধনা' পত্রিকায় ।পত্রিকা সম্পাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে যে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন