রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শেষের কবিতা': প্রেমের এক ভিন্ন প্রেক্ষিত
~বিদিশা নাথ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে আধুনিকতার পথ প্রদর্শক, মানব চরিত্র ও সম্পর্কের তুল্য মূল্য বিচারের অন্যতম কান্ডারী,সমাজ বোধ ও মানবিকতাবোধ এই দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ ভারসাম্যকে আয়না স্বরূপ তুলে ধরার সফলতম কারিগর যাঁর লেখা 'শেষের কবিতা' উপন্যাসটিকে রচনাকালের পাশাপাশি বর্তমান যুগেও সমান তাৎপর্যপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়।
একটি উপন্যাসের ভিত্তিপ্রস্তরের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল তার সময়কাল।'শেষের কবিতা' প্রকাশিত হয় ১৯২৯ এ।ভারতবর্ষে তখন একটি টালমাটালের যুগ চলছে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, স্বরাজ ও বয়কট, বঙ্গভঙ্গ এর পাশাপাশি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মুক্ত আদানপ্রদান এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রসার যা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী অন্তঃসার শূন্যতা কে তুলে ধরেছিল আর কিছু প্রাচীন হিন্দু সংস্কারের মুলেও আঘাত করেছিল যার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।এই প্রসঙ্গে শ্রী প্রমথনাথ বিশী বলেন," বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাঙালির নিজের উপর যেন অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করিয়াছে- সম্মুখে ভবিষ্যত অন্ধকার কাজেই কোনো কাজ নাই কিন্তু সেই যুদ্ধ ও নিপুণতা আছে আর এই দুইটা দিয়ে একমাত্র বস্তু কে সে সাধনা করিয়াছে-কি করিয়া কথা বলিতে হয়,কথাই এখন বাঙালির আত্মপ্রকাশের প্রধান উপায়।অমিত রায় সেই বাংলাদেশের লোক।"
'শেষের কবিতা উপন্যাস টিতে সতেরোটি পরিচ্ছেদ আছে এবং প্রত্যেকটির আলাদা নাম রয়েছে যেমন প্রথম টি হল 'অমিত-চরিত'।উপন্যাসটির নায়ক অমিত যে একজন"বেহিসেবি,উড়নচন্ডী,বান ডেকে ছুটে চলেছে বাইরের দিকে-সমস্ত নিয়ে চলেছে ভাসিয়ে ,হাতে কিছুই রাখে না।" এরপর চতুর্থ অধ্যায় 'লাবণ্য পুরাবৃত্ত'-এ আমরা দেখতে পাই লাবণ্য-র,উপন্যাসের নায়িকার। সে মাতৃহারা,আধুনিকতা ,আত্মসম্মান ও স্বনির্ভরতা যার রক্তে, যে রোম্যান্টিক কিন্তু বিচক্ষণ ,আত্মবিস্মৃত নয়। পঞ্চম অধ্যায় 'আলাপের আরম্ভ'তে এ নায়ক ও নায়িকার আলাপ হয়। যেখানে অমিত লাবণ্যকে বর্ননা করে সকালবেলার দীপ্ত সৌন্দর্য রূপে এবং শান্তি রূপে যা "বিবেচনা শক্তির গভীরতায় অচঞ্চল।"লাবণ্যের প্রেমের স্বরুপ বোঝা যায় অষ্টম অধ্যায়-' লাবণ্য তর্কে' যেখানে সে জানায় সে অমিতের প্রেমে নবজন্ম লাভ করেছে, অমিত কে বিয়ে করে সে প্রেম সে নষ্ট করতে চায় না তার চেয়ে সে অমিতের স্বপ্ন হয়ে থাকতে চায়।একাদশ পরিচ্ছেদ থেকে প্রেমের অন্তিমপর্ব শুরু হয় যখন লাবণ্যের 'আশঙ্কা' সত্যি করে চতুর্দশ পরিচ্ছেদে 'ধূমকেতু'তে ধূমকেতুর মতোই আবির্ভাব ঘটে অমিতের বোন সিসি-র বন্ধু কেটি বা কেতকী মিত্র যে কিনা লাবণ্যের ভাষায় অমিতের 'অনাদরে গড়া', প্রাণচঞ্চলতা, ইঙ্গবঙ্গ অনুকরণসর্বস্বতার প্রতিমূর্তি। যাকে অমিত বহু আগে আংটি পরিয়ে ছিল ঠিক লাবণ্যের মতোই।এরপর ঘটনাপ্রবাহ যেখানে পৌঁছয় আমরা দেখতে পাই ষোড়শ পরিচ্ছেদ 'মুক্তি' তে যেখানে লাবণ্য অমিতের পরানো আংটি খুলে দেয় আর বলে," আমার প্রেম থাক নিরঞ্জন-বাইরের রেখা,বাইরের ছায়া তাতে পড়বে না।"
'শেষের কবিতা ভালোবাসার দুটি রূপ ব্যক্ত করে,"যে ভালোবাসা ব্যপ্ত ভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ;যে ভালোবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সব কিছুতে যুক্ত হয়ে থাকে সংসারে সে দেয় আসঙ্গ।দুটোই আমি চাই।"অমিত এই ভাবেই লাবণ্যের মধ্যে পায় আকাশ আর কেটির মধ্যে বাসা।
এই উপন্যাস শুধু প্রেমের নকশিকাঁথা বুনন করে তা নয় এতে রয়েছে বাস্তবতার অবারিত প্রতিফলন কারণ এই উপন্যাস দেখায় নারী স্বাধীনতার জয়জয়কার। সে স্বাধীনতা শুধু আর্থিক না,আত্মিক ও। রবীন্দ্রনাথ নর-নারী সম্পর্ক সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেন,"the union of man and woman will all represent a perfect co operation in building up a human history on equal terms in each department of life" যার পূর্ন সহমত দেখা যায় এই উপন্যাসে।তাই এখানে তাঁর নায়িকা নায়কের তাকে গ্রহণের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না,সে অতি সহজেই বলে চলে যেতে পারে,"তোমার সঙ্গে আমার যে অন্তরের সম্বন্ধ তা নিয়ে তোমার লেশমাত্র দায় নেই।"
শেষের কবিতা তে অমিত প্রেমের এক নব্য দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে যা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। প্রেম হয় নানা স্তরের ,নানা প্রেক্ষিতের তাই অমিত লাবণ্যের প্রতি তার প্রেম কে দীঘির জলের সাথে তুলনা করে যা বারবার ব্যবহারের নয় যে শুধু তার মনের সাঁতার কাটার জন্য আর কেটির প্রেম হল 'ঘড়ার তোলা জল' যা বারবার তুলে বারবার ব্যবহার করা যায়। এ যেন রবীন্দ্রনাথ-এর প্রেমের প্রতি একান্ত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি।কিছু প্রেম কে সাংসারিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্ষেত্রে বেঁধে ফেলে নষ্ট করতে নেই তাকে তার নিজস্ব বৈচিত্র ও দূর্জ্ঞেয়তা নিয়ে থাকতে দিতে হয়।আর কিছু প্রেমে মেশে একনিষ্ঠতা আর ব্যবহারিকতার খাদ যা সংসারের বেচাকেনার বাজারে মুদ্রার তুল্য ধরা হয়।
উপনিষদের তত্ত্ব অনুযায়ী তাই রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন প্রেম ব্যবহারের ক্লিস্টতা পেরিয়ে আপন করুক ত্যাগের আদর্শ। তাই এই উপন্যাসের শেষ অধ্যায় 'শেষের কবিতা'-য় লাবণ্যের শেষ সম্ভাষণ যেন ঋনীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার যখন শেষ একটি পত্রে বিদায় জানায় এই বলে-
"তোমারে যা দিয়েছি সে তোমারি দান গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন