ভিড় থেকে সরে আসি। সমুদ্র জানে না কারও নাম। অনেক লেখার শেষে সাদা পাতা এখনও আরাম...শ্রীজাত

মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৯

অণুগল্প ---""" দত্তক """
কলমে--- সন্দীপ রায়

=================================
আলমারি থেকে রাশিয়ান হার্ট স্পেশালিস্ট ডক্টর থমাস কোরম্যানের  আর্টিকেলটা বের করার সময় হঠাৎ একটা ফটো পায়ের কাছে পড়ে যায় শুভ্র ওরফে কার্ডিয়াক সার্জেন ডঃ শুভ্রনীল ব্যানার্জীর। আনমনেই ফটোটা তুলে নিয়ে দেখতে থাকে।এ তো স্কুলজীবনের ফটো।এইচ.এস এর ব্যাচ।চোখের সামনে  মুহুর্তমধ্যে ভেসে ওঠে রাধারমন স্মৃতি হাই স্কুলের ছবি।বিরাট পাচিঁল ঘেরা স্কুল। দুপাশে বাহারি ফুলের বাগান। শীতে বলাইদার  তত্ত্বাবধানে ডালিয়া,চন্দ্রমল্লিকার রুপে মুগ্ধ হতো পুরো স্কুল।তার পরই ছিল খেলার মাঠ।শুক্রবার টিফিনের পর শীতের মিঠেকড়া রোদ গায়ে মেখে চলত শিক্ষক- ছাত্রদের ক্রিকেট উন্মাদনা।সেই ক্লাসরুম,জানলার পাশের বেঞ্চ,জানলা দিয়ে  স্কুলের বাইরে কেষ্টদার সুরেলা আওয়াজে ঘুগনি বিক্রি  দেখা...সোনার  দিনগুলো আজ এক লহমায় যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে।বাংলার প্রভাত স্যারের আবেগঘন কণ্ঠে আবৃত্তি,শিহরণ জাগাত।বায়োলজির নাজেম স্যারের দুর্দান্ত আঁকা-লেখা আজও স্মৃতির পাতায় হীরকদ্যুতিতে উজ্জ্বল।মণি-শাশ্বত'র সাথে টিফিন শেয়ার আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আগের দিন রাত জেগে স্টেজ তৈরী,রিহার্সাল--আঃ!কি দিন ছিল সে সব।আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে কিছুটা।তবে স্মৃতিতে রাধারমন হাই স্কুল মানেই যার অবয়ব সবচেয়ে আগে মনে পড়ে তিনি স্কুলের গণিত শিক্ষক শ্রদ্ধেয় পরিতোষ ভট্টাচার্য্য।যেমন পর্বতপ্রমাণ চেহারা,তেমনি ভীষণ রাগী।এক একটা অঙ্কের সমস্তরকম সমাধান পদ্ধতিই ছিল তাঁর নখদর্পনে।না পারলে তিনি নতুন নতুন শাস্তির অবতারণা করতেন।এই রকম দোর্দন্ডপ্রতাপ মানুষের অন্তরেও একটি শিশুসুলভ মন লুকিয়ে থাকত যা সকলের দৃষ্টিগোচর হয় নি।বলতেন---"আমি তোদের বাবার মতো,তাই তো শাসন করি"।কথাটা মনে পড়তেই  বুকের ভেতরটা চিনচিন করে ওঠে। সতেরো দিন হল হঠাৎ হৃৎরোগে আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা গিয়েছেন।ফোন পেয়েই ব্যাঙ্গালোর থেকে তড়িঘড়ি ছুটে এসেছে।বছর তিনেক আগে মা গত হওয়ার পর বাবাকে শুভ্র'র কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য কম পীড়াপীড়ি করেনি,কিন্তু স্বাধীনচেতা মানুষটা প্রিয় সহধর্মীনির স্মৃতি আঁকড়ে অন্ডালেই থেকে গিয়েছিলেন।হয়তো সেজন্যই দেশের তৃতীয় সেরা সার্জেন হওয়া সত্ত্বেও বাবার অন্তিম মুহুর্তে কিছুই করা সম্ভব হয়নি।ভাবতেই চোখ দুটো ভিজে যায় শুভ্রর।হাতে এখনো তিনটে দিন।কি করবে ভাবতেই মাথায় একটা প্ল্যান আসে।

পরদিন সকালে ড্রাইভ করে শুভ্র চলে আসে তার স্মৃতিমেদুর স্কুলগেটের সামনে।ঘুরে ঘুরে পুরোনো দিনগুলোর সাথে বতর্মানকে মেলানোর চেষ্টা করে,কিন্তু কোথাও সময়ের দূরত্ব অনুভব করে।অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে,অবসর গ্রহনের পরেই সাংসারিক অশান্তি-যন্ত্রণার নীরব সাক্ষী পরিতোষবাবুর বর্তমান স্থায়ী  ঠিকানা নিকটবর্তী এক বৃদ্ধাশ্রম।খবরটা শোনার পর মনের ভেতরে যেন হাজারটা ঢেউ আছড়ে পড়ে।ঠিকানাটা নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যায় বৃদ্ধাশ্রমে।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে।জীবনযুদ্ধে পরাজিত, হার না মানা কিছু মানুষের মধ্যে এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছে পরিতোষ ভট্টাচার্যে্র অতি প্রিয় ছাত্রটি।দুর থেকেই শুভ্র চিনতে পারে তার স্যারকে।স্যার!চিনতে পারছেন?আ...মি শুভ্রনীল,শুভ্রনীল ব্যানার্জী।ভগ্নদেহ একটি  মানুষ ভাঙাকাঁচ চশমার মধ্যে দিয়ে মুখ তোলে,পুরানো স্মৃতি হাতড়ায়।"তুই এসেছিস,বাবা" বলে শিশুর মতো জড়িয়ে ধরে শুভ্রকে।যাবতীয় দুঃখ -কষ্টের সীমানায় দাঁড়িয়ে শিক্ষক-ছাত্রের দুটি হৃদয় আবেগাশ্রুতে ভেসে যায়।স্যারকে অপেক্ষা করতে বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই  ফিরে আসে । "নিন স্যার,তৈরী হয়ে নিন" বলে কাকে যেন একটা ফোন করে।স্যার হতবাক দাঁড়িয়ে আছে দেখে বলে ওঠে---"আজ থেকে আমার কাছেই থাকবেন।এই পিতৃহারা সন্তান আজ পিতা হিসেবে আপনাকে দত্তক নিল"।বাঁধভাঙা কান্নায় ভেসে যায় পরিতোষবাবুর চিবুক -হৃদয়।ওদিকে কাঁসর-ঘন্টাধ্বনি মুখরিত সন্ধ্যারতি শুরু হয় আশ্রমে।সবাই একই সাথে গেয়ে ওঠে---"বিশ্বপিতা তুমি হে প্রভু....."।।

                           #/#/#/#/#

২টি মন্তব্য: