>
> রহস্যময় অরণ্যের হাতছানি - উত্তরবঙ্গ
সায়ন্তনী বক্সী
>
> "আমি চঞ্চল হে,
> আমি সুদূরেরও পিয়াসী"
> সুদীর্ঘকাল যাবৎ মানুষ অজানাকে জানতে চেয়েছে, দূরকে নিকট করতে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে।এই আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করতে মানুষ তার ঘর ছেড়ে বারবার বেরিয়ে পড়েছে 'চরৈবেতি' মন্ত্রকে সম্বল করে। আমার নিজের জীবনের ক্ষেত্রে যদিও এই বেরিয়ে পড়া খুব বেশি বার হয়ে ওঠেনি। তবুও এখনও পর্যন্ত যে কটি জায়গায় ভ্রমণ করেছি ;তারই মধ্যে একটিকে বেছে নিয়ে সেই অভিজ্ঞতা ভ্রমণকাহিনি রূপে লেখার জন্য কলম ধরলাম। যদিও অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, চোখদুটো থাকলেই দেখা যায় কিন্তু হাতদুটো থাকলেই লেখা যায় না। তাই লিখতে গিয়ে একথা অবশ্যই মাথায় থাকবে যে ভ্রমণকাহিনি অযথা guide book হয়ে গিয়ে পাঠকের মনে বিরক্তির না উদ্রেক করে!
>
> আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে শারদোৎসবের ছুটিতে সপরিবারে গিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গ বেড়াতে। সেই আমার প্রথম পাহাড়-অরণ্য একত্রে দর্শন; তাই সেই সুখস্মৃতি আজও অমলিন। পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলবো, তাঁরা যদি উত্তরবঙ্গ বেড়াতে যেতে চান তো সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর হল আদর্শ সময় ওখানে বেড়াতে যাওয়ার। মহালয়ার পরদিন সপরিবারে যাত্রা করলাম উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে। যাত্রা শুরু হল শিয়ালদহ স্টেশন থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে সন্ধ্যার সময়। নামেই এক্সপ্রেস,গাড়ির গতি ছিল লোকাল ট্রেনের মতো! বুঝলাম বেশ সময় লেগে যাবে গন্তব্যে পৌঁছতে।আর সত্যিই হলোও তাই,পরদিন বেলা ২টো নাগাদ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে থামল আমাদের ছ্যাকরা গাড়ী থুড়ি এক্সপ্রেস ট্রেন! সেখান থেকে আমাদের গাড়ী ছুটলো রাজাভাতখাওয়ার দিকে।
>
> শ্রীযুক্ত মণি থাপার homestay "Gracilipse" ( যা এক ধরনের বন্য অর্কিড জাতীয় উদ্ভিদ) হলো আমাদের পরবর্তী চারদিনের আশ্রয়স্থল। থাপা জেঠুর আতিথেয়তার সত্যিই তুলনা হয় না। আর ওখানকার বাঙাল রাধুঁনির রান্না করা পদগুলি ছিল অতুলনীয়।তার হাতে তৈরি গুড়ের পায়েসের স্বাদ তো কোনোদিনই ভুলবো না। আশা করি 'ঘটি' পাঠককুল আমার ওপর ক্ষিপ্ত হবেন না! তা সে যাই হোক, এখান থেকে আমরা কাছাকাছি কয়েকটি জায়গায় ঘুরতে গেলাম। অনেক পর্যটকের কাছে তেমন দর্শনীয় না হলেও এখানকার বক্সা জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত Vulture breeding centre একটি আকর্ষণীয় কর্মকাণ্ড। এখানে বিরল প্রজাতির শকুন( oriental white- backed vulture and long-billed vulture)এর প্রজননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে সযত্নে লালন -পালন করা হচ্ছে। এরপর বক্সা ফোর্ট,জয়ন্তী গ্রাম, বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প এইগুলো দেখলাম। জয়ন্তী গ্রাম অবস্থিত ভুটান সীমান্তে। ছবির মতো সুন্দর গ্রামটির সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে জয়ন্তী নদী। এরপর আমরা গেলাম সান্তরাবাড়ী,যেখান থেকে বক্সা ফোর্টের দিকে ট্রেকিং শুরু করলাম যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮৪৪ ফুট। বেশ চমৎকার অভিজ্ঞতা ছিল সেটি; মনে পড়ে যাচ্ছিল 'আরণ্যক' উপন্যাসের কথা। আর একটা অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়; আর সেটা হলো ঘন্টাধ্বনির কথা। আমরা যখন জিপে করে জঙ্গলের রাস্তা ধরে কোথাও যাচ্ছিলাম তখনি শুনতে পাচ্ছিলাম শব্দটা -- যেন দূরে কোথাও মন্দিরে ঘন্টা বাজচ্ছে, অথচ মন্দিরের কোনো দেখা নেই। আমাদের পথপ্রদর্শক বললেন ওটা ঝিঁঝিঁর ডাক! অবাক করার মতো কান্ডই বটে।
>
> জয়ন্তী থেকে ১৩ কিমি দূরত্বে প্রাকৃতিক stalactite পাথরে তৈরি গুহা দেখলাম যা ধর্মভীরু মানুষের কাছে মহাকাল মন্দির নামে পরিচিত। প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে আমাদেরও ভালো লাগলো। এরপর একে একে গেলাম পোকরি পাহাড়, রায়মাতাং গ্রাম, নারাথালি হ্রদ ও চিলাপাতার জঙ্গলে।অরণ্যে দেখলাম বন্য ময়ূর ও অজস্র নাম না জানা পাখি। চারটে দিন কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।পূ্র্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রওনা দিলাম লাটাগুড়ির উদ্দেশ্যে রাজাভাতখাওয়াকে বিদায় জানিয়ে। লাটাগুড়িতে গিয়ে আমরা ছিলাম পঞ্চক রিসোর্ট এ; এখানকার ব্যবস্থাপনাও ছিল অতি পরিপাটি। এখানেও প্রায় চারদিন ছিলাম, চারপাশে ঘন জঙ্গলের মাঝে রিসোর্ট।হাতি বা অন্য কোনো বন্যপ্রাণী যাতে রিসোর্টের কোনো ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য গোটা চত্বরটা বিশাল কাঁটাতারের পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। এমন ব্যবস্থা রাজাভাতখাওয়াতেও দেখে ছিলাম। বেশ জমাটি মুরগীর ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে সে রাত্রির মতো শুতে গেলাম। প্রায় মধ্য রাত্রি নাগাদ মুষলধারায় বৃষ্টি এলো-- চলল ঘন্টা দুয়েক।
>
> সকালে উঠে দেখি কোথায় কি!দিব্যি রোদ ঝলমলে মেঘমুক্ত শরতের নীল আকাশ। ভাবলাম গতরাতে তাহলে বোধহয় স্বপ্নই দেখেছি। দেখলাম আমার বড় মামা তাপসদা ( tour manager) ও নেপালদার (জঙ্গল সাফারির চালক ও পথপ্রদর্শক) সাথে গম্ভীর স্বরে কী যেন আলোচনা করছেন। কথা বলে জানতে পারলাম গতকাল প্রচন্ড বৃষ্টি কারণে জঙ্গল সফর কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো, তাহলে কী যাওয়া হবে না? তবে খুব তাড়াতাড়িই মনের মেঘ কেটে গেলো। দুপুরের দিকে আমরা চাপড়ামারি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র ও গরুমারা জাতীয় উদ্যানের দিকে। বৃষ্টি হওয়ার ফলে জঙ্গলের গাছপালাগুলো বেশ সতেজ দেখাচ্ছে। প্রথমে যাওয়া হলো গরুমারাতে, তারপর চাপড়ামারি। সত্যি বলতে কী, কোনো জঙ্গলেই কোনো বন্যপ্রাণী অর্থাৎ বাঘ বা হাতির দেখা পেলাম না। চাপড়ামারির জঙ্গলে গিয়ে হলো অন্য এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। গভীর জঙ্গলে কাদার মধ্যে গাড়ীর চাকা গেল ঢুকে। সবাইকে সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে বেশ ভয়ে ভয়েই গাড়ী থেকে বাইরে বেরতে হল। দূর থেকে কোনো জান্তব আওয়াজ যেন আসতে লাগলো আমাদের কানে। তবে চাক্ষুষ কাউকে দেখতে পেলাম না। যাইহোক শেষপর্যন্ত গাড়ীর চাকা যথাস্থানে ফিরে এসে পঞ্চকের দিকে ধাবমান হলো।
>
> ফিরে আসার পর রাতেই ঠিক হয়ে গেলো, পরদিন ভোর ৪টের সময় জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে একশৃঙ্গ গন্ডার দেখতে যাবো। পরিকল্পনা মতো পরের দিন ভোরের বেলা একশৃঙ্গ অভিযানের সূত্রপাতেই ঘটলো বিষম বিভ্রাট! এক দঙ্গল বন্য হস্তী আমাদের পথ করলো রোধ! তবে পরম সৌভাগ্য এই যে দলটি বেশ বড় হওয়া সত্ত্বেও ; বনের সংকীর্ণ পশু চলাচলের পথ ধরে বেরিয়ে এসে গাড়ির আগে আগে চলেছিলো হেলতে দুলতে। আমাদের সারথি নেপালদা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী থামিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো, কারণ এই অঞ্চলে এধরনের ঘটনা সম্পূর্ণভাবেই প্রত্যাশিত। গাড়ীর যান্ত্রিক শব্দ বন্ধ হয়ে গিয়ে চারপাশ অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য এসে গ্রাস করলো। শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক আর সামনে চলা জন্তুর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ যেন পৃথিবীতে নেই। শ্বাসরোধ করে বসে আছি আমরা একটুও টুঁ শব্দ না করে। কারণ অভিজ্ঞ নেপালদা জানিয়েছেন কোনো আওয়াজ শুনতে পেলে হাতির দল আক্রমণ করতে পারে! অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর শেষপর্যন্ত ধৈর্য হারা হয়েই মামা ক্যামেরা বের করলেন ছবি তুলবেন বলে। ছবি নেওয়ার পর দেখা গেলো হস্তিকুল ডানদিকের বনপথ ধরে ঢুকে যাচ্ছে, আর আমাদের সামনে দিয়ে চলেছে বন্য মহিষের দল! চারদিক তখন ঊষার প্রথম আলোয় আলোকিত।
>
> যাইহোক শেষপর্যন্ত জলদাপাড়ায় পৌঁছালাম।ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম কিন্তু একশৃঙ্গের দেখা পেলাম না; কারণ বেশ বেলা হয়ে গিয়েছিল। বলতে গেলে খামখেয়ালি হাতিগুলোই গন্ডার দেখতে দিলো না! প্রায় ঘন্টা দুয়েক থাকার পর হলংএর দিকে ছুটলো গাড়ি। হলংএ সরকারি বনবাংলো রয়েছে, চাইলে বেশ কয়েকটা দিন থেকে সামনের জলাশয়ে জল খেতে আসা বন্য জীবের দর্শন পাওয়া যায়। তবে আমরা শুধু একপাল পোষা হাতি দেখে ক্ষান্ত হয়ে সন্ধের সাড়ে ৭টারা দিকে ফিরে এলাম পঞ্চকে। পরের দিন প্রাতরাশে বাঙালির প্রিয় খাবার লুচি, ছোলার ডাল ও আলুর দম সহযোগে বেশ তরিবৎ করে খাওয়া হলো। তারপর রথে আরোহন করলাম, সারথীর সুনিপুণ রথ চালনায় বিন্দু, সামসিং, সুলতানেখোলা, জলঢাকা বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়ে অবশেষে মূর্তি নদীর তীরে উপস্থিত হলাম। ইতিমধ্যে গাড়ির মধ্যেই রিসোর্ট থেকে আনা ফ্রায়েড রাইস, চিলিচিকেন,চাটনি, পাঁপড় দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করে নিয়েছি। বেলাশেষের আলোয় মূর্তি নদীর পায়ের পাতা ডোবানো জলে সবাই মিলে করলাম জলকেলি। তারপর 'আমাদের ছোট নদী' পেরিয়ে গেলাম ওপারের বন দেখতে। গাছের ডালে ডালে দেখলাম অনেক বাঁদর, নীলকন্ঠ, ফিঙে প্রভৃতি পাখি। তবে হরিণ ভায়া বা বাঘ মামার দেখা এবারো পেলাম না। তাদের দেখা পেতে অনেক সাধ্যসাধনা করতে হয়,অপেক্ষা করতে হয়। স্বল্পকালীন ভ্রমণ পরিকল্পনার মধ্যে তা সম্ভব ছিল না। হঠাৎ মামা আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন, আমরাও তাকিয়ে দেখি দূরে পাহাড়ের চূড়ায় ঘন কালো মেঘ করেছে - বৃষ্টি হচ্ছে অথচ উপত্যকা রোদ ঝলমল। তাপসদা বললেন তাড়াতাড়ি ওপারে ফিরতে হবে নইলে বিপদ হতে পারে। বিপদটা যে কি সেটা বুঝলাম নদী পার হতে গিয়ে। পাহাড়ে বৃষ্টি হওয়ার দরুন নদীতে হাঁটু সমান জল; ক্ষীণকায়া মূর্তি স্ফীতকায়া হওয়ার দিকে দূর্নিবার গতিতে এগিয়ে চলেছে। কোনোক্রমে সেই দুর্দান্ত স্রোত ঠেলে নদীতটে পৌঁছলাম, তারপর পঞ্চকের রাস্তা ধরলাম- তখন" ছায়া ঘনাইছে বনে বনে"।
>
> আজ উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের শেষ দিন। ডুয়ার্সের গহীন অরণ্যের রহস্য ভেদ করা হলোনা,ব্যক্তিগত ক্যামেরা ও টেপরেকর্ডার না থাকায় প্রকৃতির দৃশ্য ও শব্দসম্ভার আমার মনের ক্যামেরা ও টেপরেকর্ডারে বন্দি করে এবার পূর্ব সূচী অনুযায়ী সিকিমে পাড়ি দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিলাম।
--------------
> রহস্যময় অরণ্যের হাতছানি - উত্তরবঙ্গ
সায়ন্তনী বক্সী
>
> "আমি চঞ্চল হে,
> আমি সুদূরেরও পিয়াসী"
> সুদীর্ঘকাল যাবৎ মানুষ অজানাকে জানতে চেয়েছে, দূরকে নিকট করতে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে।এই আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করতে মানুষ তার ঘর ছেড়ে বারবার বেরিয়ে পড়েছে 'চরৈবেতি' মন্ত্রকে সম্বল করে। আমার নিজের জীবনের ক্ষেত্রে যদিও এই বেরিয়ে পড়া খুব বেশি বার হয়ে ওঠেনি। তবুও এখনও পর্যন্ত যে কটি জায়গায় ভ্রমণ করেছি ;তারই মধ্যে একটিকে বেছে নিয়ে সেই অভিজ্ঞতা ভ্রমণকাহিনি রূপে লেখার জন্য কলম ধরলাম। যদিও অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, চোখদুটো থাকলেই দেখা যায় কিন্তু হাতদুটো থাকলেই লেখা যায় না। তাই লিখতে গিয়ে একথা অবশ্যই মাথায় থাকবে যে ভ্রমণকাহিনি অযথা guide book হয়ে গিয়ে পাঠকের মনে বিরক্তির না উদ্রেক করে!
>
> আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে শারদোৎসবের ছুটিতে সপরিবারে গিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গ বেড়াতে। সেই আমার প্রথম পাহাড়-অরণ্য একত্রে দর্শন; তাই সেই সুখস্মৃতি আজও অমলিন। পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলবো, তাঁরা যদি উত্তরবঙ্গ বেড়াতে যেতে চান তো সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর হল আদর্শ সময় ওখানে বেড়াতে যাওয়ার। মহালয়ার পরদিন সপরিবারে যাত্রা করলাম উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে। যাত্রা শুরু হল শিয়ালদহ স্টেশন থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে সন্ধ্যার সময়। নামেই এক্সপ্রেস,গাড়ির গতি ছিল লোকাল ট্রেনের মতো! বুঝলাম বেশ সময় লেগে যাবে গন্তব্যে পৌঁছতে।আর সত্যিই হলোও তাই,পরদিন বেলা ২টো নাগাদ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে থামল আমাদের ছ্যাকরা গাড়ী থুড়ি এক্সপ্রেস ট্রেন! সেখান থেকে আমাদের গাড়ী ছুটলো রাজাভাতখাওয়ার দিকে।
>
> শ্রীযুক্ত মণি থাপার homestay "Gracilipse" ( যা এক ধরনের বন্য অর্কিড জাতীয় উদ্ভিদ) হলো আমাদের পরবর্তী চারদিনের আশ্রয়স্থল। থাপা জেঠুর আতিথেয়তার সত্যিই তুলনা হয় না। আর ওখানকার বাঙাল রাধুঁনির রান্না করা পদগুলি ছিল অতুলনীয়।তার হাতে তৈরি গুড়ের পায়েসের স্বাদ তো কোনোদিনই ভুলবো না। আশা করি 'ঘটি' পাঠককুল আমার ওপর ক্ষিপ্ত হবেন না! তা সে যাই হোক, এখান থেকে আমরা কাছাকাছি কয়েকটি জায়গায় ঘুরতে গেলাম। অনেক পর্যটকের কাছে তেমন দর্শনীয় না হলেও এখানকার বক্সা জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত Vulture breeding centre একটি আকর্ষণীয় কর্মকাণ্ড। এখানে বিরল প্রজাতির শকুন( oriental white- backed vulture and long-billed vulture)এর প্রজননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে সযত্নে লালন -পালন করা হচ্ছে। এরপর বক্সা ফোর্ট,জয়ন্তী গ্রাম, বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প এইগুলো দেখলাম। জয়ন্তী গ্রাম অবস্থিত ভুটান সীমান্তে। ছবির মতো সুন্দর গ্রামটির সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে জয়ন্তী নদী। এরপর আমরা গেলাম সান্তরাবাড়ী,যেখান থেকে বক্সা ফোর্টের দিকে ট্রেকিং শুরু করলাম যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮৪৪ ফুট। বেশ চমৎকার অভিজ্ঞতা ছিল সেটি; মনে পড়ে যাচ্ছিল 'আরণ্যক' উপন্যাসের কথা। আর একটা অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়; আর সেটা হলো ঘন্টাধ্বনির কথা। আমরা যখন জিপে করে জঙ্গলের রাস্তা ধরে কোথাও যাচ্ছিলাম তখনি শুনতে পাচ্ছিলাম শব্দটা -- যেন দূরে কোথাও মন্দিরে ঘন্টা বাজচ্ছে, অথচ মন্দিরের কোনো দেখা নেই। আমাদের পথপ্রদর্শক বললেন ওটা ঝিঁঝিঁর ডাক! অবাক করার মতো কান্ডই বটে।
>
> জয়ন্তী থেকে ১৩ কিমি দূরত্বে প্রাকৃতিক stalactite পাথরে তৈরি গুহা দেখলাম যা ধর্মভীরু মানুষের কাছে মহাকাল মন্দির নামে পরিচিত। প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে আমাদেরও ভালো লাগলো। এরপর একে একে গেলাম পোকরি পাহাড়, রায়মাতাং গ্রাম, নারাথালি হ্রদ ও চিলাপাতার জঙ্গলে।অরণ্যে দেখলাম বন্য ময়ূর ও অজস্র নাম না জানা পাখি। চারটে দিন কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।পূ্র্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রওনা দিলাম লাটাগুড়ির উদ্দেশ্যে রাজাভাতখাওয়াকে বিদায় জানিয়ে। লাটাগুড়িতে গিয়ে আমরা ছিলাম পঞ্চক রিসোর্ট এ; এখানকার ব্যবস্থাপনাও ছিল অতি পরিপাটি। এখানেও প্রায় চারদিন ছিলাম, চারপাশে ঘন জঙ্গলের মাঝে রিসোর্ট।হাতি বা অন্য কোনো বন্যপ্রাণী যাতে রিসোর্টের কোনো ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য গোটা চত্বরটা বিশাল কাঁটাতারের পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। এমন ব্যবস্থা রাজাভাতখাওয়াতেও দেখে ছিলাম। বেশ জমাটি মুরগীর ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে সে রাত্রির মতো শুতে গেলাম। প্রায় মধ্য রাত্রি নাগাদ মুষলধারায় বৃষ্টি এলো-- চলল ঘন্টা দুয়েক।
>
> সকালে উঠে দেখি কোথায় কি!দিব্যি রোদ ঝলমলে মেঘমুক্ত শরতের নীল আকাশ। ভাবলাম গতরাতে তাহলে বোধহয় স্বপ্নই দেখেছি। দেখলাম আমার বড় মামা তাপসদা ( tour manager) ও নেপালদার (জঙ্গল সাফারির চালক ও পথপ্রদর্শক) সাথে গম্ভীর স্বরে কী যেন আলোচনা করছেন। কথা বলে জানতে পারলাম গতকাল প্রচন্ড বৃষ্টি কারণে জঙ্গল সফর কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো, তাহলে কী যাওয়া হবে না? তবে খুব তাড়াতাড়িই মনের মেঘ কেটে গেলো। দুপুরের দিকে আমরা চাপড়ামারি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র ও গরুমারা জাতীয় উদ্যানের দিকে। বৃষ্টি হওয়ার ফলে জঙ্গলের গাছপালাগুলো বেশ সতেজ দেখাচ্ছে। প্রথমে যাওয়া হলো গরুমারাতে, তারপর চাপড়ামারি। সত্যি বলতে কী, কোনো জঙ্গলেই কোনো বন্যপ্রাণী অর্থাৎ বাঘ বা হাতির দেখা পেলাম না। চাপড়ামারির জঙ্গলে গিয়ে হলো অন্য এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। গভীর জঙ্গলে কাদার মধ্যে গাড়ীর চাকা গেল ঢুকে। সবাইকে সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে বেশ ভয়ে ভয়েই গাড়ী থেকে বাইরে বেরতে হল। দূর থেকে কোনো জান্তব আওয়াজ যেন আসতে লাগলো আমাদের কানে। তবে চাক্ষুষ কাউকে দেখতে পেলাম না। যাইহোক শেষপর্যন্ত গাড়ীর চাকা যথাস্থানে ফিরে এসে পঞ্চকের দিকে ধাবমান হলো।
>
> ফিরে আসার পর রাতেই ঠিক হয়ে গেলো, পরদিন ভোর ৪টের সময় জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে একশৃঙ্গ গন্ডার দেখতে যাবো। পরিকল্পনা মতো পরের দিন ভোরের বেলা একশৃঙ্গ অভিযানের সূত্রপাতেই ঘটলো বিষম বিভ্রাট! এক দঙ্গল বন্য হস্তী আমাদের পথ করলো রোধ! তবে পরম সৌভাগ্য এই যে দলটি বেশ বড় হওয়া সত্ত্বেও ; বনের সংকীর্ণ পশু চলাচলের পথ ধরে বেরিয়ে এসে গাড়ির আগে আগে চলেছিলো হেলতে দুলতে। আমাদের সারথি নেপালদা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী থামিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো, কারণ এই অঞ্চলে এধরনের ঘটনা সম্পূর্ণভাবেই প্রত্যাশিত। গাড়ীর যান্ত্রিক শব্দ বন্ধ হয়ে গিয়ে চারপাশ অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য এসে গ্রাস করলো। শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক আর সামনে চলা জন্তুর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ যেন পৃথিবীতে নেই। শ্বাসরোধ করে বসে আছি আমরা একটুও টুঁ শব্দ না করে। কারণ অভিজ্ঞ নেপালদা জানিয়েছেন কোনো আওয়াজ শুনতে পেলে হাতির দল আক্রমণ করতে পারে! অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর শেষপর্যন্ত ধৈর্য হারা হয়েই মামা ক্যামেরা বের করলেন ছবি তুলবেন বলে। ছবি নেওয়ার পর দেখা গেলো হস্তিকুল ডানদিকের বনপথ ধরে ঢুকে যাচ্ছে, আর আমাদের সামনে দিয়ে চলেছে বন্য মহিষের দল! চারদিক তখন ঊষার প্রথম আলোয় আলোকিত।
>
> যাইহোক শেষপর্যন্ত জলদাপাড়ায় পৌঁছালাম।ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম কিন্তু একশৃঙ্গের দেখা পেলাম না; কারণ বেশ বেলা হয়ে গিয়েছিল। বলতে গেলে খামখেয়ালি হাতিগুলোই গন্ডার দেখতে দিলো না! প্রায় ঘন্টা দুয়েক থাকার পর হলংএর দিকে ছুটলো গাড়ি। হলংএ সরকারি বনবাংলো রয়েছে, চাইলে বেশ কয়েকটা দিন থেকে সামনের জলাশয়ে জল খেতে আসা বন্য জীবের দর্শন পাওয়া যায়। তবে আমরা শুধু একপাল পোষা হাতি দেখে ক্ষান্ত হয়ে সন্ধের সাড়ে ৭টারা দিকে ফিরে এলাম পঞ্চকে। পরের দিন প্রাতরাশে বাঙালির প্রিয় খাবার লুচি, ছোলার ডাল ও আলুর দম সহযোগে বেশ তরিবৎ করে খাওয়া হলো। তারপর রথে আরোহন করলাম, সারথীর সুনিপুণ রথ চালনায় বিন্দু, সামসিং, সুলতানেখোলা, জলঢাকা বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়ে অবশেষে মূর্তি নদীর তীরে উপস্থিত হলাম। ইতিমধ্যে গাড়ির মধ্যেই রিসোর্ট থেকে আনা ফ্রায়েড রাইস, চিলিচিকেন,চাটনি, পাঁপড় দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করে নিয়েছি। বেলাশেষের আলোয় মূর্তি নদীর পায়ের পাতা ডোবানো জলে সবাই মিলে করলাম জলকেলি। তারপর 'আমাদের ছোট নদী' পেরিয়ে গেলাম ওপারের বন দেখতে। গাছের ডালে ডালে দেখলাম অনেক বাঁদর, নীলকন্ঠ, ফিঙে প্রভৃতি পাখি। তবে হরিণ ভায়া বা বাঘ মামার দেখা এবারো পেলাম না। তাদের দেখা পেতে অনেক সাধ্যসাধনা করতে হয়,অপেক্ষা করতে হয়। স্বল্পকালীন ভ্রমণ পরিকল্পনার মধ্যে তা সম্ভব ছিল না। হঠাৎ মামা আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন, আমরাও তাকিয়ে দেখি দূরে পাহাড়ের চূড়ায় ঘন কালো মেঘ করেছে - বৃষ্টি হচ্ছে অথচ উপত্যকা রোদ ঝলমল। তাপসদা বললেন তাড়াতাড়ি ওপারে ফিরতে হবে নইলে বিপদ হতে পারে। বিপদটা যে কি সেটা বুঝলাম নদী পার হতে গিয়ে। পাহাড়ে বৃষ্টি হওয়ার দরুন নদীতে হাঁটু সমান জল; ক্ষীণকায়া মূর্তি স্ফীতকায়া হওয়ার দিকে দূর্নিবার গতিতে এগিয়ে চলেছে। কোনোক্রমে সেই দুর্দান্ত স্রোত ঠেলে নদীতটে পৌঁছলাম, তারপর পঞ্চকের রাস্তা ধরলাম- তখন" ছায়া ঘনাইছে বনে বনে"।
>
> আজ উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের শেষ দিন। ডুয়ার্সের গহীন অরণ্যের রহস্য ভেদ করা হলোনা,ব্যক্তিগত ক্যামেরা ও টেপরেকর্ডার না থাকায় প্রকৃতির দৃশ্য ও শব্দসম্ভার আমার মনের ক্যামেরা ও টেপরেকর্ডারে বন্দি করে এবার পূর্ব সূচী অনুযায়ী সিকিমে পাড়ি দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিলাম।
--------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন